স্টিফেন হকিং, আবদুস সালাম যাকে শ্রদ্ধা করতেন– আমাদের সেই বিজ্ঞানী!
Published : 27 Feb 2025, 02:06 PM
ব্ল্যাকহোল ও কোয়ান্টাম মহাকর্ষের জন্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আজ পরিচিত একটি নাম। তিনি আমাদের দেশের যে বিজ্ঞানীর বন্ধু ছিলেন, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একই রুমে থাকতেন, তিনি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম। হকিং বলেছেন, “আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।”
১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত হকিং যে-সব বিজ্ঞানী নিয়ে গবেষণা করেছেন, এর মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। তার ‘কৃষ্ণবিবর’ বইটি স্টিফেন হকিংয়ের ‘ব্ল্যাকহোল থিওরি’র অনেক আগেই লেখা এবং তখন থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। তিনি ১৯৮৩ সালে ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লিখেছেন। স্টিফেন হকিং ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লিখেছেন ১৯৮৮ সালে। গুরুত্বের বিবেচনায় গবেষকরা জামাল নজরুল ইসলামের বইটিকে এগিয়ে রেখেছেন। যদিও হকিং-এর বইটি বেশি প্রচার পায়।
জামাল নজরুল ইসলাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. আবদুস সালামেরও বন্ধু ছিলেন। অধ্যাপক সালাম একবার ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বিমান থেকে নেমেই প্রথম খোঁজ করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলামকে। আবদুস সালাম বলেছেন, “এশিয়ায় আমার পরে পদার্থবিজ্ঞানে আর কেউ যদি নোবেল পুরস্কার পায়, তবে তা পাবেন অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম”।
একই ধরনের কথা বলেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন, “পাশ্চাত্যে বসবাস না করার কারণে অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম নোবেল পুরস্কার পাননি”। জামাল নজরুল ইসলাম নোবেল পুরস্কার না পেলেও দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার সহপাঠী ও বন্ধু তালিকায় আরও ছিলেন ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকার, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়েন জোসেফসন ও রিচার্ড ফাইনম্যান প্রমুখ। তিনি দেশ-বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান-গবেষণাগারের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।
খ্যাতিমান এ বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এদেশের মানুষ জানে অল্পই। আরও কম জানে নতুন প্রজন্ম। অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কাজের সূত্রে কলকাতায় বসবাসের সময়ে সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর চট্টগ্রাম এসে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দেন। শিক্ষকরা তাকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির অনুমতি দেন। তখন থেকে জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামের হয়ে গেলেন।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে জামাল নজরুল ইসলাম নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পিতা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। পিতার চাকরির বদলির কারণে তাকে যেতে হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। ওখানে তিনি মুরি লরেন্স কলেজ থেকে ও লেবেল, এ লেবেল পাশ করেন। এখান থেকে তিনি চলে যান কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এখানে বিএসসি অনার্স পাশ করেন। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই জামাল নজরুল ইসলাম একে একে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ও এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি পান। পশ্চিম পাকিস্তানে মুরি লরেন্স কলেজ পড়ার সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি নিজে নিজে অনেক অঙ্কের সমাধান করতেন। বিভিন্ন বই থেকে জটিল অঙ্ক সংগ্রহ করতেন, যা পরে তার অনেক কাজে আসে।
তার সময়ে তিনি একাই গণিত বিষয়ে পড়েছিলেন। বিষয় হিসেবে গণিত অন্য অনেকের কাছে ‘তুলনামূলক জটিল’ হওয়াতে কেউ নিতে চাইত না। জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের কঠিনসব সমস্যা সমাধানের সময়ে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতেন না। এ অভ্যাস তার আমৃত্যু ছিল। এমন কি তিনি কম্পিউটার, ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে চাইতেন না। তার মতে- ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষের চিন্তার জগতকে সংকুচিত করে দেয়। কারণ এসব যে কোনো সমস্যার সহজ সমাধান করে দেয়।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে শিক্ষকতা করে ৩০ বছরের পাশ্চাত্য জীবন ছেড়ে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুই হাজার আটশ টাকা বেতনে গণিত বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন।
শোনা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ পরিমাণ বেতন দিতেও সেদিন গড়িমসি করেছিল। অথচ তখন তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সোয়া লক্ষ টাকা বেতনে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জামাল নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “আমি চট্টগ্রামের সন্তান। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছি।”
জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স’ (আরসিএমপিএস)। এই আধুনিক গবেষণাগারটি তার জীবনের অন্যতম কীর্তি হিসেবে নন্দিত। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষার্থী আপেক্ষিকা তত্ত্ব, বিশ্ব সৃষ্টিরতত্ত্বসহ নানা বিষয়ে গবেষণার জন্য আসেন। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামসহ নানা আলোচনায় অংশ নেন।
যেহেতু জামাল নজরুল ইসলাম কম্পিউটার বা ক্যালকুলেটর ব্যবহারে উৎসাহী ছিলেন না, ফলে তার অফিসরুমে চারপাশে কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। একদিন দেখা গেল ওখানে ইঁদুরের উৎপাত হয়েছে। ইঁদুরগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ কেটে সর্বনাশ করে দিচ্ছিল। তার সহকারী এতে বিরক্ত হয়ে ইঁদুর মারার ওষুধ দিতে চাইল। জামাল নজরুল ইসলাম তাকে বাধা দিয়ে এক প্যাকেট বিস্কুট আনলেন। তিনি যাওয়ার সময় কাগজপত্রের পাশে সে বিস্কুট রেখে যেতেন। দেখা গেল, ইঁদুরগুলো আর কাগজ কাটে না। তারা বিস্কুট খেয়ে চলে যায়।
জামাল নজরুল ইসলামের উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো: ‘দ্য আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ (১৯৮৩), ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’ (১৯৮৪), ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ (১৯৮৪), ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’ (১৯৯২), ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ ও ‘ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স’। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
জামাল নজরুল ইসলামের বাংলা ভাষায়ও তিনটি বই রয়েছে। এগুলো হলো: বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কৃষ্ণবিবর’, ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’ এবং ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’। এসব বইয়ে তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “অনেকের ধারণা, ভালো ইংরেজি না জানলে বিজ্ঞানচর্চা করা যাবে না। এটা ভুল ধারণা। মাতৃভাষাও ভালো বিজ্ঞানচর্চা ও উচ্চতর গবেষণা হতে পারে... বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাটা গুরুত্বপূর্ণ।”
২০০১ সালে একবার দুনিয়া জুড়ে একটা খবর প্রচারিত হয়েছিল। খবরটি হলো- ‘পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে’। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম এ খবরটিকে ভুল বলে প্রমাণ করে দিলেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হিসাব কষে বুঝিয়ে দিলেন এসময় পৃথিবী কোনোভাবেই ধ্বংস হবে না। সৌরজগতের সব গ্রহ-উপগ্রহ প্রাকৃতিক নিয়মে একই সরলরেখা বরাবর চলে আসলেও পৃথিবীর কোনো ধরনের সমস্যা হতে পারে না।
২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে খ্যাতিমান এ বিজ্ঞানী মারা যান।
তথ্যসূত্র:
১. বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম, অনুপম প্রকাশনী, শরীফ মাহমুদ ছিদ্দিকী
২. স্টিভেন হকিং-এর দীপাগার: বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম, পুঁথিনিলয়, ড. মোহাম্মদ আমীন
৩. বিশ্ব বরেণ্য ভৌতবিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম, গ্রন্থ কুটির, রাশেদ রউফ
৪. ড. জামাল নজরুল ইসলাম: বটবৃক্ষের ছায়ায়, বিদ্যুৎ কুমার দাশ।