হিস্পানিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও জাতীয়তাবাদী কবি হোসে মার্তি (১৮৫৩-১৮৯৫)।
Published : 12 Mar 2025, 02:50 AM
হোসে মার্তি হিস্পানিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন একজন কিউবান জাতীয়তাবাদী, কবি, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, অনুবাদক ও অধ্যাপক। ১৮৫৩ সালে কিউবার হাভানায় জন্ম নেন হোসে মার্তি। কিশোর বয়সে ‘টেন ইয়ার ওয়ার’ বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জানানোয় তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি স্পেনে যান, যেখানে তিনি আইন ও দর্শনে ডিগ্রি অর্জন করেন, তারপর কিউবায় ফিরে আসেন। কিন্তু কিউবার স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে তাকে আবার নির্বাসনে পাঠানো হয়। তিনি প্যারিস ও ভেনিজুয়েলা ভ্রমণ করেন এবং অবশেষে ১৮৮১ সালে নিউ ইয়র্কে বসবাস শুরু করেন, যেখানে তিনি লেখক ও শিক্ষক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
১৮৯২ সালে মার্তি সম্পূর্ণভাবে কিউবার তৃতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পনা ও সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কিউবান বিপ্লবী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ সালে এক যুদ্ধে মার্তি নিহত হন। কিউবায় তাকে ‘কিউবান বিপ্লবের পিতা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘নেনে ত্রাভিয়েসা’ শিরোনামে হোসে মার্তির এ গল্পটি মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এলিনর র্যান্ডাল। সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হলো।
এটি কি কেউ জানে, নেনে নামে আরেকটা ছোট মেয়ে আছে কি না! এক বুদ্ধিমান বুড়ো বলেছেন, সব ছোট মেয়েরাই নেনের মতো হয়। নেনে ঘর বা দোকান বানিয়ে খেলে, পুতুল দিয়ে মিষ্টি বানাতে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু শিক্ষক যখন তাকে পড়াতে আসে তখন তার ভালো লাগে না।
নেনের মা নেই, মারা গেছেন। নেনের একজন গৃহশিক্ষক আছেন। মিষ্টি বানানোই নেনের সবচেয়ে পছন্দের কাজ। কেন পছন্দ? কে জানে! হয়তো এই কারণে যে মিষ্টি বানানোর খেলায় তাকে সত্যিকার চিনি দিতে হয়। অবশ্য প্রথমবার মিষ্টি কখনো ভালো হয় না— খুব কঠিন— তাকে প্রায়ই দুইবার চিনি চেয়ে নিতে হয়।
সবাই জানে, নেনে কখনো তার ছোট বন্ধুদের কাজ করিয়ে কষ্ট দিতে পছন্দ করে না। যখন সে হাঁটাহাঁটি, কেনাকাটা বা ভ্রমণ করতে যায়, তখন সে সবসময় তাদের ডাকে। কিন্তু যখন সে মিষ্টি বানাতে যায়, তখন কখনোই ডাকে না।
একবার, খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলো নেনের সঙ্গে। সে তার বাবার কাছ থেকে দুই পয়সা চেয়েছিল নতুন পেনসিল কেনার জন্য। কিন্তু দোকানে যাওয়ার পথে সে পেনসিলের কথা ভুলে গিয়েছিল, সে কিনেছিল একটি স্ট্রবেরি কেক। তার ছোট বন্ধুদের অবশ্য এটি জানাই ছিল, তাই তারা তখন থেকে তাকে নেনে না বলে ‘স্ট্রবেরি কেক’ নামে ডাকতে শুরু করলো।
নেনের বাবা তাকে খুব ভালোবাসতেন। যদি তিনি সকালে তার ছোট মেয়ে নেনেকে না দেখতেন, তাহলে তার কাজ ভালো হতো না। তিনি তাকে ‘ছোট মেয়ে’ বলে ডাকতেন, নেনে নয়। যখন তার বাবা কাজ থেকে ফিরতেন, তখন নেনে সবসময় তার কাছে চলে যেত এবং তার বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করত, যেমন ছোট পাখি তার ডানা মেলে উড়তে চায়।
