তার লেখার টেবিলের এক পাশে কাস্তে ও করাত রাখা থাকত। মেঝেতে পড়ে থাকত মুচির সরঞ্জামের বাক্স।
Published : 23 Mar 2025, 12:43 AM
লিও তলস্তয় তার উপন্যাস ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ লেখা শুরু করেছিলেন প্রায় ১৬৫ বছর আগে। তাকে ঊনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক মনে করা হয়। তিনি ছিলেন একজন সামাজিক বিপ্লবী ও রাজনৈতিক চিন্তক। ১৮২৮ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ জীবনে, তলস্তয় ধীরে ধীরে তার আভিজাত্য ও প্রচলিত বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রথাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিগত পরিবর্তনের এই পথ অনুসরণ করলে, আজকের দিনে আমাদের জীবন-যাপন কেমন হওয়া উচিত তা সম্পর্কে কিছু মূল্যবান এবং আশ্চর্যজনক পাঠ পাওয়া যায়।
তলস্তয় রুশ উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পরিবারের জমিদারি ছিল, আর ছিল শত শত দাসী। তরুণ কাউন্টের প্রাথমিক জীবন ছিল বেপরোয়া ও বিলাসী, পেটি তাস খেলে তার সমস্ত সম্পদ হারিয়েছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনী ‘অ্যা কনফেশন’-এ স্বীকার করেছেন—
“আমি যুদ্ধে মানুষ হত্যা করেছি এবং তাদেরকে হত্যা করতে দু’বার চ্যালেঞ্জ করেছি আমার সঙ্গে দ্বৈত লড়াইয়ে নামতে। আমি তাসে হেরে গেছি, কৃষকদের পরিশ্রম ভোগ করেছি, শাস্তি দিয়েছি, অশ্লীলভাবে জীবনযাপন করেছি এবং মানুষের সাথে প্রতারণা করেছি। মিথ্যা বলা, চুরি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মদ্যপান, সহিংসতা, হত্যা- এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা আমি করিনি, অথচ তবুও মানুষ আমার আচরণকে প্রশংসা করেছিল এবং আমার সমসাময়িকরা আমাকে তুলনামূলক নৈতিক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত। এভাবে আমি দশ বছর জীবনযাপন করেছি।”
তলস্তয় কীভাবে এই বিলাসী ও বেপরোয়া জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন? তার জীবনযাত্রা কীভাবে আমাদের নিজেদের জীবন দর্শন পুনর্বিবেচনা করতে সাহায্য করতে পারে?
পাঠ ১: মনের দরজা খোলা রাখা
তলস্তয় এক জায়গায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন, অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের মতামত পরিবর্তন করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা। এটি তিনি শুরু করেন ১৮৫০-এর দশকে যখন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ক্রিমিয়ান যুদ্ধে সেবাস্তোপোলের রক্তাক্ত অবরোধে তিনি অংশ নেন, এটি তাকে একজন সাধারণ সৈন্য থেকে একজন অহিংসাবাদী (প্যাসিফিস্ট) বানিয়ে তোলে। ১৮৫৭ সালে প্যারিসে জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ দেখার পর তিনি যা অনুভব করেছিলেন, তা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি তার মধ্যে রাষ্ট্র এবং তার আইনের প্রতি ঘৃণা তৈরি করে। তলস্তয় মনে করেছিলেন এটি কেবল ধনী ও শক্তিশালী শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় কাজ করে।
