শব্দের আড়ালে গল্প, পর্ব ২

অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়।

রাজীব কুমার সাহারাজীব কুমার সাহা
Published : 7 June 2023, 07:41 AM
Updated : 7 June 2023, 07:41 AM

অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমনি একই শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।

ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এজন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দের অর্থের গল্প।

টনক নড়া

‘টনক নড়া’ শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। প্রশ্ন হলো এই ‘টনক’ মানে কী? আর এই টনক নড়লেই বা কী হয়? আমরা আমাদের যাপিত জীবনাচারে প্রায়শই এই ‘টনক নড়া’ কথাটি ব্যবহার করে থাকি। চলো এ বিষয়ে সবিস্তারে জেনে আমাদের টনক নড়াই।

‘টনক’ দেশি শব্দ। ‘টনক’ বলতে বোঝানো হয় কপালের শিরাকে। সাধারণত কোনো কিছু স্মরণ করার চেষ্টায় যদি ললাট বা কপালের শিরায় হঠাৎ কুঞ্চন হয় তখন তাকে টনক নড়া বলে। টনক নড়ার অর্থ হলো- চৈতন্যোদয় হওয়া, সজাগ বা হুঁশ হওয়া। প্রকৃতপক্ষে এটি একটা বাগধারা।

‘টনক’ শব্দের অর্থ হলো বি. হুঁশ, খেয়াল, মনোযোগ। টনক নড়া ক্রি. বি. খেয়াল হওয়া বা হুঁশ হওয়া (এতক্ষণে তোমার টনক নড়ল?)। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন- “মরতে স্মরণ করে সাধুর বালক/ কৈলাসেতে ভগবতীর কপালে টনক।” অর্থাৎ এখানে ‘টনক’ মানে হচ্ছে স্মৃতিস্থানে আঘাত বা চৈতন্য উদ্রেককারী আঘাত। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় আমরা টনক নড়াকে চৈতন্যোদয় হওয়া বা হুঁশ হওয়া অর্থে পাই। যেমন- “এক ডুবে তিন গোছা পাট-শিয়ালা তুলে/ ভিজে চুল দিয়ে বেঁধে দড়ি-প্রভুর কাছে পোড়ালে/ প্রভুর টনক নড়বে।” [কালের যাত্রা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

আবার ভিন্ন ব্যুৎপত্তির আরেকটি ‘টনক’ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘টঙ্ক্’ থেকে। বিশেষণ পদে এর অর্থ হয় নিপুণ। বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ রচনায় আছে ‘বিবাদে টনক’ অর্থাৎ ঝগড়ায় দক্ষ বা পটু, লায়েক; বিচক্ষণ প্রভৃতি। একইসঙ্গে ‘টনক’ শব্দের দুটি বানানভেদ আমাদের লেখকদের রচনায় পাওয়া যায়। তা হচ্ছে ‘টনকা’ ও ‘টনকো’।

ষড়যন্ত্র

আমরা প্রায় সবাই জানি ষড়ঋতু মানে ছয় ঋতু। কেননা বলা হয়ে থাকে, ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। তো সেই আদলে যদি ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটির কথা ভাবি। সে হিসেবে তো ষড়যন্ত্র মানে ছয়টি যন্ত্র হওয়া উচিত। তাই নয় কি? যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে মনে প্রশ্ন আসে ষড়যন্ত্রের ছয়টি যন্ত্রের নাম কী? কিন্তু আসলেই কি ষড়যন্ত্র মানে ছয়টি যন্ত্রের সমাহার? এবার তবে চলো ষড়যন্ত্রের যন্ত্রপাতি খুলে এর খুঁটিনাটি দেখি।

সাধারণভাবে আমরা ষড়যন্ত্র বলতে বুঝি অপরের ক্ষতি করার জন্য গোপন চক্রান্ত, অন্যায় করে ফাঁদে ফেলার জন্য প্রতিকূল ব্যক্তিদের কুমন্ত্রণা বা কৌশলজাল, কূটকৌশল প্রভৃতি। চলো তবে প্রথমেই ষড়যন্ত্র শব্দের ব্যুৎপত্তি দেখে নিই।

ষড়যন্ত্র শব্দের ব্যুৎপত্তি: ষড়ঋতুর ‘ষড়্’ এসেছে সংস্কৃত ‘ষট্’= ৬ থেকে; অপরদিকে ‘ষড়যন্ত্র’-এর ‘ষড়’ এসেছে আরবি ‘শলাহ্’ থেকে। সেই সঙ্গে দুটি শব্দের উচ্চারণগত পার্থক্যও মনে রাখতে হবে। যেমন, ষড়ঋতুর ষড় এর উচ্চারণ হবে [/ষড়্/] আর ষড়যন্ত্রের ষড় এর উচ্চারণ হবে [/শড়ো/]। সে হিসেবে, ষড়যন্ত্র /শড়োযন্.ত্রো/ [আ. শলাহ্+স. যন্ত্র]

