তানিশা ও তার গাছ বন্ধুরা: শেষ পর্ব

তানিশা যতই সামনের দিকে যাচ্ছিল ততই কান্নার শব্দ স্পষ্ট হচ্ছিল। কৌতূহলী তানিশাও কান্নার শব্দ অনুসরণ করে করে পা চালাচ্ছিল।

রাফিউজ্জামান রাফিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2020, 07:17 AM
Updated : 14 Oct 2020, 07:17 AM

এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তানিশা যখন বাগানের শেষ মাথায় এসে পৌঁছলো তখন ওর মনে হলো বাগানের শেষ প্রান্তে ওদের ঘরের পিছনে যে বড় আমগাছটি দাঁড়িয়ে আছে শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। তানিশা তাড়াতাড়ি আমগাছটার কাছে গেল।

এবার সে একদম স্পষ্ট হু হু করে কান্না শুনতে পেল এবং বুঝতে পারলো যে এই আমগাছ থেকেই কান্নার শব্দ আসছে। কিন্তু তানিশা আমগাছের ওপরে নিচে ভাল করে তাকিয়েও কাউকে পেল না। সে বুঝতে পারছিল না কী হচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হলো গাছটাই কাঁদছে না তো!

আর এটা পরীক্ষা করতে তানিশা গাছের শরীরে কান পাততেই যেটা শুনলো ও যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না! এই বুড়ো আমগাছটা থেকেইতো কান্নার শব্দ আসছে। তাহলে কি গাছই কাঁদছে? কিন্তু কেন? সে আরও একবার গাছের শরীরে কান পাতলো। হ্যাঁ, গাছটাইতো কাঁদছে। তানিশা বলতে লাগলো, গাছ, ও গাছ তুমি কাঁদছো?

প্রথমে তানিশা কোনো উত্তর না পেলেও কয়েকবার ডাকতেই ও শুনতে পেল- হ্যাঁ, আমি কাঁদছি। বলেই গাছটি আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। গাছপ্রেমী তানিশা গাছের কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো, কেন? কী হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছো কেন গাছ?

এমনি তানিশা, তুমি ছোটো মানুষ, তুমি বুঝবে না এসব।

না আমি বুঝবো, প্লিজ তুমি আমাকে বলো গাছ।

বলেই কী হবে? তোমার কাছে বলে কোনো লাভ হবে? তোমরা মানুষরা আমাদের কষ্ট বোঝো?

তুমি জানো আমি গাছদের কত ভালবাসি? গাছ আমার কত বন্ধু। এই যে দেখো, তোমার কান্না দেখে আমারও খুব খারাপ লাগছে! প্লিজ  বলোনা তোমার কী হয়েছে!

শোনো তাহলে। আমি যখন খুব ছোট, তখন তোমার দাদা আমাকে এখানে এনে লাগিয়েছিল। তারপর থেকে আমি এখানেই আছি। তোমার বাবা-চাচারা আমার ফল খেয়ে বড় হয়েছে। আমি তাদের অক্সিজেন দিয়েছি, বিশুদ্ধ বাতাস দিয়েছি। এই যে তোমাদের এই ঘরটা দেখছো, এটা যখন তোমার দাদা এখানে তুললেন তখন সেটা ছিল বাঁশের খুঁটির ঘর। সেই ঘরে তোমার দাদা, দাদী, বাবা, চাচা, ফুপু সবাই মিলে থাকতো। কত কত দিন আমি ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে তোমাদের ওই ঘরটাকে রক্ষা করেছি!

তোমাদের এই ঘর বাঁচাতে গিয়ে কতবার যে আমার হাত পা ভেঙে গেছে তার হিসাব নেই। কিন্তু তবু আমি তোমাদের ঘরের কোনো ক্ষতি হতে দেইনি। সারাজীবন তোমাদের উপকারই করেছি। এখন তোমার বাবা-চাচারা বিল্ডিং করবে এখানে। আর সেজন্য তারা আমাকে কেটে ফেলতে চাচ্ছে। এখন তুমিই বলো, এই কি আমার ভালবাসার প্রতিদান? এই কি আমার উপকারের পুরস্কার?

তানিশা কিছু বলতে পারে না। সে চুপ করে থাকে। গাছটি আবার বলতে থাকে, তোমরা মানুষেরা আসলেই ভাল না। তোমাদের যারা উপকার করে তোমরা তাদেরই ক্ষতি কর। যাও, তুমি যাও এখান থেকে। আমাকে একা থাকতে দাও। কী দেখছো এখানে দাঁড়িয়ে? ধমকের স্বরে গাছটি তানিশাকে এসব বলে আবার কাঁদতে থাকলো।

তানিশা এবার অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চলে আসে৷ ওর কত আশা ছিল গাছ ওর সঙ্গে কথা বলবে! অথচ আজ গাছ ওর সঙ্গে কথা বললেও ও আনন্দিত হতে পারলো না। বরং গাছটির সঙ্গে ওর বাবা-চাচার এমন আচরণের কারণে খুব লজ্জিত হলো ও।

সেদিন রাতে তানিশা ওর বাবা-চাচাদের কথা বলতে শুনল। ওরা বলছিল দুই তিনদিনের মধ্যেই আমগাছটা কেটে ফেলতে হবে। তারপর থেকে তানিশার মাথায় একটাই চিন্তা। আর তা হলো, যে করেই হোক গাছটাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কী করে বাঁচাতে হবে সে ব্যাপারে কোনো বুদ্ধি আসছে না মাথায়। উফ কিছুই মাথায় আসছে না ওর!

