ক্লাসে ফার্স্ট বয় হওয়ার আগের গল্প

এবার কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম। পড়া মুখস্থ করে খাতায় লিখতে লাগলাম। এভাবে কয়েকটা খাতা ক’দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেললাম। কলমও শেষ হলো পাঁচ-ছয়টা। এবার মনে খুশি নেই, কারণ প্রতিবার চেষ্টা করেও ফার্স্ট হতে পারি না।

মুশফিকুর রহমানমুশফিকুর রহমান
Published : 27 Sept 2022, 05:09 AM
Updated : 27 Sept 2022, 05:09 AM

বাহ্। প্রশ্নটা বেশ সহজ তো! - প্রশ্ন হাতে পেয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম। আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। আজ স্কুলে আমার পরীক্ষা।

কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারিনি। প্রতিবারই পরীক্ষা শেষে আনন্দে লাফালাফি করলেও, রেজাল্ট দিলে বাড়িতে বকাঝকা খেতেই হয়। তবে এবার আশায় আছি পরীক্ষায় ফার্স্ট হবোই। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে চিৎকার করে ডাকলাম - আম্মু! আম্মু!

আজ পরীক্ষা কেমন হলো? ঠিক মতো লিখতে পেরেছিস তো? আমাকে দেখেই আম্মু জিজ্ঞেস করল। হ্যাঁ, খুব ভালো দিয়েছি। এবার দেখো, পরীক্ষায় আমিই ফার্স্ট হবো। আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে বললাম।

রেজাল্টেই প্রমাণ। রেজাল্ট দেখলেই বুঝতে পারব, বললো আম্মু। কি বিপদ! এবার খেতে দাও, বিরক্ত হয়ে বললাম।

স্যার খাতা নিয়ে এলেন, তারপর ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড এভাবে বলছেন। কিন্তু আমার নাম নেই।

আম্মু একটু বেশি রাগি। তার কথা হলো সবকিছুর আগে পড়াশোনা এবং পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া। পরীক্ষার ক’দিন আগে থেকে পরীক্ষার দিন সকাল পর্যন্ত পড়া মুখস্থ করে খাতায় বারবার লিখে নিই। তারপরও পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারি না।

অবশেষে আজ ক্লাসে রেজাল্ট দেবে। আমি খুব আনন্দে আছি। কারণ আমি পরীক্ষা খুব ভালো দিয়েছি। মনে মনে বলতে লাগলাম, ফার্স্ট আমিই হবো।

স্যার খাতা নিয়ে এলেন, তারপর ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড এভাবে বলছেন। কিন্তু আমার নাম নেই। সপ্তমে আমার নাম এলো। আমার মুখ শুকিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে কীভাবে মুখ দেখাবো? রেজাল্টের কথা জানতে চাইলে কী বলব? এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভয় আরও বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমি এতো ছোট মানুষ পালিয়ে যাবো কোথায়? রাতে কোথায় থাকবো? আশপাশে মানুষ আলোচনা করছে দিন-দুপুরে নাকি হায়েনা বের হয়। তারপরও বাড়িতে যেতেই হলো।

রেজাল্ট কী? বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই আম্মু কড়াভাবে জিজ্ঞেস করলো।

আমি বিভিন্ন উপায়ে রেজাল্ট লুকোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। শেষ পর্যন্ত রেজাল্ট দেখাতেই হলো। তারপর শুরু হলো বকাবকি, অবহেলা আর কিছু কঠিন শর্ত যুক্ত হলো আমার দৈনন্দিন রুটিনে। এভাবে চলতে থাকলো কিছুদিন। তারপর একটু স্বাভাবিক হলো বাড়ির সবাই। অবশ্য আব্বু আমাকে অতোটা বকাঝকা করে না।

এখনও ভোর হয়নি। ৩-৪ টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই পড়া শুরু করলাম। কারণ সবগুলো বই রিভিশন দিতে হবে যে!

