শামীমার বাবা অসুখে ভুগছেন অনেকদিন ধরে। তাই সংসারের কিছুটা ভার তার ছোট্ট কাঁধেও এসে পড়েছে।
Published : 27 Sep 2024, 03:50 PM
এক পশলা বৃষ্টি, এক চিলতে রোদ। ভোরের শিশির বিন্দু, কাশফুলের স্নিগ্ধ ছোঁয়া জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে এখন বাংলা মাসের আশ্বিন! তবুও মাঝে মধ্যে দুষ্টু মেঘের দল একত্রিত হয়ে বৃষ্টি নামায় আকাশজুড়ে।
পরক্ষণে কাঠফাটা রোদ ভিন্ন সুরে বলে বেড়ায় আমি এখনও আছি! ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা পেরিয়ে বারোটার ঘরে। রোদবৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় তখন বৃষ্টি থেমে গিয়ে সোনালি রোদ চিকচিক করছে।
বিশ্বের বৃহত্তম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত তখন লোকে লোকারণ্য এমনটি বলা যাবে না। ভ্যাপসা গরমে মুষ্টিমেয় ভ্রমণপিপাসু নিজেদের মতো সময় কাটাতে ব্যস্ত সৈকত ঘেঁষা ঝাউবনে। আবার অনেকে রোদ থেকে পালাতে মেতে উঠেছেন সমুদ্রস্নানে।
আমিও অসময়ের রোদ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ঝাউবনের ছায়াতল দিয়ে হাঁটছি। চলতি পথে পেছন থেকে একটা সরু কণ্ঠের মিনতি শুনে থমকে দাঁড়ালাম।
ফিরে দেখি বছর দশের একটা মেয়ে। মাথায় কয়েকটা পানির বোতলসহ আমার দিকে এগিয়ে আসছে সে। হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো, ‘ভাইয়া, পানি লাগবে, পানি?’
‘একটা বোতল মাত্র বিশ টাকা। আর মাত্র তিন চারটে পানির বোতল আছে।’
আমিও হাসিমুখে মুহূর্তে পকেট থেকে একটা বিশ টাকার নোট নিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, ‘দাও, আমাকে একটা পানির বোতল।’
পানির বোতল বিক্রির ফাঁকে সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট দশেক কথা হয় তার সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারলাম ছোট্ট মানুষটির নাম শামীমা। বাড়ি কক্সবাজার সৈকতের পাশে। তিন বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়।
শামীমার বাবা অসুখে ভুগছেন অনেকদিন ধরে। বাবা যখন সুস্থ ছিল তখন বাবার রোজগারেই চলতো তাদের পরিবার। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পর তাদের পরিবারে ভর করে বসে এক অনিশ্চয়তা। তাই সংসারের কিছুটা ভার তার ছোট্ট কাঁধেও এসে পড়েছে।
সেই ভার লাঘব করতে সৈকতে সকালবেলা পানির বোতল মাথায় করে নেমে পড়ে শামীমা। দুপুর পর্যন্ত সৈকতে ঘুরে ঘুরে দুই-আড়াইশো টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে। তারপর বাসায় ফিরে গিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলবেলা আবারও সৈকতে নেমে পড়ে সে।
তখন অবশ্য পানির বোতল নয়। পুঁতি আর ঝিনুকের তৈরি হরেক রকমের গহনা থাকে হাতে। চকচকে ঝিনুক পুঁতির গহনা নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈকতের এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়া শামীমা। দূরদুরান্ত থেকে সৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটকরা সেসব গহনা নেড়েচেড়ে দেখেন। ইচ্ছে হলে কিনে নেন দুয়েকটা গহনা।
এভাবে চলে শামীমার বেচা বিক্রি। প্রতিদিন ঝিনুক পুঁতির এসব গহনা বিক্রিও হয় দু-তিনশো টাকার মতো। দিনশেষে শামীমা সব টাকা তুলে দেয় মায়ের হাতে।
কথার ফাঁকে শামীমার কাছে তার পড়াশোনার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। লাজুক হাসি দিয়ে জানালো, স্থানীয় এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে সে। তবে কোন শ্রেণিতে পড়ে তা বলতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ সে একটু ইতিউতি করে উত্তর দিলো, ‘জানি না।’
শামীমার মুখ থেকে বের হওয়া ‘জানি না’ কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ধরা দিল আমার কাছে। যাদের একবেলা খাবার জোগাড় করতে অতিক্রম করতে হয় পাহাড় সমান অনিশ্চয়তা, সেখানে শামীমাদের কাছে বড় হয়ে কিছু হতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখা অলীক কল্পনা ছাড়া অন্যকিছু নয়।
দেখতে দেখতে মিনিট দশের মধ্যে শামীমার অবশিষ্ট পানির বোতলগুলোও বিক্রি হয়ে গেল। সেই খুশিতে শামীমাকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। ‘ভাইয়া, অ্যাঁই য্যারগই’, (ভাইয়া, আমি চলে যাচ্ছি) বলে শামীমা পা বাড়ালো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হবে। জনাকীর্ণ হয়ে উঠবে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। সেই বিকেলে চকচকে ঝিনুক পুঁতির মালা নিয়ে শামীমা হয়তো আবারও নেমে পড়বে সৈকতে। হাজারো মানুষের ভিড়ে ছোট্ট মানুষটি গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করবে নিজের শৈশবের সোনালি স্বপ্নগুলো। আমিও শামীমাকে ‘ভালো থেকো’ বলে বিদায় জানালাম।