এই মুহূর্তে মিঠুকে ওর খুব দরকার। কারণ গাছের সমস্যাটা ও একমাত্র মিঠুর সঙ্গেই শেয়ার করতে পারবে এবং মিঠুই তাকে এর কোনো সমাধান দিতে পারে। আর মিঠু ছাড়া আর কেউ এর সমাধান দেয়াতো দূরে থাক গাছের সঙ্গে যে ওর কথা হয়েছে এটাই বিশ্বাস করবে না৷ উল্টো পাগল বলে হাসাহাসিও করতে পারে। আর তাই তানিশা সকাল থেকে মিঠুর অপেক্ষায় আছে।

অবশেষে বিকেলবেলা মিঠু এলো। মিঠুকে দেখেই তানিশা রাগত স্বরে বলতে লাগলো, এই তোমার আসার সময় হলো মিঠু? গতকাল বিকেলে আসার কথা বলে সেই যে গেলে আর এলে আজ বিকেলে? ওদিকে আমি পড়েছি মহা সমস্যায়।

কেন কী হয়েছে?

মিঠু প্রশ্ন করতেই তানিশা মিঠুকে সব খুলে বলল। খবরটা শুনে মিঠুও বেশ উত্তেজিত হয়ে গেল। সে বললো, তাই নাকি? চল তো দেখি কোন গাছটা? চল, চল। তাড়াতাড়ি চল।

তানিশা মিঠুকে সেই আমগাছের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, এই যে এই গাছটা মিঠু। দেখ না, কেমন চুপ করে আছে! একটা পাতাও নড়ছে না ওর।

হুম, সেটাইতো দেখছি। ওর নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ।

হ্যাঁ মিঠু, কিন্তু যে করেই হোক ওকে বাঁচাতে হবে মিঠু। গাছ আমার বন্ধু। আমি আমার বন্ধুদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। আমি রাতে বাবা-চাচাদের বলতে শুনেছি দু’তিনদিনের মধ্যেই নাকি ওকে কেটে ফেলবে। তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। প্লিজ একটা বুদ্ধি দাও।

হুম, দাঁড়াও একটু ভেবে নিই। কী করা যায় ভাবি। তুমিও ভাবো।

ওরা দুজন ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মিঠু বললো, তানিশা...

তানিশা মিঠুর দিকে তাকায়।

আচ্ছা তানিশা, তোমার বাবা-চাচাদের মধ্যে কার কথা সবাই শোনে বলতে পারো?

হুম, আমার বাবার কথা। আমার বাবার কথা সবাই শোনে।

তোমার বাবা যদি গাছটা কাটতে নিষেধ করে তাহলে গাছটা কি কেউ কাটবে?

না, বাবা যদি না করে তাহলে আর কেউ গাছটা কাটবে না।

তাহলেতো আমগাছটিকে সহজেই বাঁচানো যাবে! তুমি তোমার বাবাকে দিয়ে গাছটাকে কাটতে সবাইকে নিষেধ করাও। তাহলেইতো গাছটি বেঁচে যাবে মিঠু।

কিন্তু বাবা কি আমার কথা শুনবে? কিভাবে রাজি করাবো তাকে আমি? আমতা আমতা করে কথাগুলো বললো তানিশা।

এসব বললেতো হবে না। এবার তোমাকে বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে তানিশা। নইলে গাছটাকে বাঁচাতে পারবে না। আর শোনো, এখনই তোমার গাছের প্রতি ভালবাসা প্রমাণের সময়। এমনও হতে পারে এই গাছটাকে বাঁচাতে পারলে গাছের রাজা সব গাছকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে হুকুম দিতে পারে। তাছাড়া মানুষের প্রতি তারা বিশ্বাসও স্থাপন করতে পারে।

তাই? তাহলে গাছের রাজা আমার সঙ্গে কথা বলবে?

