তানিশা ও তার গাছ বন্ধুরা: পর্ব ২

সাতদিন পর আবার তানিশার ব্যালকনিতে এসে বসল মিঠু। তানিশা এবার ওর অপেক্ষাতেই ছিল। মিঠুকে দেখেই তানিশা অস্থির হয়ে গেল।

রাফিউজ্জামান রাফিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2020, 04:32 AM
Updated : 6 Oct 2020, 04:32 AM

ওহ তুমি এসেছ মিঠু? আমি তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি। তারপর বলো, তুমি গাছের রাজার সঙ্গে কথা বলেছ?

হুম, বলেছি তানিশা। গাছের রাজার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার।

কি বললো, কি বললো গাছের রাজা? তানিশা অধৈর্য হয়ে মিঠুর কাছে জানতে চাইল।  

কিন্তু মিঠু তানিশার কথার কোনো উত্তরই দিল না। এদিকে মিঠুকে চুপ করে থাকতে দেখে তানিশা বললো, কি মিঠু চুপ করে আছ কেন তুমি? বলোনা কি বলেছে গাছের রাজা!

গাছের রাজা যা বলেছে সেটা শুনলে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে তানিশা। তাই কথা বলছি না, চুপ করে আছি।

গাছ কি আমার সঙ্গে কথা বলবে না?

না, তানি গাছ তোমার সঙ্গে কথা বলবে না। 

কেন? কি করেছি আমি? কেন আমার সঙ্গে কথা বলবে না? আমিতো ওদের কখনও কষ্ট দেই না। বরং আমি ওদের কত আদর যত্ন করি, সারাক্ষণই আমি ওদের খোঁজ খবর নিই।

কিন্তু গাছ মানুষকে বিশ্বাস করে না তানিশা।

কেন? গাছ কেন মানুষকে বিশ্বাস করে না।

তানিশা অধৈর্য হয়ে মিঠুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

কিভাবে বিশ্বাস করবে বলো? গাছ তোমাদের কত উপকার করে? গাছ তোমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন দেয়, তোমাদের ঘর বানানোর কাঠ দেয়, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করে। এই যে কিছুদিন আগে বাংলাদেশে কি বড় এক ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার কথা ছিল! কিন্তু বুলবুল বাংলাদেশের কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি। কেন জানো? তোমাদের সুন্দরবনের জন্য।

সেদিন বুলবুল আসার কথা শুনে তোমরাতো সবাই ভয়ে কাঁপছিলে। কিন্তু বুলবুল কি তোমাদের কিছু করতে পেরেছে? পারেনি৷ কারণ সেদিন ঝড়ের রাতে তোমরা যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন সুন্দরবনের সবগাছ তোমাদের বাঁচাতে সারারাত ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করেছে, সে রাতে অনেক গাছ মারা গিয়েছে, আহতও হয়েছে বেশ। তবু তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি। সুন্দরবনের গাছগুলোর সেদিন কি হাল হয়েছিল মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ, টিভিতে দেখেছি সুন্দরবনের অনেক গাছ ভেঙেচুরে গিয়েছিল, অনেক গাছ উপড়ে গিয়েছিল।

এসব কার জন্য হয়েছে জানো? তোমাদের জন্য। ওরা তোমাদের এসব দুর্যোগ থেকে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করে রক্ষা করে। আর তোমরা কি কর? ওদের ধন্যবাদ দেওয়াতো দূরের কথা উল্টো সবসময় তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কর। কারণে অকারণে তোমরা নির্বিচারে গাছ কাটো।

তোমাদের কারণে কত গাছ এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে জানো? তোমাদের এই অত্যাচারে কত গাছের জীবন চলে গেছে জানো? আগে কি সুন্দর সবুজ শ্যামল ছিল এই পৃথিবী! কিন্তু তোমরা মানুষেরা সব বন-বনানী কেটে উজাড় করে পৃথিবীর সৌন্দর্যটাই নষ্ট করে দিয়েছ! আর একারণেই গাছেরা মানুষকে কখনোই বন্ধু বানাবে না।

মিঠুর কথাগুলো শুনে তানিশার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সে খুব মনমরা হয়ে বলে, ও। তাহলে গাছ আমার সঙ্গে কথা বলবে না? আচ্ছা, না বললো! তানিশার চোখ দুটো জলে ভরে যায়। সে কথা বলতে পারে না। তার চোখে জল দেখে মিঠুরও মন খারাপ হয়ে যায়।

সে তানিশাকে বলে, আমি অনেক অনুরোধ করেছি তোমার জন্য। তুমি যে আর সব মানুষের মতো না, তুমি যে গাছকে অনেক ভালবাসো সবই আমি গাছের রাজাকে বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু মানুষের ওপর থেকে ওদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে তানিশা। ওরা তোমাদের বিশ্বাসই করতে চায় না।

