Published : 27 Jul 2023, 11:31 PM
শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের কথা পরদিন ভোরেই গিট্টুকে জানিয়ে দেন চান্দুমামা। শুনে গিট্টু তিনপাক নেচে নেয় ছাদের ওপর। ভোরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিলেন চান্দুমামা। এতো ভোরে ছাদে কেউ আসে না। গিট্টু প্রায়দিন এসময়ই আসে। চান্দুমামা অনেক কিছু শেয়ার করেন গিট্টুর সাথে। গিট্টুও।
মামা শ্রীমঙ্গল যাবার কী হলো?
কাল রাতে যাবি রে। রাত দশটায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন। আমরা উঠবো এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন থেকে। রেডি থাকিস।
আমি ফুলটাইম রেডি মামা। আমার তো আর ব্যাগ গোছানোর ব্যাপার নাই। যেখানে রাত সেখানেই কাত। মামার কাছ থেকে শোনা প্রবাদটাই মেরে দেয় গিট্টু। শুনে মামা হাসেন।
হ্যাঁ, রাত নটায় বাসা থেকে বের হবো আমরা। চলে আসিস।
আসবো মামা। আমাকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না। বাই মামা, বলেই ফুস করে গিট্টু অদৃশ্য হয়ে যায়।
অফিস থেকে ফিরেই মামা মম ও সিঁথির কাছে তাদের প্রস্তুতির কথা জানতে চান। মম জানায়, ওরা একশভাগ রেডি। শুধু ড্রেস পরেই বের হয়ে যাওয়া। রাত সাড়ে আটটার দিকে খাওয়া সেরে রেডি হয় সবাই। ঠিক নয়টায় নিচে নামে।
সিএনজি কি পাওয়া যাবে রে!
সিএনজি কেন বাবা? উবারে কল দিয়েছি তো! তিন চার মিনিটের মধ্যেই এসে যাবে।
ও…তাই!
চান্দুমামা চিন্তা করেন কত পাল্টে গেছে সবকিছু। আগে বেবিট্যাক্সি ছিলো, তারপর এলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এখন উবার। সফটওয়্যার আর অ্যাপবেইজড পরিবহন ব্যবস্থা। ভাড়া নিয়েও কোন কথা নেই, দরাদরি নেই।
ঠিক তিন মিনিটের মাথায় গাড়ি এসে থামে। ওরা তিনজন ভেতরে আর চান্দুমামা সামনে বসেন। গিট্টু জানায় ও ছাদে আছে। স্টেশনে পৌঁছানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই উপবন এসে প্ল্যাটফর্মের নির্ধারিত জায়গায় এসে দাঁড়ায়। কম্পার্টমেন্ট লোকেটর সাইন অনুযায়ী কামরাগুলো থামে, মালপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না।
ট্রেনে উঠেই মম-সিঁথি সবার মন ভালো হয়ে যায়। ওদের আসন পড়েছে কম্পার্টমেন্টের ঠিক মাঝে। মুখোমুখি চারটি আসন, মাঝখানে একটি টেবিল। এ সুবিধা প্রত্যেক কম্পার্টমেন্টে মাত্র আটটি আসনেই থাকে। যাক জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। মনে মনে গিট্টুকে খোঁজেন চান্দুমামা। কে জানে বেটা কোথায়? হয়তো ছাদে পা ঝুলিয়ে রাতের প্রকৃতি উপভোগে ব্যস্ত।
ট্রেনের ভেতর উষ্ণ আবহাওয়া। বাইরে হালকা শীত। সবার খুব ভালো লাগছে। মম ফোন বের করার চেষ্টা করতেই চান্দুমামা বাধা দেন, না চলবে না। শুধুই আড্ডা। কফি দিতে বলেছি। এখনই আসবে, তারপর র্যানডম আড্ডা চলবে।
ঠিক আছে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি আসে। চারজন কফির কাপে চুমুক দেয়। চান্দুমামা তার উনিশ’শ একাত্তরের স্মৃতিতে ডুব দেন। তিন শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই ভয়াবহ স্মৃতিগল্পে ডুবে যায়। উপবন এক্সপ্রেস দৌড়াতে থাকে সিলেটের পথে।