ষড়যন্ত্র শব্দের অর্থ: মূলত তান্ত্রিকদের তন্ত্রসাধনায় ব্যবহৃত ছয় রকম আভিচারিক প্রক্রিয়া থেকে ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দের উৎপত্তি। আর এই আভিচারিক প্রক্রিয়া মানে হলো নিজের মঙ্গল, কিন্তু অন্যের ক্ষতি সাধনের জন্য করা এক ধরনের তান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আর তাই ষড়যন্ত্র শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো ছয়টি বন্ধন। আর এ ছয়টি বন্ধনে যাকে বাঁধা যাবে তার সর্বনাশ অনিবার্য। প্রকৃতপক্ষে এই ছয়টি বন্ধনের সাধনাই হলো ষড়যন্ত্র।

এ ছয়টি বন্ধন হলো:

১. মারণ বা প্রাণ হরণ করা

২. মোহন বা চিত্তবিভ্রম ঘটানো

৩. স্তম্ভন বা যাবতীয় প্রবৃত্তি নষ্ট করা

৪. বিদ্বেষণ বা অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা

৫. উচ্চাটন বা স্বদেশবিভ্রম ঘটানো এবং

৬. বশীকরণ বা ইচ্ছাশক্তি রোধ করে বশে আনা।

বর্তমানকালে আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় তান্ত্রিকতার প্রয়োগ অতীতের মতো না থাকলেও ষড়যন্ত্র বরাবরের মতোই অব্যাহত আছে। কী বলো তোমরা?

একান্নবর্তী পরিবার

বহুব্রীহি সমাসদ্বারা যুক্ত এই শব্দদুটি নিয়ে তোমরা অনেকেই হয়তো একটু সমস্যায় পড়তে পারো। অনেকেই আবার ‘একান্নবর্তী পরিবার’ কথাটি শুনে পরিবারের সদস্যসংখ্যা গুণতে শুরু করে দিতে পারো। কিন্তু পরিবারের সদস্যসংখ্যা একান্ন তো হয় না। তাহলে একান্নবর্তী কেন? আসল কথা হলো এই একান্ন মানে সংখ্যা ৫১ নয়। এখানে এটি সমাস দ্বারা যুক্ত শব্দ- এক+অন্ন = একান্ন [অ+অ = আ হয়েছে, সন্ধির নিয়ম অনুসারে]

আর এই ‘একান্নবর্তী পরিবার’-এর অর্থ হলো এক অন্নে প্রতিপালিত পরিবার, একত্রে আহার করে এমন পরিবার, পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-পরা একসঙ্গে করা হয় এমন পরিবার, যৌথ পরিবার; ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Joint Family’।

একান্নবর্তী পরিবারে দাদু, ঠাকুরমা, কাকা, কাকিমা, জেঠা, জেঠিমা, জাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোনদের নিয়ে একসঙ্গে জমজমাটভাবে খাওয়া-পরা-থাকা হতো। এ পরিবারে সবার স্নেহ-ভালোবাসা-শাসনে ছোটোরা ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠতো। একসঙ্গে থাকা-খাওয়া, গল্পগুজবে দিন কাটতো সাবলীলভাবে। হয়তো সবসময় সবার জন্য দামি জামাকাপড়, অতি-মুখরোচক খাবারদাবার পাওয়া যেত না, হয়তো মাঝে মাঝে সাংসারিক অশান্তি হতো, কিন্তু তারপরও একটা নিরেট আনন্দ ছিল, যেখানে পারস্পরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো অভাব ছিল না। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মানুষ ছিল।

অপরদিকে এর বিপরীত শব্দ সম্ভবত প্রাচীন বাংলায়ও পাওয়া যাবে না। কেননা নিউক্লিয়ার পরিবারের ধারণাটি অপেক্ষাকৃত নতুন। তারপরও দৈনন্দিন ব্যবহারে অণু পরিবার, ক্ষুদ্র পরিবার বা দম্পতি-কেন্দ্রিক পরিবারের ধারণা আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত রয়েছে। তবে অঞ্চলভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন নামও প্রচলিত আছে। যেমন: ‘ভিন্ন পরিবার’, ‘ভিন্ন হওয়া’, ‘হাঁড়ি আলাদা’ ও ‘জুদা হওয়া’ প্রভৃতি।