আবার কিছুদিন পর পরীক্ষা। এবার কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম। পড়া মুখস্থ করে খাতায় লিখতে লাগলাম। এভাবে কয়েকটা খাতা ক’দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেললাম। কলমও শেষ হলো পাঁচ-ছয়টা। এবার মনে খুশি নেই, কারণ প্রতিবার চেষ্টা করেও ফার্স্ট হতে পারি না। তবে সবসময়ই আশা করে থাকতাম।

ইশশ! কে রে? ঘুম ভেঙে চেঁচাতে লাগলাম। আম্মু আমার মাথায় চিমটি কাটলো। মাথা ব্যাথা করছে। এবার ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখলাম আমার মাথার কাছে আম্মু দাঁড়িয়ে আছে।

এখনও ভোর হয়নি। ৩-৪ টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই পড়া শুরু করলাম। কারণ সবগুলো বই রিভিশন দিতে হবে যে! খাতায় লিখতেও হবে। আম্মু একটা দাঁড়ি-কমা এদিক-ওদিক হলে আবার লিখিয়ে নেয়। একা একা কাঁদতে থাকি তখন।

সকালে পরীক্ষা দিতে গেলাম। মনের ভেতর কিছুটা ভয় কাজ করছিলো। প্রশ্ন পাওয়ার পর সহজই মনে হলো। পরীক্ষা শেষ হলো। কিন্তু মনে কোনো আনন্দ নেই। শুধু আছে ভয়। কিছুদিন ভয় নিয়েই কেটে গেল।

স্কুলে টিফিন পিরিয়ড চলছে। সবাই ছুটোছুটি করছে। আমি ক্লাসেই বসে আছি।

হঠাৎ চেচামেচি শোনা গেল। সবাই হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢুকছে। একজন বললো, কী হয়েছে? ম্যাডাম আসছেন ক্লাসে, কিছু ছাত্র সমস্বরে বলে উঠলো। আমরা সবাই ঠিকঠাক হয়ে বসে পড়লাম। ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলো। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম।

বসো! বসো! মুচকি হেসে ম্যাডাম বললো। ম্যাডামের হাতভর্তি খাতা দেখে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। খাতাগুলোতে লাল রঙের কালি দিয়ে কাটাকাটি দেখা যাচ্ছিলো। বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে লাগলাম।

বলোতো এবার প্রথম কে হবে? চিৎকার করে ম্যাডাম বললো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাত উঁচু করে সমস্বরে বলে উঠলো, আমি!

স্কুল ছুটির পর আনন্দ নিয়ে বের হচ্ছি। কখন যে আম্মু রেজাল্ট জানতে চাইবে? তখন কী রকম হবে? এসব সাতপাঁচ ভাবছি। তখনই আম্মুর সঙ্গে দেখা।

কেউ আবার দুই হাত তুললো। ম্যাডাম সবার আনন্দ উল্লাস দেখে মুচকি হাসলেন। কিন্তু পুরো ক্লাসে শুধু আমি হাত তুললাম না। যতই সময় বাড়ছে আমার হার্টবিট বাড়ছে। ম্যাডাম চিৎকার করে বললো– প্রথম হয়েছে মুশফিকুর রহমান। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। সবার নজর এখন আমার দিকে। সবাই আমাকে দেখছে।

স্কুল ছুটির পর আনন্দ নিয়ে বের হচ্ছি। কখন যে আম্মু রেজাল্ট জানতে চাইবে? তখন কী রকম হবে? এসব সাতপাঁচ ভাবছি। তখনই আম্মুর সঙ্গে দেখা। রেজাল্ট জিজ্ঞেস করছে না কেন? মনে মনে বলতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে আমিই বললাম, আজ ক্লাসে রেজাল্ট দিয়েছে। আমি বিশতম হয়েছি।

আমার কথা শুনে আম্মু মুচকি হাসলো। বললো, আমি বুঝি জানি না? তখন বুঝলাম আম্মু আগেই জেনে গিয়েছে। আমার ফন্দিটা বুঝতে পেরেছে আম্মু। তারপর বাসায় গিয়ে কত্তকিছু পেলাম। সাইকেল, ব্যাট-বল আরও কত্ত কিছু!

সেই যে ফার্স্ট হলাম, তারপর থেকে প্রতি পরীক্ষায়ই ফার্স্ট হতাম। কিন্তু ফার্স্ট হলেও জীবনের প্রথম, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার স্মৃতিটা এখনও মনে পড়ে। এখনও ম্যাডামের আমার নাম ঘোষণা করার মুহূর্তটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

কিন্তু এখন আমার শৈশবের নানা স্মৃতিজড়িত স্কুলটি আর নেই। স্কুল ভবনটি এখন একটি কোম্পানি কিনে নিয়েছে। অন্যরা তাদের স্মৃতিজড়িত প্রিয় স্কুলে যেতে পারে, বলতে পারে স্কুলটির কথা। কিন্তু আমি যেতে পারি না শৈশবের সেই স্কুলটিতে। কাউকে বলতে পারি না স্কুলটির কথা! এ কষ্ট থেকে যেন আমার মুক্তি নেই!

লেখক: ছাত্র, একাদশ শ্রেণি, নিশিন্দারা ফকির উদ্দিন স্কুল ও কলেজ, বগুড়া

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!