বহুকাল পরে, একদিন রাত্তিরে, দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলের একটি ধারা বিলের জলের সঙ্গে গল্প করতে এলো।
Published : 01 Apr 2024, 12:28 PM
অনেক অনেক আগে ছিল একটা গ্রাম। না না, একটা না, একেসঙ্গে জড়াজড়ি করা কয়েকটা গ্রাম। গ্রামজুড়ে ছিল বিল। বিল ভরতি কেবল পানি আর পানি। সেই পানি কখনো শেষ হত না। বিলজুড়ে ছিলো শাপলা ফুলের মাতামাতি।
কত রঙের শাপলা! লাল শাপলা, সাদা শাপলা! নীল শাপলা। পলকাটা বড় পাতার মধ্যে বড় শাপলা! ছোট ছোট গোল পাতাওয়ালা জলবাগানে ছোট ছোট খুকি শাপলা। বিলে ছিল শাপলার ছোটবোন শালুকও। বৃষ্টির ফোঁটার মতো টলটলে পাতা আর নারকেলের শলার মত ডাঁটি। ডাঁটির মাথায় ফুটতো এইটুকুনি তারার মত শালুক ফুল। তার আর এক নাম ছিল চাঁদমালা ফুল। এত এত শাপলার কারণে সেই বিলকে লোকে বলতো শাপলার বিল। শাপলার বিলের জলতলে ছিল পদ্মরাণীর প্রাসাদ।
অনেককাল আগে, শাপলারও আগে, সেই বিলে ফুটতো পদ্ম! পদ্মরাণীর পদ্ম! পাপড়িগুলো পুরো খুললে আলোয় ঝলমল করতো সেই পদ্মফুল। জোছনা পরীদের পাখার পালক দিয়ে যেন বানানো হয়েছে এক একটা পাপড়ি। কারণ বিল জুড়ে পদ্ম ফুটলেই রাত্রিবেলা আকাশ থেকে জোছনার পরীরা নেমে এসে বিলে সাঁতার কাটতো। বড় বড় পদ্মের আড়ালে মুখ লুকিয়ে লুকোচুরি খেলতো। এই খেলা খেলতে যেমন জোছনাপরীরা আনন্দ পেতো তেমনি খুশি হতো পদ্মফুলের দল।
একবার কী কারণে টানা ছয়মাস মেঘে ঢাকা থাকলো আকাশ। সবকিছু ঘুটঘুটে আঁধারে ঢেকে গেল। চাঁদের মহল থেকে জোছনার পরীরা আর নামতে পারলো না পদ্মবিলে। অন্ধকারে ঝিমুতে ঝিমুতে একদিন সব পদ্ম ঝুপুত করে ঘাড় নামিয়ে পানিতে ডুবে গেল। সেই থেকে পদ্মরাণী থাকেন জলতলে প্রাসাদে আর পদ্মডাঁটার মূলের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা শাপলারা উঠে এলো জলের ওপরে।
বহুকাল পরে, একদিন রাত্তিরে, দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলের একটি ধারা বিলের জলের সঙ্গে গল্প করতে এলো। বিলের ওপরে তখন চাঁদের আলোয় নেচে বেড়াচ্ছিল নানা রঙের ঢেউ। ঊর্মি নামের একটা রুপুলি ঢেউকে ঝরনাধারার বড় পছন্দ হলো। কারণ, তার যে একটা নদীপুত্র আছে! পুত্রের নাম জলতরঙ্গ! ওর সাথে দারুণ মানাবে ঊর্মিকে। শাপলাবিল তো ঝরনাধারার প্রস্তাব শুনে মহা খুশি। তারপরেও বললো, একটু ধৈর্য ধর গো! আগে মহারাণীর মতামত নিয়ে আসি।
মহারাণী? সে কে? ও মা, মহারাণী কে জানো না? পদ্মরাণী গো! অনেককাল আগে তো আমি ছিলাম এই পদ্মরাণীরই বিল! পদ্মবিল! কত পদ্ম ফুটতো! তারপর কী এক আলোর আকাল এলো। আঁধারে ডুবে গেল সব। সেই থেকে তো পদ্মরাণী তার মহল নিয়ে ডুব দিয়েছে জলের তলায়। তারপর একসময় শাপলাদের রাজ্যপাট গড়ে উঠলো। জলতলে থাকলে কী হবে, তবুও পদ্মরাণী বিলের সব ফুলের রাণী।
ওদিকে পদ্মরাণী আর শাপলাবিল দুজনেই নীরাজনাকে না দেখে দুঃখে শুকিয়ে যেতে থাকে। কারণ তারা জানে, নীরাজনা এখন মানবকন্যা হিসেবে বড় হলে কী হবে, ও তো আসলে শাপলাবিলের জলপরী, রাজকুমারী শাপলাবতী!
