গবেষণাটা হচ্ছে, মানুষের ডিএনএর সঙ্গে গাছের ডিএনএর রিকম্বিনেশন। তাহলে, মানুষও গাছের মতো নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করতে পারবে!
Published : 14 Jun 2023, 03:21 PM
ছোট্ট মেয়ে তিথি। খেলছে ওর রোবটের সঙ্গে। খেলছে না ছাই! ভেবেছিল গামলার পানি ছুড়ে একটু মজা করবে। তাই এক পশলা পানি ছিটিয়ে দিয়েছিল রোবটের মুখে। ওমনি বিপ! বিপ!
আম্মুর মতোই গম্ভীর হয়ে গেল রোবটটা। তারপর বলে উঠলো, ‘এই পানির তাপমাত্রা বেশ কম! এর থেকে ফ্লু হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে’। টিউ করে একটা শব্দ হলো। সাময়িক বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হতচ্ছাড়া রোবটটা। রাগে তিথির চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো। ও জানে, সারাদিন ঝাঁকালেও পাজি রোবট আর পানি ছোড়া খেলবেই না।
বাধ্য হয়ে টিভি দেখতে বসলো ও। টিভিতে একটা খবর দেখাচ্ছে। শিরোনামে চোখ রাখলো তিথি। ‘অবশেষে সফল বিজ্ঞানীরা! দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় খাদ্য নিরাপত্তার সমাধান বের হল।’ ছোট হলেও তিথি বুঝতে পারে, এ সময়ের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এটা। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে এখন অনেক কিছু হলেও, মানুষের পেট ভরে না। তার জন্য চাই খাবার।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষ এতো বেশি যুদ্ধ করেছে যে, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে কোন জমিই আর ফসল উৎপাদনে সক্ষম নয়। একবিংশ শতাব্দীতে শিল্প কারখানাও নাকি বেড়ে গিয়েছিল অনেক অনেক বেশি। তার ধকল নিতে পারেনি পরিবেশ। ফলে, খরা, অনাবৃষ্টি দেখেছে প্রকৃতি। এসিড বৃষ্টি হয়েছে লাগাতার। তাপমাত্রা বেড়ে ফসলি জমিগুলো মরুভূমি হয়ে গেছে অনেক আগেই। একসময় খাবারের অভাবে মারা গিয়েছে কোটি কোটি মানুষ।
তবে এই আবিষ্কার নিয়ে তিথির আগ্রহ একটু কমই বলতে হবে। কারণ, গোটা পৃথিবীর লোক গবেষণার ফলাফলটা মাত্রই জানলো। তবে তিথি জানতো আগে থেকেই। ওর বাবা হাসনাত আলমাস হচ্ছেন এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান। রোজ বাড়ি ফিরে তিথি আর তার আম্মুকে তিনি এর গল্পই বলতেন। শুনতে শুনতে তিথির মুখস্থ হয়ে গেছে। বাবার গবেষণাটা হচ্ছে, মানুষের ডিএনএর সঙ্গে গাছের ডিএনএর সফল রিকম্বিনেশন!
পৃথিবীতে টিকে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে রিকম্বিনেটেড কোষ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে হরমোন। দেখতে দেখতে কিছুদিন পর সবুজ হয়ে যাচ্ছে মানুষের শরীর।
সহজ করে বললে, গাছের ডিএনএ আর মানুষের ডিএনএ কলমের মতো জোড়া লাগানো। তাহলে, মানুষও গাছের মতো নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করতে পারবে! গাছের মতোই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করবে, অক্সিজেন ছাড়বে পরিবেশে। একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হবে তাতে।
তিথির এসব শুনতে মোটেও ভালো লাগেনি। ওফ, তাহলে তো রাস্তাঘাটে কোন রেস্তোরাঁই থাকবে না। আইসক্রিম খেতে ওর খুব ভালো লাগে। কয়েকশো বছর আগে নাকি ফুচকা নামে একটা খাবারও পাওয়া যেত। ছোটরা খুব পছন্দ করতো এ খাবার। এটা লিখে গুগল সার্চ করতেই রেজাল্ট দেখালো, ‘ইট'স ব্যানড। আনহেলদি'! বেশ, এখন থেকে খাওয়া দাওয়াই বন্ধ, হলো তো!