তিনি তার এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, “সত্যি কথা হল, রাষ্ট্র একটি ষড়যন্ত্র। এটি শুধু শোষণ নয়, তার নাগরিকদের পচনও ঘটায়...এখন থেকে আমি কোথাও কোনো সরকারি চাকরি করব না।” তলস্তয় এক ধরনের নৈরাজ্যবাদীতে (এনার্কিস্ট) পরিণত হচ্ছিলেন। তার সমালোচনা এত তীব্র ছিল যে, শুধু তার সাহিত্যিক খ্যাতির জন্য তাকে কারাদণ্ড থেকে বাঁচানো হয়েছিল। তলস্তয় আমাদের প্রথমেই উৎসাহিত করেন যে, আমাদের যা কিছু প্রথাগত বিশ্বাস আছে, সেগুলোকে বারবার প্রশ্ন করা উচিত।
পাঠ ২: সহানুভূতির চর্চা
তলস্তয় ছিলেন ঊনবিংশ শতকের অন্যতম সহানুভূতি অন্বেষী, তিনি এমন মানুষের সঙ্গে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন যাদের জীবন তার নিজের জীবন থেকে ভিন্ন ছিল। ১৮৬১ সালে কৃষক মুক্তির পর এবং রাশিয়ায় কৃষক শ্রেণির গুণাবলী প্রচারকারী আন্দোলনের প্রভাবিত হয়ে, তলস্তয় শুধু কৃষকের ঐতিহ্যবাহী পোশাকই গ্রহণ করেননি, তিনি নিজেও নিজের জমিদারিতে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন, মাঠ চাষ করেন এবং তাদের ঘর মেরামত করেন।
এমনটি একজন অভিজাতের জন্য অস্বাভাবিক ছিল, যদিও এতে কিছুটা পিতৃতান্ত্রিকতা ছিল। তলস্তয় কৃষকদের সঙ্গে সময় কাটানো উপভোগ করতেন এবং শহরের সাহিত্যিক ও অভিজাত শ্রেণি থেকে দূরে থাকতে শুরু করেন। রুশো ও প্রুদোর স্বাধীনতা ও সমতার ধারণাকে ভিত্তি করে তিনি কৃষক শিশুদের জন্য একটি পরীক্ষামূলক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি নিজেও সেখানের পাঠদান করতেন। কৃষকদের জীবন বুঝতে হলে তারই মধ্যে বাস করতে হবে, এমন বিশ্বাসে অটল ছিলেন তলস্তয়।
পাঠ ৩: পার্থক্য তৈরি করা
একজন অভিজাত সাহিত্যিক হিসেবে, তলস্তয় অন্যান্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু নজির রাখেন। ১৮৭৩ সালে শস্যের আকাল পরবর্তী সময়ে, তিনি ‘আন্না কারেনিনা’ লেখার কাজ এক বছর বন্ধ রাখেন এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্য করার উদ্যোগ নেন। তিনি তার এক আত্মীয়কে বলেছিলেন, “আমি জীবন্ত মানুষের থেকে বিমুখ হয়ে কাল্পনিক চরিত্রের জন্য চিন্তা করতে পারি না।”
তার বন্ধুবান্ধব ও পরিবার সদস্যরা ভাবছিলেন যে, পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক তার সৃষ্টি বন্ধ করে দানশীল কাজ করবে, খুব অদ্ভুত! কিন্তু তলস্তয় দৃঢ় ছিলেন। তিনি একই কাজ আবার ১৮৯১ সালের দুর্ভিক্ষের পরও করেছিলেন এবং অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ কাজ করেন। আমরা কি কল্পনা করতে পারি, আজকের কোনো বিখ্যাত লেখক তার লেখালেখি ছেড়ে দুই বছর মানবিক সহায়তার কাজে ব্যস্ত থাকবেন?