প্রস্তাব শুনে পদ্মরাণী খুব খুশি। বলে, তোমার মেয়ে তো আমারও মেয়ে! ঊর্মির সঙ্গে জলতরঙ্গের বিয়ে হবে না তো কি ইটভাটার বিয়ে হবে? জলদি বিয়ের আয়োজন কর। ব্যাস সাত দিন সাত রাত শাপলা বিলে জলডুবানি খেলা হল, ঢেউদুলুনি নাচ হল। শাপলা কুঁড়িদের পাপড়ি মেলা উৎসব হলো। এইসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে মহা ধুমধাম করে জলতরঙ্গের সঙ্গে ঊর্মির বিয়ে হয়ে গেল!
এখানে একটা কথা আছে। এ হলো ধন্য যুগের গল্প। মানে তখন সব কিছু ছিল সুন্দর। সবাই সুন্দর সুন্দর কাজ করতো আর তা দেখে সবাই ধন্য ধন্য করতো। তাই ধন্য যুগ। তো সেই ধন্য যুগে বিয়ের পরে জলপুত্র জলকন্যারা আর জল থাকতো না, মানুষে রূপান্তরিত হতো! যথাসময়ে ওদের ঘরে এলো এক মেয়ে! জলের মত কোমল তার দেহ। বৃষ্টিজলে ধোয়া স্নিগ্ধ চেহারা। জলে নামলে মেয়েকে আর ওঠানোই যায় না। তা তো হবেই! ও যে শাপলাবিলের ঢেউমেয়ে ঊর্মি আর নদীপুত্র জলতরঙ্গের কন্যা। এই কন্যাটি হল কিনা আবার পাহাড়ছোঁয়া ঝরনাধারার নাতনি! জলের সঙ্গে জল হয়ে মিশে থাকে মেয়ে। কাজেই মেয়ের নাম রাখা হল নীরাজনা! নীর মানে জল, জলেভেজা মেয়ে!
নীরাজনা বড় হতে থাকে। ও ভালোবাসে জল, জলের মাছ, জলপরী আর মৎস্যকন্যা! কাচের পাত্রে রাখা পোষা মাছকে যত্ন করে আধার খাওয়ায় নীরাজনা। রঙতুলি নিয়ে বসলেই আঁকে বর্ষার জল থই থই নদী, জলপরী আর মৎস্যকন্যার ছবি! নীরাজনার কেন যেন মনে হয়, সেও আসলে একজন মৎস্যকন্যা, একজন জলপরী। কীভাবে যেন মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েছে! ও তো জানে না, ওর মা বাবাও যে আসলে জলই! ও হল জলের মেয়ে! জলমহলের রাজকুমারী। একদিন দুদিন করে বছর গড়িয়ে যেতে থাকে।
ওদিকে পদ্মরাণী আর শাপলাবিল দুজনেই নীরাজনাকে না দেখে দুঃখে শুকিয়ে যেতে থাকে। কারণ তারা জানে, নীরাজনা এখন মানবকন্যা হিসেবে বড় হলে কী হবে, ও তো আসলে শাপলাবিলের জলপরী, রাজকুমারী শাপলাবতী! শাপলাবতী যেদিন এসে বিলের জলে হাত ছোঁয়াবে, জল থেকে শাপলা তুলে মালা গেঁথে সাজ করে জলের আয়নায় মুখ দেখবে, সেদিন আবার শাপলাবিল জল থইথই করে উঠবে। ঢেউ দুলিয়ে টলমলে ভঙ্গিমায় নেচে উঠবে। সারা বিল ভরে যাবে শাপলাফুলের হাসিতে। একদিন নীরাজনার দাদি ঝরনাধারার কাছে পদ্মপাতায় চিঠি লিখে পাঠান পদ্মরাণী- নাতনিকে একটিবার দেখিয়ে নিয়ে যাও না গো! নয় বছর পেরিয়ে গেল, একটিবার দেখলাম না! আমরা তো শুকিয়ে মারা পড়লাম!