এবার ওর বাবাকে দেখাচ্ছে টিভিতে। ভদ্রলোক বেশ দীপ্তকণ্ঠে বলছেন, 'প্রথমে আমরা মানুষের কিছু দেহকোষের ডিএনএর সঙ্গে উদ্ভিদ কোষের ডিএনএর রিকম্বিনেশন করবো। তারপর এ রিকম্বিনেটেড কোষগুলো প্রতিস্থাপিত হবে মানুষের শরীরে। শুরুতে উদ্ভিদের ডিএনএর অংশটুকু বেশ দুর্বলই থাকবে। আমরা একটি উদ্ভিদজাত হরমোন পেয়েছি যা কোষের ক্লোরোফিল বাড়াতে সাহায্য করে। একইসঙ্গে দেহের অন্যান্য ডিএনএকে রিকম্বিনেট হতে উৎসাহ যোগায়। ওটা মানবশরীরে প্রয়োগ করলে উদ্ভদ ডিএনএর অংশটুকু প্রকট হয়ে উঠবে। একসময় ছড়িয়ে যাবে সারা দেহে!'
'এটা কীভাবে কাজ করবে?' কোন এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন মিস্টার হাসনাতের কাছে।
'আমাদের খনিজ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ পানি খেতে হবে শুধু। ঠিক গাছের মতোই। আর হ্যাঁ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে, দীর্ঘ একটা সময় রোদে থাকতে হবে। সালোকসংশ্লেষণের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না আপনাদের!' বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন হাসনাত সাহেব। বাবার হাসিটা কেমন বিশ্রি লাগলো তিথির। টিভি অফ করে দিলো সে।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হলো। পৃথিবীতে টিকে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে রিকম্বিনেটেড কোষ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে হরমোন। দেখতে দেখতে কিছুদিন পর সবুজ হয়ে যাচ্ছে মানুষের শরীর। এখন আর খাবারের জন্য শস্য লাগে না। শাকসবজি, ফলমূল এমনকি মাংসও খায় না মানুষ। খাবারের প্লেটই বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। আর মানুষগুলো হয়ে গেছে বড্ড আলসে!
হঠাৎ একটি খবর চাউর হয়ে গেল পৃথিবীময়। কোথায় নাকি এক বুড়ো থাকেন। ছেলেমেয়ে কেউ নেই তার।
খাবারের চিন্তা নেই বলে রোজগারের দরকার ফুরিয়েছে। খাবার ছাড়া তো আর আড্ডা জমবে না। বলতে গেলে, চেয়ারের সঙ্গে একেবারে জমেই গেছে মানুষজন। নিতান্তই যদি রোদের দরকার না পড়তো, ঘর থেকে বের হতো না কেউ। তিথির অসহ্য লাগে এসব। সে চেয়ার জিনিসটাকে তাই বড্ড ঘৃণা করে। একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে একা একাই জনশূন্য পথে হেঁটে বেড়ায়।
চলছিল সব এভাবেই। হঠাৎ একটি খবর চাউর হয়ে গেল পৃথিবীময়। কোথায় নাকি এক বুড়ো থাকেন। ছেলেমেয়ে কেউ নেই তার। খাবার-দাবার তো রাঁধতে হয় না, তাই নড়াচড়ারও বালাই নেই। দেখাশোনা করার লোক রাখেননি কিপ্টে লোকটা। দিনরাত নাকি বসে থাকতেন উঠোনে। ভিটামিন পানি খেতেও ভুলে যেতেন মাঝে মাঝেই। সালোকসংশ্লেষণে ব্যাঘাত ঘটতো নিয়মিতই। গাছের মতোই অচল ছিলেন অনেকটা। যার কারণে তার 'উদ্ভিদ ডিএনএ' এর অংশটুকু বিকশিত হওয়ার দারুণ এক সুযোগ পেয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, সমস্যার সমাধান হিসেবে অদ্ভুত একটি কায়দাও বের করে নিয়েছে তার দেহ। পা থেকে নরম শিরার মতো শেকড় গজিয়েছে। একটু একটু করে মাটিতে গেঁথে গেছে কবেই! টেরও পায়নি সে। এখন পুরো শরীরটাই নাকি গাট্টাগোট্টা একটা গাছ হয়ে গেছে। শেকড়ও চলে গেছে মাটির বেশ নিচে।
খবরটা শুনে সবাই আঁতকে উঠেছে। রোদে যেতে ভয় পাচ্ছে, মাটিতে পা ফেলতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধানটা তিথি জানে। তাইতো অনেক আগে থেকেই সে চেয়ারটাকে ঘৃণা করতো। হেঁটে বেড়াতো একা একাই। যেন গাছের ডিএনএগুলো মানুষের শরীরটাকে পুরোপুরি গাছ বানাতে না পারে।