সন্ধ্যায় হারিকেনের আলোয় পড়তে বসার দিনগুলো

আমি প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির দিনেও আমি স্কুলে গিয়েছি। এমনও হয়েছে পুরো স্কুলে আমি, দপ্তরি আর কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া আর কেউ নেই!

শেখ আদনান ফাহাদশেখ আদনান ফাহাদ
Published : 14 Sept 2022, 03:25 PM
Updated : 14 Sept 2022, 03:25 PM

আমার শৈশব-কৈশোরের অবিচ্ছেদ্য অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ‘কালীকচ্ছ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘কালীকচ্ছ পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়’। আমাদের স্কুল ছিল টিনশেড ভবনের। স্কুলে অনেকের পায়ে স্যান্ডেল থাকত, অনেকের থাকত না, বিশেষ করে ছেলেদের। মেয়েরা বরাবরের মতই আমাদের চেয়ে বেশি গোছালো ছিল।

পাকা বারান্দা, সামনে খেলার মাঠ, টিনশেড ভবন, স্যার-ম্যাডামদের বারান্দা দিয়ে হাঁটাচলা, চক-ডাস্টার, চকের গুড়া, কারও কারও হাতে থাকা বেত, স্কুল শেষে দৌড়ে বাসায় ফিরে আসা, বিকেলে আবার স্কুল মাঠে ফিরে যাওয়া এসব মনে পড়ে খুব। স্কুলের বারান্দায় জানালার নিচে তৈরি সিমেন্টের বসার জায়গায় বসে বড়দের ফুটবল খেলা দেখতাম। কখনও কখনও দুই দলের হয়েই ‘দুধভাত’ হিসেবে খেলায় অংশ নিতাম।

পারিবারিক কারণে সম্ভবত স্কুলের তরফ থেকে বৃত্তি পাওয়ার একটা প্রত্যাশা ছিল। কারণ এ স্কুলে আমাদের ছয় ভাই ও তিন বোনের প্রায় সবাই প্রাথমিকের পাঠ শেষ করেছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পর স্কুলের শিক্ষকরা বৃত্তি পাবো এ বিশ্বাসে আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও ‘বিশেষ শ্রেণি’ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। সে সময় যাদেরকে শিক্ষকরা ‘ভালো ছাত্র’ বলে মনে করতেন তাদেরকে তারা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আলাদা করে বেছে নিতেন।

আমার আব্বা ভাষাসংগ্রামী এবং মুজিবনগর সরকারের অধীনে পলিটিক্যাল ইন্সট্রাক্টর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শেখ আবু হামেদ সাহেব ছিলেন আমার প্রধান শিক্ষক। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আব্বা আমাকে সঙ্গে নিয়ে পড়তে এবং পড়াতে বসতেন।

সন্ধ্যার পর হারিকেন আর কুপির আলোয় বাড়তি পড়াশোনা চলছিল আমাদের। শীতে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা হয়েছিল। উপজেলা সদরে আরও অন্যান্য সব স্কুলের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বৃত্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। নিয়মিত খেলাধুলা, দুষ্টুমির পরও শিক্ষকদের নিবিড় পরিচর্যায় এবং পরিবারের সবার, বিশেষ করে আব্বা ও আম্মার যত্নে-আদরে সাধারণ বৃত্তি পেয়ে প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে হাই স্কুলে প্রবেশ ঘটে আমার।

আমার আব্বা ভাষাসংগ্রামী এবং মুজিবনগর সরকারের অধীনে পলিটিক্যাল ইন্সট্রাক্টর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শেখ আবু হামেদ সাহেব ছিলেন আমার প্রধান শিক্ষক। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আব্বা আমাকে সঙ্গে নিয়ে পড়তে এবং পড়াতে বসতেন। ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শেখ আবু হামেদ নিজের সব জ্ঞান ছেলে-মেয়েকে দিতে চাইতেন। আমাদের রচনা, ব্যাখ্যা, উত্তর সব অন্যদের থেকে আলাদা হতো।

হাই স্কুলে প্রতিদিন ক্লাসে পড়া দিতে হতো। খুব কঠিন কিছু না হলে আমি বাড়িতে এসব নিত্যদিনের পড়া মুখস্ত করতে বসতাম না। দুই ক্লাসের মাঝে যে সময় পাওয়া যেত তখনই কবিতা বা লেখক পরিচিতি মুখস্ত করে স্যার-ম্যাডামদের দিয়ে দিতাম, ফলে আমাকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ তারা পেতেন না। আবার সকালে ক্লাস শুরুর আগে ৩০/৪০ মিনিট পাশের মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট খেলার চেষ্টাও চলত।