রাত প্রায় আড়াইটার দিকে শ্রীমঙ্গলে থামে উপবন এক্সপ্রেস। ট্রেন থেকে নেমে বুঝা যায় শীত পড়ে গেছে শ্রীমঙ্গলে। পাহাড় আর হাওরঘেরা শ্রীমঙ্গলে শীত, বৃষ্টি, গরম- একটু বেশিই। আর চান্দুমামা এটা উপভোগ করেন। তার ভালো লাগে। রাতে শ্রীমঙ্গল শহরে রিকশা চলে না। অদ্ভুত একটা কারণে রিকশা বন্ধ করে রেখেছে পৌর প্রশাসন।তবে সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলে। আর প্রাইভেট গাড়ি তো আছেই।
চান্দুমামাদের বাড়ি শহরের কাছেই। মামা ব্যাটারিচালিত একটা অটোরিকশা ঠিক করে ফেলেন। গিট্টুও সাথে আছে অদৃশ্য হয়ে। সবাই ব্যাগ নিয়ে অটোতে উঠে। অটো চলতে শুরু করে। শুনশান শ্রীমঙ্গল শহর। রাস্তার বাতি আর ব্যবসাকেন্দ্রের নিয়ন সাইনগুলো জ্বলছে। চৌমোহনায় কিছু ব্যস্ততা। মৌলভীবাজারগামী কিছু যাত্রী ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসের অপেক্ষায়। শ্যামা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার জমজমাট। বড় তাওয়ায় পরোটা ভাজা হচ্ছে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে শ্যামা।
চান্দুমামার ইচ্ছে করে নেমে যেতে। তারপর জম্পেশ করে গরম পরোটা আর চা। নামা হয় না। মম-সিঁথির চোখে ঘুম। অটো হবিগঞ্জ রোড হয়ে দ্বারিকা পাল মহিলা কলেজের পাশ ঘেঁষে দক্ষিণে উত্তরসুরের পথে এগোয়। রেললাইন ক্রস করে পালপাড়ায় ঢুকে পড়ে। তারপর মল্লিকা লজের উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বাড়ির সবাই সারপ্রাইজড। রাত তিনটে। হৈ-হল্লায় জমজমাট মল্লিকা লজ।
টুটনের সাথে চান্দুমামা ফাইনাল কথা বলে রেখেছেন আগেই। আজ সারাদিন কাটবে বাইক্কা বিলে। টুটনের নোয়া গাড়িটা হবে বাহন। টুটন গাইডের কাজ করবে। মম-সিঁথি-মুমু-কুমু আর চান্দুমামা যাবেন। মিনি পিকনিক। খাবার-দাবার সব পানসী থেকে নেওয়া হবে। মেন্যু দিয়ে দিয়েছেন চান্দুমামা। টুটন সব ব্যবস্থা করবে। সকাল আটটায় টুটন গাড়ি নিয়ে উঠোনে চলে এলো। হর্ন শুনেই দৌড়ে বের হলো মুমু-কুমু। সাড়ে আটটার মধ্যে যাত্রা শুরু।
ভানুগাছ রোডের পানসী থেকে খাবার আর প্রয়োজনীয় সবকিছু তুলে নিলো টুটন। তারপর যাত্রা শুরু হলো বাইক্কা বিলের পথে। শ্রীমঙ্গল শহরের প্রতিটি মোড়ে চমৎকার সব ভাস্কর্য। মমর চোখে পড়লেই হলো। ‘টুটন কাকু আস্তে যাও ছবি তুলবো’। চৌমোহনায় হালকা জ্যাম। চন্দ্রনাথ স্কুলের সামনে থেকে টুসিকে তোলা হলো। মমদের আড্ডা জমে উঠলো।
চান্দুমামার নিজের শহর শ্রীমঙ্গল। শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি তার শ্রীমঙ্গলকে ঘিরে। ভিক্টোরিয়া হাই স্কুল গেট পেছনে রেখে হাউজিং এস্টেট পার হয়ে ইউনিয়ন পরিষদকে পাশ কাটিয়ে ছুটতে থাকে গাড়ি। নোয়াগাঁও, কাকিয়া বাজার হয়ে কালাপুর।
একটু এগোতেই ভাগলপুর মসজিদ। তারপর গাড়ি বামে মোড় নিলো। বাইক্কা বিল রোড। এ রোডের আরেক নাম বরুনা রোড। বরুনা গ্রামের বিখ্যাত বরুনা মাদ্রাসায় যেতে এ রোড ধরেই এগোতে হয়। রাস্তা অনেকগুলো বাঁক নিয়ে হাজীপুর জামে মসজিদ ছুঁয়ে পশ্চিমে গিয়েছে। হাজীপুর ঘাটের বাজার পেরিয়ে একটু এগোতেই চোখের সামনে বাইক্কা বিল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে একটু দূরে থামে গাড়ি। সবাই নেমে হাইল হাওরের পরিষ্কার বাতাস নেয় বুকভরে।
বাচ্চারা উৎসাহে ফুটছে। চান্দুমামার কাছ থেকে বাইক্কা বিলের এতো গল্প শুনেছে ওরা! সেই বিল এখন চোখের সামনে। মম-সিঁথি ফোন ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছে। চান্দুমামা টিকিট কেটে নিয়ে আসেন। তারপর সবাই মিলে হাঁটতে থাকে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে।
চলবে…