হুম, বুঝেছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো তানিশা।

তবে আমি অনেক করে বলাতে গাছের রাজা একটা শর্ত দিয়েছে। সেটা যদি তুমি পূরণ করতে পারো, তবেই গাছ তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

তানিশা কথাটা শুনে আনন্দে নেচে ওঠে। চোখ দুটো বড় বড় করে তানিশা বলে, তাই? কি সে শর্ত? বলো না মিঠু! প্লিজ তাড়াতাড়ি বলো কি সে শর্ত? আমি গাছের রাজার সব শর্ত মানতে রাজি আছি।

শর্তটি হলো, তুমি যদি কখনও গাছেদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারো তবেই গাছেরা সেদিন থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

কথাটা বলেই মিঠু ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল। যেতে যেতে বলে গেল আজ যাই তানি, আমার সময় নেই, বাচ্চাটা অসুস্থ, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমি দু-তিনদিন পর আবার আসবো। তানিশার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই উড়তে উড়তে চলে গেল মিঠু।

এত সুন্দর একটা উপায় বলার জন্য মিঠুকে ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে তানিশাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মিঠুর উড়ে যাওয়ার দিকে।   

এবার যেন তানিশার নতুন মিশন শুরু হলো। সে গাছেদের যত্ন নেওয়া আরও বাড়িয়ে দিল। গাছে পানি দেয়া, নিয়মিত ওদের গোড়া থেকে আগাছা পরিষ্কার করা, ওষুধ দেয়া, এসব ব্যাপারে  তানিশা মতি চাচাকে রীতিমতো তটস্থ করে তুললো। উদ্দেশ্য একটাই, গাছের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।       

তানিশার দিন যখন এই তুমুল উত্তেজনা ও উন্মাদনার মধ্য দিয়ে কাটছিল, ঠিক সেসময় ও জানতে পারলো বিশেষ এক কারণে আগামীকাল ওদের সবাইকে ওদের গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে তানিশাতো আনন্দে আটখানা! কারণ গ্রামে গেলে ও রুটিন বাঁধা জীবন, নিয়মিত স্কুল, হোম টিউটর ইত্যাদি থেকে একদম ছুটি পায়। মায়ের ডাকাডাকিতে ভোর সকালে স্কুলে যেতে বিছানা ছাড়ার বদলে আরাম করে ঘুমানো যায়। বিকেলে হোম টিউটরের কাছে পড়তে বসার পরিবর্তে ইচ্ছেমতো ছোটাছুটি করে খেলা যায়। এছাড়া মজার মজার খাবার দাবারতো আছেই।

সকালে ঘুম থেকে উঠলেই কত দারুণ দারুণ খাবার দাবারের ঘ্রাণে দিন শুরু হয়। বড় মামী পিঠা দেয় তো, ছোট দাদু মাংস নিয়ে আসে, আবার খালা নিয়ে আসে পাটালি গুড়, নাড়ু মোয়া আরও কত কি? আর তাই বাবার কাছে গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে তানিশার আনন্দ যেন ধরে না।

সেদিন বিকেলে মিঠু আসতেই তানিশা ওকে ওদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সংবাদটা জানালো। তানিশার গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে মিঠু জানালো সেও তানিশাদের গ্রামে যাবে। তানিশাদের গ্রামে মিঠুর এক খালা থাকে। অনেকদিন হলো খালার সঙ্গে দেখা হয় না। এবার খালাকেও দেখে আসা হবে আর তানিশাকেও সময় দেওয়া হবে।

মিঠুর কথা শুনে তানিশাতো আরও খুশি। এমন আনন্দের দিনগুলোতে মিঠুর ওর সঙ্গে থাকলেতো দারুণ হবে। সে খুব খুশি হয়ে বললো, তুমি সত্যি যাবে?

হ্যাঁ, যাবো। অনেকদিন হলো খালাকে দেখা হয়নি। খালার বয়স হয়ে গিয়েছে। কখন কি হয়ে যায়, তাই একবার এই ফাঁকে দেখেই আসি।

পরদিন সকাল সকাল মিঠু চলে এলো। তারপর  তানিশা ওর বাবা-মা আর মিঠু একসঙ্গে তানিশাদের গাড়িতে করে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