বলতেও পারে। তাদের এক ভাইয়ের প্রাণ বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে গাছের রাজা তোমার সঙ্গে কথাও বলতে পারে, তাই না? আমি আজ যাই। আবার পরে আসবো। বলেই ফুরুৎ দিলো মিঠু।  

সেদিন রাতেই তানিশা তার বাবাকে আমগাছটি না কাটতে অনুরোধ করলো। কিন্তু বাবা তানিশার কথার কোনো পাত্তাই দিলেন না। তানিশা বারবার এক কথা বলার কারণে উল্টো আরও ধমক খেলো বাবা-মায়ের। এমন আচরণে তানিশা বুঝতে পারলো গাছটাকে সে বাঁচাতে পারছে না। নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো ওর। খুব লজ্জা লাগছিল।

গাছটি নিশ্চয়ই আশা করে আছে তানিশা ওকে বাঁচাবে। কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না। গাছটাকে ওরা কেটেই ফেলবে। তানিশার আর গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো না। গাছদের বিশ্বাস আর সে অর্জন করতে পারলো না। এসব ভাবতে ভাবতে খুব খারাপ লাগলো তার। সেদিন রাতে সে কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন তানিশা আর গাছটার সঙ্গে দেখা করতে গেল না। সারাদিন সে শুয়ে শুয়ে শুধু কাঁদলো। ওর কাজিনরা ওকে খেলায় ডাকলো, ফুপু আম্মা পিঠা নিয়ে এসে খেতে ডাকলো, ওর মা-ও এসে ডাকলো, কিন্তু তানিশা কারও ডাকে সাড়া দিল না। তার একটাই কথা, ওই আমগাছটা কাটা যাবে না। এতে যদি সবাই রাজি হয় তাহলে ও খাবে আর নইলে খাবে না।

এভাবে সকাল থেকে দুপুর গড়ালো, দুপুর গড়িয়ে রাত চলে এলো। কিন্তু তানিশা কিছুই খেল না। অবশেষে তানিশারই জয় হলো। তানিশার বাবা মেয়েকে এভাবে না খেয়ে কান্নাকাটি করতে দেখে তানিশাকে কথা দিল সে ওই বুড়ো আমগাছটি কাটবে না। অবশেষে তাই হলো।

তানিশাদের পুরনো ছোটঘর ভেঙে বিল্ডিং হলো। কিন্তু আমগাছটার গায়ে একটা আচড়ও পড়ল না। গাছটা যেখানে যেভাবে ছিল সেখানে সেভাবেই রইল। বরং ঘরের কাজ শেষ হওয়ার পর সবাই বলতে লাগলো পিছনের আমগাছটার জন্য বাড়ির সৌন্দর্য আরও বেড়ে গিয়েছে। আর এজন্য সবাই তানিশাকেই ধন্যবাদ দিল।

ঘরের কাজ শেষে তানিশাদের এবার ঢাকায় ফেরার পালা। তানিশা সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। এ কয়েকদিনে তানিশাকে ওদের পাড়ার সবাই বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। তাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে একটু দেরিই হলো। ওদিকে মিঠুও বিদায় নিল। মিঠু জানালো গাছের রাজাকে সে তানিশার একটি গাছের প্রাণ বাঁচানোর গল্পটি বলবে, আর গাছের রাজা কী বলে সেটাও তানিশাকে শিঘ্রই এসে জানাবে।

ঢাকায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল ওদের। আর তাই গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়লো তানিশা। তানিশার ঘুম ভাঙল পরের দিন সকালে আশ্চর্য এক শব্দে। সকাল সকাল ও শুনতে পেল কেউ ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে চিকন সুরে বলছে- গুড মর্নিং তানিশা, গুড মর্নিং। তানিশা চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকালো। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না সে।

তানিশা রং গাছের দিকে তাকাতেই দেখলো রং গাছটা নড়ছে আর শব্দটা ওদিক থেকেই আসছে। তানিশা আবারও শুনতে পেল- গুড মর্নিং তানিশা। তানিশা চমকে উঠে আনন্দে ওর দিকে আঙুল তুলে বললো- তুমি?

হ্যাঁ তানিশা, গুড মর্নিং।

ইয়াহু, তানিশার কতদিনের ইচ্ছে ছিল এই রং গাছটার গুড মর্নিং শুনে তার ঘুম ভাঙবে! কতদিন তানিশা এই আশায় থেকেছে। কত আদর যত্ন করেছে সে গাছটার। কিন্তু গাছটা কোনোদিন ওকে গুড মর্নিং বলেনি। আর আজ সেই রং গাছ ওকে গুড মর্নিং বলে ঘুম ভাঙিয়েছে!

আনন্দে আত্মহারা তানিশা কী করবে ভেবে পায় না! দৌড়ে ব্যালকনিতে গেল। ব্যালকনিতে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যালকনিতে বাস করা গাছগুলো তাকে একসঙ্গে গুডমর্নিং জানালো। তানিশা এবার আর দেরি না করে এক দৌড়ে ছাদ বাগানে চলে গেল। ছাদে যেতেই সব গাছ একসঙ্গে হেলে দুলে বলতে লাগলো গুড মর্নিং তানিশা, গুড মর্নিং তানিশা, তুমি আমাদের বন্ধু, আমরা তোমার বন্ধু।   

ছাদ বাগানের সব গাছ একসঙ্গে বলে উঠে- হ্যাঁ, আমরা সবাই মিষ্টি মেয়ে তানিশার বন্ধু।

আগের পর্ব

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!