প্রাইমারি স্কুলের একটা স্মৃতি এখানে উল্লেখ করতে চাই। সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছে আছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি। আমাদের সময়ে ক্যাম্পে বিডিআর-এর ৩২ রাইফেল ব্যাটালিয়ন ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে থাকাতে ব্যাটালিয়ন পরিবারগুলোর সঙ্গে পুরো এলাকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিডিআর সদস্যদের সন্তানরা আমাদের সঙ্গেই পড়ত। কারণ তখনও তাদের জন্য আলাদা স্কুল নির্মাণ করেনি রাইফেলস কর্তৃপক্ষ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে সীমান্তরক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করা বিডিআর সদস্যদের সন্তানরা আমাদের সঙ্গেই প্রাইমারি এবং হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী বলেই হয়তো তাদের সন্তানরা আমাদের চেয়ে অধিক টিপটপ হয়ে স্কুলে আসতো।

স্কুল ফাঁকি দিয়ে অনেক ছেলে এভাবে লুকিয়ে সিনেমা হলে যেত। সকাল থেকে দুপুর, বিকেল কাটিয়ে তবেই বাড়ি ফিরত। পড়ালেখায় খুব খারাপ ফলাফল হতো।

শহুরে ঘরানায় পোশাক পরিধান করে স্কুলে যাওয়ার চর্চা গ্রামের পরিবারগুলোতে তখনও শুরু হয়নি। তবে এলাকার সঙ্গে বলা যায় গলাগলি করেই ৩২ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সদস্য এবং তাদের পরিবার-পরিজন বসবাস করতে আমরা দেখেছি। বিডিআর-এর খেলার মাঠ, মসজিদ সব আমাদের জন্য উন্মুক্ত থাকত। রমজান মাসে বিডিআর-এর মসজিদে নামাজ আদায় করা, কোরআন তিলাওয়াত করা আর ক্যাম্পের ভেতর সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া হতো।

সিনেমা নিয়ে দুই স্কুল জীবনে দুই রকম অভিজ্ঞতা আছে। যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন বড় ভাই, বোন, ভগ্নিপতির সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। আমরা বলতাম ‘বই’ দেখতে যাই। আনোয়ার হোসেন অভিনীত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ দেখতে আমি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কালীকচ্ছ ‘বিনোদন’ সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। তাছাড়া বড় ভগ্নিপতি আর বোনের সঙ্গে দেখেছি ‘শঙ্খমালা’ সিনেমাটি।

তখন একটা সময় ছিল যখন পরিবারের বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই মিলে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা যেত। সিনেমা হলে প্রবেশের আগে একটা গোল বসার ঘর ছিল। শো শুরু হওয়ার আগে নানা বয়সের মানুষ সেখানে অপেক্ষা করত। বড় হতে হতে দেখেছি, সিনেমা হলে যাওয়াটা এলাকার মুরুব্বীরা অপছন্দ করতে শুরু করলেন। এর প্রধান কারণ ছিল অশ্লীল কাটপিস সম্বলিত নিম্নমানের সিনেমা আসতো সিনেমা হলে। এতে করে আমাদেরই অনেক বন্ধু-বান্ধবের স্কুলজীবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছিল। আমার সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া এক বন্ধু পরে আর পড়াশোনাই চালিয়ে যেতে পারেনি, কারণ এই অশ্লীল সিনেমা দেখার একটা নেশা তার ভেতর জন্ম নিয়েছিল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে অনেক ছেলে এভাবে লুকিয়ে সিনেমা হলে যেত। সকাল থেকে দুপুর, বিকেল কাটিয়ে বাড়ি ফিরত। পড়ালেখায় খুব খারাপ ফলাফল হতো।

আমরা যারা ক্লাসের ‘ভালো ছাত্র’ হিসেবে পরিচিত ছিলাম তারা লজ্জায় সিনেমা হলের দিকে যেতাম না। চলচ্চিত্র শিল্পের এ অধঃপতন আমার কৈশোর জীবনকে শ্রীহীন করেছিল। ‘বিনোদন’ সিনেমা হলটি ছিল কালীকচ্ছ পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন। স্কুলটি বর্তমান স্থানে চলে গেলে ফাঁকা ভবনে সিনেমা হল নির্মিত হয় এবং বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর দেখভাল করত। দীর্ঘদিন ধরে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একমাত্র সিনেমা হল হিসেবে কালীকচ্ছ সিনেমা হল টিকে ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি অধুনা ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি) এই ভবনটি ভেঙ্গে ফেলেছে তাদের দাপ্তরিক প্রয়োজনে। পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সিনেমা হল বলে কিছু এখন আছে কি!