তারপর নেনের বাবা তাকে মাটি থেকে তুলে নিতেন যেমন একটা গোলাপ ফুল গোলাপ গাছ থেকে তুলেন। নেনে চোখে স্নেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত যেন কিছু জানতে চায়, আর বাবা তাকে দুঃখ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন যেন কান্না করতে চান। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ খুশি হয়ে যেতেন, নেনেকে নিজের কাঁধে তুলে নিতেন, এবং তারা দুজন বাড়ির দিকে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে চলে যেত।
নেনের বাবা সবসময় কিছু নতুন বই নিয়ে আসতেন এবং তাকে দেখাতেন, এতে ছবির কোনো বই অবশ্যই থাকত। নেনে এমনকিছু বই পছন্দ করত যাতে তারাদের ছবি আঁকা থাকত, প্রতিটি তারার নিজস্ব নাম ও রঙ আছে। লাল তারা, হলুদ তারা এবং নীল তারা— প্রত্যেকটির নাম ছিল। নেনে পড়েছিল যে, আলো সাতটি রঙের তৈরি, এবং তারাগুলো আকাশে চলে ঠিক যেমন ছোট মেয়েরা বাগানে ঘোরে।
না, পুরোপুরি তা নয়; কেননা ছোট মেয়েরা বাগানে একদম এলোমেলোভাবে ঘোরে, যেন বাতাসে উড়ে যাওয়া এক ফুলের পাপড়ি। অথচ তারাগুলো আকাশে একই পথ ধরে চলে এবং যেখানে খুশি সেখানে চলে যায় না। কে জানে, হয়তো আকাশে কেউ আছে যারা তারাগুলোর যত্ন নেয়। ঠিক যেমন পৃথিবীতে বাবা তার ছোট মেয়েদের যত্ন নেয়। কিন্তু তারাগুলো ছোট মেয়ে নয়, পৃথিবীর আলোফুলও নয় যেভাবে এখানে দেখা যায়। তারা পৃথিবীর মতো বড়। সেই তারাদের দেশে গাছ, পানি ও মানুষও আছে, যেমন এখানে আছে। নেনের বাবা বলেছিলেন যে এক বইয়ে বলা আছে, “যখন কেউ মারা যায়, তখন আকাশের তারা হয়ে যায়।”
“তাহলে আমাকে বলো, বাবা,” নেনে তাকে প্রশ্ন করে, “যখন কেউ মারা যায়, তখন বাড়ির সবাই কাঁদে কেন? যদি আমি মারা যাই, আমি চাই না কেউ কাঁদুক; আমি চাই তারা আনন্দ করুক, গান শুনুক, কারণ আমি ওই নীল তারায় বাস করতে যাচ্ছি।”
“শুধু তুমি! একাই সেখানে যাবে, তোমার দরিদ্র বাবাকে নেবে না?” নেনে উত্তর দিল: “তুমি কেন এমন ভাবো!” ওই রাতে, নেনে তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে চায়নি, সে চেয়েছিল তার বাবার বাহুতে শুতে। বাবারা খুব কষ্ট পান যখন মা মারা যান! ছোট মেয়েদের উচিত তাদের বাবাকে খুব ভালোবাসা, যখন তাদের মা মারা যায়।
যেদিন তারা তারাগুলোর কথা বলছিল, সেদিন নেনের বাবা ঢাউস এক বই নিয়ে এসেছিলেন। আহ, কত ভারী ছিল সেটি! নেনে সেটি তুলে ধরতে চেষ্টা করলো, কিন্তু সে পড়ে গেল আর বইটা পড়ল তার উপর। সেখান থেকে কেবল একটি সোনালি মাথা দেখা যাচ্ছিল বইয়ের এক পাশে এবং কিছু কালো জুতো অন্য পাশে। বাবা দৌড়ে এসে বইয়ের নিচ থেকে নেনেকে টেনে তুললেন, এবং হেসে ফেললেন। সে এখনো ছয় বছরের কম বয়সী, কিন্তু একশো বছর পুরনো একটি বই তুলতে চেয়েছিল!
বইটির বয়স একশ বছর, কিন্তু তার কেন দাড়ি গজায়নি! নেনে একবার এক বুড়োকে দেখেছিল, বয়স একশো। তার দাড়ি ছিল খুব লম্বা, কোমরের নিচে ঝুলছিল। ভালো বইগুলো পুরনো মানুষের মতো, একটি ভালো বই একটি পুরনো বন্ধুর মতো। ঠিক এইটিই বলা হয়েছে বইয়ে। নেনে শান্তভাবে বিছানায় গেল, বইটি নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। কী বই ছিল সেটি, যে বই তার বাবা তাকে স্পর্শ করতে দেননি? পরদিন নেনে যখন জেগে উঠল, তখন তার কেবল ওই বইটির কথা মনে হচ্ছিল। জানতে ইচ্ছে করছিল, কীভাবে একটি বই একশো বছর পুরনো হলো, কিন্তু তার দাড়ি নেই!