পাঠ ৪: সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ততা
তলস্তয়ের অভ্যাস ছিল জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন করা। তিনি কখনোই থেমে থাকেননি কেন ও কীভাবে তাকে জীবনযাপন করা উচিত, অর্থ ও খ্যাতির কী প্রয়োজন ছিল। ১৮৭০-এর দশকে, যখন তিনি এর কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন এবং আত্মহত্যার পথে চলে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ার, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও বাইবেল পড়ে বিপ্লবী খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, যা সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, এমনকি তিনি যে গোঁড়া (অর্থোডক্স) গির্জায় বেড়ে উঠেছিলেন, তার বিরোধিতা করেছিল।
তিনি আধ্যাত্মিক ও সরল জীবনযাপন গ্রহণ করেন, মদ্যপান ও ধূমপান ছেড়ে দেন এবং শাকাহারি হয়ে ওঠেন। এছাড়া তিনি ‘তলস্তয়ান’ নামে এক ধরনের সাদাসিধে, স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপন করা ইউটোপীয় সম্প্রদায় তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এই সম্প্রদায়গুলো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং মহাত্মা গান্ধী ১৯১০ সালে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ছিল ‘তলস্তয় ফার্ম’।
পাঠ ৫: দ্বন্দ্বে সতর্ক থাকা
তলস্তয়ের নতুন জীবন অবশ্যই সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল। একদিকে তিনি সার্বজনীন ভালোবাসার কথা বলতেন, কিন্তু অন্যদিকে তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করতেন। সমতার প্রচারক হিসেবে, তিনি কখনোই সম্পূর্ণভাবে তার সম্পদ ও অভিজাত জীবনধারা ছাড়তে পারেননি। তিনি তার প্রাসাদে, কর্মচারীদের সঙ্গে থাকতেন। যখন তিনি তার জমিদারি কৃষকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তার স্ত্রী ও সন্তানরা রেগে গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পিছিয়ে যান।
তবে ১৮৯০-এর দশকে তিনি তার লেখার বেশকিছু কপিরাইট ছেড়ে দেন, এর মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ত্যাগ করেন। শেষ বছরগুলোতে, যখন লেখক ও সাংবাদিকরা তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন, তারা প্রায়ই চমকে যেতেন যে, বিশ্বের একজন বিখ্যাত লেখক শ্রমিকদের সঙ্গে কাঠ কাটছেন বা নিজের জুতো নিজেই তৈরি করছেন।
পাঠ ৬: সামাজিক পরিসর বাড়ানো
আমাদের ধারণা ও চিন্তাকে প্রতিনিয়ত আমাদেরই চ্যালেঞ্জ করা উচিত। পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো যাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনযাপন আমাদের থেকে ভিন্ন। তলস্তয় এজন্য মস্কোতে সামাজিকীকরণের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছিলেন কৃষকদের সঙ্গে।
‘রিজারেকশন’ উপন্যাসে তলস্তয় উল্লেখ করেন যে অধিকাংশ মানুষ— তা তারা ধনী ব্যবসায়ী হোক, ক্ষমতাধর রাজনীতিক হোক বা সাধারণ চোর— নিজেদের বিশ্বাস ও জীবনযাপনকে ন্যায়সংগত এবং প্রশংসনীয় বলে মনে করে। তিনি লিখেছেন, “নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি টিকিয়ে রাখতে, এসব মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের মতো একই বিশ্বাস ও জীবনধারা অনুসরণকারী মানুষের সঙ্গেই মিশে থাকে এবং নিজেদের অবস্থানকে সঠিক বলে মনে করে।”
যদি আমরা আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শকে প্রশ্ন করতে চাই, তবে তলস্তয়ের পথ অনুসরণ করা জরুরি— অর্থাৎ, এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো, যাদের মূল্যবোধ ও দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা আমাদের থেকে ভিন্ন। আমাদের কাজ হলো পরিচিত গণ্ডির সীমা অতিক্রম করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান করা।
এই নিবন্ধটি মূলত পাওয়েলস ডটকম (Powells.com)-এ প্রকাশিত হয়েছিল এবং লেখক রোমান ক্রজনারিকের অনুমতিক্রমে এখানে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশিত হলো। রোমান ক্রজনারিক একজন অস্ট্রেলিয়ান সাংস্কৃতিক চিন্তাবিদ এবং লন্ডনের দ্য স্কুল অব লাইফ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই নিবন্ধটি তার বই ‘হাউ শুড উই লিভ? গ্রেট আইডিয়াজ ফ্রম দ্য পাস্ট ফর এভরিডে লাইফ’ থেকে নেওয়া হয়েছে।