চিঠি পড়ে ঝরনাধারা ভাবেন, তাইতো! নয়ে না হলে তো নব্বইয়েও হবে না! এ তো গুরুজনেরই কথা! খনার বচন! তা হলে! নাতনিকে তো আনতে হয়! ঝরনাধারা অনেক কষ্টে একটা বড় পাথর ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন। কুলকুল করে জলতরঙ্গের বাড়ির দিকে বয়ে যেতে যেতে নাতনিকে পদ্মবিলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন। নীরাজনার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে পালতোলা ময়ূরপঙ্খি নাওয়ের। কিন্তু ততদিনে বিলের জল অনেক কমে গেছে। তাই আর ময়ূরপঙ্খি নাও পাওয়া গেল না। ময়ূরেরা সব ডানা গুটিয়ে বনের আড়ালে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে ঘাটে যন্ত্রের নৌকা আছে! কিন্তু ওগুলো বড্ড গোলমেলে নাও। কানে তালা লাগানো ভটভটি! ধোঁয়া ছেড়ে আকাশ কালো করে রাখে এই যন্ত্রের নাও।
দাদি বলেন, উপায় তো নেই। কী আর করা! তাই সই, চল! কিছুদূর চালিয়ে জলকুমুদের কুঞ্জে এসে যন্তরের ভটভটি বন্ধ করলেই হবে। তখন শান্ত জলের ওপরে উঠে পদ্মরাণী তার দুটি চোখের কলি মেলে দেবেন জলপরী নাতনিকে দেখার জন্য! নৌকোয় বসে দাদি তক্কে তক্কে থাকলেন। জলকুমুদের ঝোপের কাছে আসতেই বললেন, এখন যন্তরমন্তর বন্ধ করো! ধোঁয়ার নলে ঢাকনা লাগিয়ে দাও। এখানে নৌকা থামাও! ভটভটি বন্ধ হলো। ধোঁয়াও বন্ধ হলো। তখন আকাশ পশ্চিম দিকে একটা নীল পর্দা টাঙিয়ে সেখানে গোধূলির রঙ গুলে ছড়িয়ে দিল। শাপলা বিলের জলে পড়লো সেই রঙভরা পর্দার ছবি।
যেই না ওর হাতের পাতা বিলের জল ছুঁয়ে দেয় অমনি কুলকুল করে টলমলে পানিতে ভরে যায় পদ্মবিল। মনের দুঃখে মাথা নুইয়ে রাখা শাপলাকলিগুলো সব ফুটে ওঠে।
নলখাগড়ার বনের মধ্যে টুইট টুইট করে ডেকে উঠলো লেজ ঝোলা ফিঙে। সোনার লকেটের মতো কয়েকটা ছোট্ট সোনাব্যাঙ টুপুস টুপুস করে লাফ দিয়ে কচুরিপাতার ওপরে উঠে বসে হা করে আকাশের রঙ খেলা দেখতে লাগলো। চারপাশের সবকিছু অপূর্ব সুন্দর হয়ে উঠলো। ঝরনাধারা একটা শাপলা টেনে তোলেন। তারপর সেটা দিয়ে দ্রুত হাতে মালা বানাতে থাকেন। নীরাজনা তখন একমনে বিলের জলে ফিঙে, ফড়িং, গুগলি আর ব্যাঙাচির খেলা দেখছিল। হঠাৎ একটা পুচকে সাপও জলের ওপরে ভেসে উঠলো। তারপর ওটা ঢেউয়ের মত কোমর বাঁকিয়ে নাচতে শুরু করে।