নেনের বাবা তখন অনেক দূরে, ঘর থেকে দূরে, কাজ করছেন যাতে ছোট মেয়ে সুন্দর ঘরে বাস করতে পারে এবং রোববার মিষ্টি খেতে পারে। কাজ করছেন তার ছোট মেয়ে জন্য সাদা পোশাক এবং নীল ফিতে কিনতে; কাজ করছেন একটু একটু টাকা জমাতে যাতে যদি তার বাবা মারা যান, তবে তার ‘ছোট মেয়ে’ একটি পয়সাও না হারায়। তার দরিদ্র বাবা ঘর থেকে অনেক দূরে, তার ‘ছোট মেয়ের’ জন্য কাজ করছেন। গৃহকর্মী ভেতরে, কাজ করছে। কেউ নেনেকে দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না।
যখন বাবা রুম থেকে বের হন, তখন তিনি সবসময় তার বইগুলো খুলে রেখে যান। নেনে তার ছোট চেয়ার সেখানে রাখে, এবং প্রায়ই তার বাবার ডেস্কের পাশে বসে তাকে কাজ করতে দেখতো। পাঁচ, ছয়, সাতটি ছোট পা... এখন নেনে দরজায় দাঁড়িয়ে, দরজা খুলছে, ভেতরে যাচ্ছে। তারপর যা ঘটল তা বিস্ময়কর! যেন তাকে অপেক্ষা করছে পুরনো বইটা, খোলা অবস্থায় রাখা, মাঝখানে খোলা। সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে নেনে, খুব গম্ভীরভাবে এবং যেন গভীর চিন্তায়, তার হাত পেছনে। নেনে বইটা কখনোই স্পর্শ করবে না, কেবল দেখবে—আর কিছু না। তার বাবা তাকে বলেছে, স্পর্শ না করতে।
বইটির কোনো দাড়ি নেই; এর মধ্যে অনেক ফিতে এবং বুকমার্ক বেরিয়ে আসছে, কিন্তু এগুলো দাড়ি নয়। বইয়ের যে দৈত্যটি আছে তার দাড়ি আছে অবশ্য। চকচকে, এনামেল রঙে আঁকা, যেমন তার বাবার দেওয়া ব্রেসলেটের মতো। এখন আর সেই ধরনের ছবি বইয়ে আঁকা হয় না। দৈত্যটি একটি পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছে, তার মাথার উপর কিছু ঘুরছে, যেন মেঘ, এবং তার নাকের ঠিক উপর একটি চোখ আছে। সে পশুপালের মতো পোশাক পরেছে, পোশাকটি ক্ষেতের সবুজের মতো, সোনালি ও রুপালি তারকায় আঁকা, তার দাড়ি অনেক বড়, এত বড় যে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুলছে। আর তার দাড়ির প্রতিটি কাঁটা বেয়ে একজন মানুষ উঠে যাচ্ছে, যেমন এক অ্যাক্রোবেট সার্কাসের দড়ি বেয়ে উঁচুতে উঠে যায়। কিন্তু দূর থেকে তা দেখা যায় না! বইটি চেয়ার থেকে নামাতে হবে। আহ, কত ভারি সেই বইটি। এখন তুমি সত্যিই সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পারো। এখন এটা মেঝেতে পড়েছে।
এখানে পাঁচটি মানুষ দাড়ির উপর চড়ে যাচ্ছে। একজন সাদা মানুষ, পোশাক ও বুট পরা, এবং তারও একটি দাড়ি আছে; এই শিল্পী কি দাড়ি পছন্দ করেন! আরেকজন ভারতীয় মনে হচ্ছে— হ্যাঁ, একজন ভারতীয়, যার মাথায় পালকওয়ালা টুপি এবং তার পিঠে তীরের বাক্স। আরেকজন চীনা, যেমন শেফ, কিন্তু সে একটি ফুলেল নকশার পোশাক পরেছে, কোন নারীর মতো। আরেকজন চীনার মতো, পেয়ারার মতো চেহারা, সুচের কাজ করা টুপি পরেছে। আরেকজন কালো, সুদর্শন, কিন্তু নগ্ন। কি ভুল! কাপড় ছাড়া চলা! এই কারণে তার বাবা চাইছিলেন না যে নেনে বইটি স্পর্শ করে! না, সে আর কখনো ওই পৃষ্ঠা দেখবে না; যাতে তার বাবা রেগে না যান। আহ, কী দারুণ এই পুরনো বই! আর নেনে বইটির উপর প্রায় শুয়ে পড়েছে, যেন সে তার চোখ দিয়ে বইটির সঙ্গে কথা বলতে চায়।