খোঁজ নিয়ে জানলাম, জেলার ৯টি উপজেলার সবগুলো সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৫টি সিনেমা হল ছিল। জেলা সদরে ‘রূপশ্রী’, ‘চিত্রালয়’ ও ‘রজনীগন্ধা’ নামে তিনটি, কসবার কুটিতে ‘বসুন্ধরা’ ও ‘অনুরাধা’ নামে দুটি, আখাউড়া পৌরসভা এলাকায় ‘অনুরাগ’ ও ‘মায়াবী’ নামে দুটি, আশুগঞ্জ বন্দরে ‘মেঘনা’ ও বাজারে ‘কোহিনূর’ নামে দুটি, নবীনগর পৌর এলাকায় ‘নবীন’ ও মাজিকাড়া এলাকায় ‘নূপুর’ নামে দুটি, বাঞ্ছারামপুরে ‘সূর্যমুখী’ ও ‘শিল্পী মিলন’ নামে দুটি, বিজয়নগরের চান্দুরায় ‘তিতাস’ নামে একটি সিনেমা হল ছিল। বিডিআর ক্যাম্পের ভেতর ‘বিনোদন’ সিনেমা হলের কথা তো আগেই বলেছি।

তরুণ মৌলভী আসতে শুরু করলেন বিকেলবেলা। বিকেল ছিল শুধু খেলার জন্য। এত প্রিয় বিকেল একজন মৌলভী আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে! এটা মানতেই পারলাম না। আম্মা নুরজাহান বেগমকে বলে হুজুরের সময়টা পাল্টে দিলাম।  

সিনেমা হল ছিল আমাদের শৈশবের অংশ। সেই ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দেখে নবাব সিরাজের দেশপ্রেম আর আবেগ দেখে আমরাও স্বদেশকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ আর মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতা দেখে শিউরে উঠে নিজের মাতৃভূমিকে রক্ষাকল্পে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম। যে শিশু ইতিহাস জানবে না, দেশপ্রেমিক আর বেঈমানের পার্থক্য জানবে না, বড় হয়ে সে দেশ ও সমাজের কোনো কাজে আসবে না। ভাবতে অবাক লাগে, কবি আবদুল কাদির, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, সঙ্গীত তাপসী অন্নপূর্ণা, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস মাখন আর আকবর আলি খানের ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এখন আর কোনো সিনেমা হল নেই। অথচ সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্র আমাদেরকে ভালো মানুষে রূপান্তরিত করতে পারে।  

স্কুলজীবনের একটা পর্যায়ে আরবি ও ধর্মীয় পাঠের জন্য বাসায় মৌলভী (আমরা বলতাম হুজুর) রাখা হলো। তরুণ মৌলভী আসতে শুরু করলেন বিকেলবেলা! বিকেলে মাঠে ফুটবলের শব্দ শুনলে আমার অস্থির লাগতো। তখন আবার ক্রিকেট জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। নারিকেল গাছের ডাল (আমরা বলতাম ডাজ্ঞা) দিয়ে ব্যাট বানিয়ে সুপারিকে বল হিসেবে ব্যবহার করে আমি আর আমার মামাতো ভাই রুহুল বাড়ির উঠোনে ক্রিকেট খেলতাম। বিকেল ছিল শুধু খেলার জন্য। এত প্রিয় বিকেল একজন মৌলভী আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে! এটা মানতেই পারলাম না। আম্মা নুরজাহান বেগমকে বলে হুজুরের সময়টা পাল্টে দিলাম।  

আমি প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির দিনেও আমি হাই স্কুলে গিয়েছি। এমনও হয়েছে পুরো স্কুলে আমি, দপ্তরি আর কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া কেউ নেই! স্কুল আমার ভাল লাগত। আসলে চারপাশের পুরো পরিবেশটাই ছিল আমার স্কুল।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!