নীরাজনা চেঁচিয়ে ওঠে, দাদি, দেখো, সাপ! ও ঘাড় ফেরাতেই দেখে দাদির হাতে শাপলা। মুটুস মুটুস করে শাপলার ডগা ভেঙে ভেঙে মালা বানাচ্ছেন! দাদির ততক্ষণে মালা বানানো শেষ। নীরাজনাকে কাছে ডেকে যত্ন করে পরিয়ে দেন মাথায়! কী সুন্দর দেখাচ্ছে! যেন এক রাজকন্যা! বাহ, কী সুন্দর আমার নাতনি। ঠিক যেন জলমহলের রাজকুমারী! ঝরনাধারা মুগ্ধ চোখে নীরাজনাকে দেখেন। নীরাজনা খুব খুশি! বলে, আমিও মালা বানাতে চাই! দাদির কাছ থেকে দ্রুত শিখে নেয় মালা বানানোর কায়দাকানুন। তারপর মনোযোগ দিয়ে নিজেই মালা বানাতে থাকে। একটুক্ষণের মধ্যেই দিব্যি বানিয়ে ফেলে মাথার টায়রা, কানের দুল গলার মালা আর কোমরের মেখলা! আরও লাগবে হাতের কাঁকন আর বাজুবন্দ! এসব বানাতে শাপলার ডাঁটা লাগবে আরও!
যত্ন করে গহনা বানাতে থাকে ও। এক এক করে সব গহনা বানিয়ে নীরাজনা সাজ করে! আনন্দে বাতাসে উড়তে থাকে রেশমের মত নরম চুল। নেচে ওঠে ওর সারা দেহ! নীরাজনা নাচের মুদ্রা তুলে নৌকোর একপাশে দাঁড়ায়। সজ্জিত নীরাজনাকে দেখে হাততালি দিয়ে ওঠে বিলের জল। হেসে ওঠে গোধূলির রঙমাখা ঢেউ। নীরাজনা তখন বাবার পাশে দাঁড়িয়ে জল দেখছিল। বাবাও মুগ্ধ চোখে দেখেন মেয়েকে! সেই মুহূর্তে কুমুদঝোপের পাশ থেকে কে যেন মুগ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, জলপরী নীরাজনা! রাজকুমারী শাপলাবতী! নীরাজনা অবাক হয়ে বলে, কে কথা বলে বাবা? বাবা সেদিকে একঝলক চেয়ে বলে, ফুলের কলিরা কথা বলছে মা! তাই? আমাকে বলছে?
হ্যাঁ, তুমি তো জলপরী নীরাজনা! আর আজকে শাপলার রাজ্যে এসে শাপলা ফুলে সেজেছো, তাই রাজকুমারী শাপলাবতী! দাদি শুধু মুচকি হাসেন। কারণ তিনি জানেন, নীরাজনা আসলে কে! আর কে-ই বা তাকে ডাকছে! শাপলাবতী তখন নৌকোর বাতায় বসে গভীর মনোযোগে চেয়ে আছে জলের দিকে। আর একটু দূরেই দুটো পদ্মকলি জলের ওপরে আস্তে করে পাপড়ি মেলে দেয়! পদ্মরাণী চেয়ে চেয়ে দেখেন শাপলাবতীকে! কী সুন্দর! নীরাজনা হাত বাড়ায়। কী সুন্দর দুটি কলি! আমি ধরবো।
যেই না ওর হাতের পাতা বিলের জল ছুঁয়ে দেয় অমনি কুলকুল করে টলমলে পানিতে ভরে যায় পদ্মবিল। মনের দুঃখে মাথা নুইয়ে রাখা শাপলাকলিগুলো সব ফুটে ওঠে। ফুরফুরে প্রজাপতির মত ওদের পাপড়ির পাখনাগুলো কাঁপতে থাকে। নীরাজনা হাততালি দেয়, বাবা দেখ কত শাপলা! কী সুন্দর! বাবা হেসে বলেন, তুমিও তো একটা শাপলা মা। দাদি বলেন, তুমি হলে রাজকুমারী শাপলাবতী!