পৃষ্ঠা প্রায় ছিঁড়ে গেছে! না, পুরোপুরি নয়। শুধু অর্ধেক ছিঁড়ে গেছে। সত্যিই দারুণ এক বই! অনেক ভালো, অনেক ভালো নূহের নৌকার চেয়ে! পৃথিবীর সব পশুর ছবি আঁকা, আর রঙিন, যেমন দৈত্যটি! হ্যাঁ, দেখো, আহ, দেখো সেই জিরাফ চাঁদ খাচ্ছে; দেখো হাতি, সেই হাতি যার পিঠে ছোট ছোট শিশুরা বসে আছে! ও, দেখো এই কুকুরগুলো; দেখো কীভাবে এই কুকুরটা দৌড়াচ্ছে! এসো এখানে, কুকুর! আমি তোমাকে মারবো, কুকুর, কারণ তুমি আসতে চাও না!
নেনে আবার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেললো। আর এখন কী দেখছে আমাদের মিস নেনে? অন্য পৃষ্ঠায় পৃথিবীর ছবি। উভয় পৃষ্ঠা বানরে ভরে আছে। এক লাল বানর একটি ছোট সবুজ বানরের সঙ্গে খেলছে, এক বড় দাড়িওয়ালা বানর একটি বিশাল বানরের লেজ কামড়াচ্ছে, সোজা দাঁড়িয়ে মানুষের মতো হাঁটছে, একটি লাঠি ধরে। একটি কালো বানর ঘাসে খেলছে এক হলুদ বানরের সঙ্গে। ওরা, যাদের গাছে দেখা যায়, সেগুলো ছোট বানর! কী মজা! দেখো কীভাবে তারা খেলে! লেজ দিয়ে ঝুলে তারা দোলনার মতো দুলছে! কী সুন্দর, কী সুন্দর তারা লাফ দিতে পারে!
এক, দুই, তিন, পাঁচ, আট, ষোলো, একচল্লিশ, বাহান্ন বানর তাদের লেজ দিয়ে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে! তারা নদীতে ঝাঁপ দেবে! হুয়ি! দেখে নাও! আর নেনে, ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আরও দুটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলল। কে ডাকছে নেনেকে, কে জানে! তার বাবা, দরজার পাশ থেকে দেখছেন।
নেনে কিছুই দেখছে না, কিছুই শুনছে না। তার বাবা যেন বড়, বড় হয়ে যাচ্ছে, ছাদ স্পর্শ করছে; যেন পাহাড় থেকেও বড় হয়ে যাচ্ছে। বাবা যেন পাহাড় হয়ে উঠছে, তার উপর দাঁড়িয়ে আছে। নীরব, এত নীরব, তার মাথা নিচু, চোখ বন্ধ, ছেঁড়া দুটো পৃষ্ঠা তার হাতে। আর তার বাবা তাকে বলছেন, “নেনে, আমি কি তোমাকে বলিনি এই বইটি স্পর্শ না করতে? নেনে, তুমি জানো না যে এই বইটি আমার নয়, এর দাম অনেক বেশি, খুব বেশি? নেনে, তুমি জানো না যে আমাকে এক বছর কাজ করতে হবে একে কিনতে?”
সাদা কাগজের মতো সাদা, নেনে উঠে দাঁড়ালো, তার মাথা এখনও নিচু, আর তার বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেলেন। নেনে বলল, “আমার প্রিয় বাবা! আমি আমার ভালো বাবাকে রাগিয়ে দিয়েছি! আমি একটা দুষ্টু মেয়ে! এখন যখন আমি মারা যাবো, ওই নীল তারায় কি চলে যেতে পারবো না!”