তানিশা গ্রামে গিয়ে দেখলো এবার শুধু ওরাই না ওর কাকা, ফুপি সবাই একদম সপরিবারে গ্রামে এসেছে। ওর বাবা চাচা ফুপিকে একসঙ্গে দেখে আর ওদের কথাবার্তা শুনে তানিশা বুঝতে পারলো সত্যিই এবার ওরা বিশেষ প্রয়োজনে গ্রামে এসেছে। আর তা হলো ওদের বাবা, চাচারা বাড়িতে বড় করে বিল্ডিং করবে। আর সেজন্যই সবার একত্র হওয়া।

বাড়িতে ইট, সিমেন্ট, বালিও আনা হচ্ছে। আশপাশের বাড়ির মানুষ আসছে। ঘরের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা সাজ সাজ রব লেগেছে তানিশাদের গ্রামের বাড়িতে। এসব দেখে তানিশার ভালই লাগছে আর সেইসঙ্গে তানিশার আরও ভাল লাগছে ওর সব কাজিনদের একসঙ্গে পেয়ে। প্রথম দুইদিন ওরা সবাই মিলে এতো হৈ হুল্লোড়ে কাটালো যে মিঠুর কথা ওর মনেই পড়লো না। সারাদিন গল্প খেলায় কিভাবে যে দুইদিন চলে গিয়েছে ও বুঝতেই পারলো না।

পরদিন সকালে তানিশার ঘুম ভাঙলো মিঠুর ডাকে। তানিশা চোখ মেলে তাকাতেই মিঠু অভিমানী কণ্ঠে বললো- কি, গ্রামে এসে আমাকেতো দেখছি ভুলেই গেছো তানিশা! মিঠুর কথায় তানিশার মনে হলো, তাইতো, সব কাজিনদের পেয়ে এই দুইদিনতো মিঠুর কথা মনে পড়েনি ওর। খুব লজ্জিত হলো তানিশা। লজ্জিত হয়ে বলতে লাগল, আসলে খুব ব্যস্ত ছিলাম, সরি মিঠু।

হুম বুঝেছি, কাজিনদের সঙ্গে ভালই সময় কাটছে তোমার। আমি একদিন এসেছিলাম তোমাকে ব্যস্ত দেখলাম। তাই ডাকিনি।

সরি মিঠু৷ তারপর কি খবর বলো?

এইতো আছি। খালার বাড়ি ভালই খাচ্ছি দাচ্ছি। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম ঢু মেরে যাই।

তানিশা উঠতে উঠতে বললো চলো বাগানে যাই। আমাদের বাগানে হরেক রকম গাছ আছে, ওদের সঙ্গে আমার এখনও কথা হয়নি। চল ওদের সঙ্গে দেখা করে আসি। কিন্তু মিঠু গেল না৷ সে বললো, সে এখন পারবে না। তাকে এখন যেতে হবে। বিকেলে আবার আসবে, তখন তানিশার সঙ্গে ও বাগানে যাবে। বলেই ফুরুৎ। মিঠুর এই জিনিসটা তানিশার একটুও ভাল্লাগে না। যাই বলে সে এক সেকেন্ড দেরি করে না। অমনি ফুরুৎ করে উড়ে চলে যায়! বিরক্তিকর!

সেদিন দুপুরের পর থেকেই তানিশা মিঠুর জন্য অপেক্ষা করছিল। তানিশা আজ মিঠুর সঙ্গে বেরোবে বলে কাজিনদের সঙ্গে খেলতে যায়নি। কিন্তু মিঠুর দেখা নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেলও প্রায় শেষের দিকে, কিন্তু মিঠু এলো না। অগত্যা তানিশা একাই বাগানের দিকে পা বাড়ালো। তখন চারদিকে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। বাগানের ছোট বড় সব গাছ ঝিম মেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটা পাতাও নাড়ছে না কেউ। অন্য সময় হলে তানিশা ওদের ডেকে ডেকে কথা বলতো, কিন্তু গাছদের চুপচাপ দেখে ভাবলো নিশ্চয়ই ওরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তানিশা ওদের ডাকলো না।

একা একা বাগানে পায়চারি করতে লাগল তানিশা। বাগানে পায়চারি করার সময় হঠাৎ তার মনে হলো কেউ একজন হুহু করে কাঁদছে এবং সে আশপাশেই আছে। কিন্তু কে কাঁদবে এখানে? তানিশা আর গাছ ছাড়াতো এখানে আর কেউ নেই। আর গাছতো কথা বলতে পারে না। তাহলে কাঁদবে কে? তানিশা বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কি। তবে সে খুব মনোযোগ দিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে লাগলো এবং বুঝতে চেষ্টা করলো কোন দিক থেকে শব্দটা আসছে।

এভাবে বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে তানিশা বুঝতে পারলো শব্দটা তার ডান দিক থেকে আসছে। সে এবার ডানদিকে কান্নার শব্দ ধরে এগুতে লাগল।

চলবে...

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!