তানিশা ও তার গাছ বন্ধুরা: পর্ব ১

ছোট্ট তানিশা ওর ছাদ বাগানে বসে গাছদের সঙ্গে আপন মনে কথা বলছে। ও কোনো গাছকে হাই বলছে আবার কোনো গাছকে হ্যালো বলছে। আবার কোনো গাছকে জিজ্ঞেস করছে, তোমরা সবাই কেমন আছো?

রাফিউজ্জামান রাফিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2020, 02:36 PM
Updated : 3 Oct 2020, 02:36 PM

মতি চাচা ওদের সময়মতো পানি-টানি দেয় কিনা, ঠিকমতো দেখাশোনা করে কিনা ইত্যাদি খোঁজ নেয় তানিশা। ওই যে এক কোণে একটি নিমের চারা দেখা যাচ্ছে, ও এই ছাদ বাগানের নতুন সদস্য। সপ্তাহখানেক হলো তানিশা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।

রাস্তার ধারে কে যেন ওকে উপড়ে ফেলে রেখেছিল। তানিশা ওকে কোলে করে এনে এখানে লাগিয়েছে। নিয়মিত পানি ও যত্ন-আত্তি পেয়ে এর মধ্যেই চারাগাছটি বেশ সতেজ ও সবুজ হয়ে উঠেছে। তানিশা ওর নাম রেখেছে ‘নিম মিয়া’। তানিশা নিম মিয়ার পাতাগুলো নেড়ে চেড়ে ওকে একটু আদর করে দিল।

তানিশার এই ছাদবাগানে রয়েছে হরেক রকম গাছ। ফুল গাছ, ফল গাছ, ঔষধি গাছসহ  আরও কত কত গাছ! সময় পেলেই ও সেসব গাছের সঙ্গে গল্প করতে বসে যায়। কারণ গাছের সঙ্গে কথা বলতে তানিশার ভীষণ ভালো লাগে। ওর খুবই ইচ্ছে একদিন পৃথিবীর সব গাছ ওর বন্ধু হবে। তানিশা গাছদের দেখে যেমন খুশি হয়, কথা বলা শুরু করে, তেমনই গাছেরাও একদিন তানিশাকে দেখলে খুশি হবে, তানিশার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলবে।

কিন্তু গাছেরা তানিশার বন্ধু হওয়াতো দূরের কথা ওর সঙ্গে তারা কোনো কথাই বলে না। এ নিয়ে তার দুঃখের শেষ নেই। প্রায়ই সে মায়ের কাছে জানতে চায় গাছ ওর সঙ্গে কথা বলে না কেন। আর মা প্রতিবারই এক উত্তর দেন, গাছ কথা বলতে পারে না, তাই তারা তানিশার সঙ্গে কথা বলে না।

কিন্তু গাছের বন্ধু হতে ইচ্ছুক তানিশা এটা মানতেই পারে না। সে চায় সে যেমন গাছের সঙ্গে কথা বলে গাছেরাও তার সঙ্গে কথা বলুক। আর গাছদের সঙ্গে কথা বলতেইতো তানিশা ওদের ছাদজুড়ে এই বিশাল ছাদ বাগান গড়ে তুলেছে৷ হ্যাঁ, তানিশাদের এই ছাদ বাগানটা দেখে বড় মানুষের তৈরি বলে মনে হলেও এটা কিন্তু তানিশাই গড়ে তুলেছ। শুরুর দিকে তানিশা কোথাও কোনো গাছ পেলেই তা তুলে এনে প্লাস্টিকের বোতল বা পরিত্যাক্ত কৌটায় লাগিয়ে ছাদে রেখে দিত।

প্রথম প্রথম বাবা মা এগুলোকে ওর পাগলামি ভেবে নিলেও পরে তারাও তানিশাকে সহযোগিতা করেছে। তানিশার যে গাছটাই পছন্দ হয়েছে বাবা-মাকে বলতেই তারা সেই গাছটা তানিশাকে এনে দিয়েছে। আর এভাবেই গড়ে উঠেছে তানিশার বিশাল এই ছাদবাগান। তবে শুধু ছাদেই না, ওদের বাসার ব্যালকনিতেও অনেক গাছ রেখেছে তানিশা। ও সময় পেলেই তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। 

তানিশার স্কুল মর্নিং শিফটে। তাই ওকে  রোজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তবে সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে ও যে কাজটি করে তা হলো, ও ওর সব গাছবন্ধুদের ‘শুভ সকাল’ জানিয়ে তারপর স্কুলে দিকে পা বাড়ায়। আবার স্কুল থেকে ফিরে এসেও সবার আগে তানিশা ওর গাছ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে তারপর অন্যান্য কাজে মন দেয়। তাছাড়া দিনের অন্যান্য সময়ও সে গাছ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। 

তানিশার মা মাঝে মাঝে মেয়ের এমন পাগলামিতে বেশ বিরক্ত হন। এই যেমন এখন তানিশার মা তানিশার ওপর ভীষণ বিরক্ত। কারণ সে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধোয়াতো দূরের কথা, জামা কাপড়ও ছাড়েনি। ওমনি ছাদে এসে গাছদের সঙ্গে রাজ্যের গল্প-গুজব জুড়ে দিয়েছে। 

তানিশার মা তানিশাকে ডাকলেন- তানিশা...।

মায়ের ডাক শুনে তানিশা ঘুরে তাকাতেই মা বললেন, কি করছো তুমি?

তানিশা মাকে অনুযোগের সুরে বললো, গাছদের সঙ্গে কথা বলছি, কিন্তু গাছ আমার সঙ্গে কথা বলে না কেন?

কতবার বলবো তানিশা, গাছ কথা বলতে পারে না। ওরা তোমার সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে বলো? মা বেশ বিরক্ত হয়েই কথাগুলো বললেন তানিশাকে।

কেন পারে না কথা বলতে? আমি রোজ ওদের কত ডাকাডাকি করি! আমি ওদের কত ভালবাসি! তাও কেন ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে না? ভাল্লাগে না।

 মুখটা ভার করে কথাগুলো বললো তানিশা। কিন্তু মা তার সেসব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টো মেজাজের সঙ্গে বললেন, কি হলো? তোমার হাত-মুখ ধুতে হবে না? স্কুল-ড্রেস চেঞ্জ করোনি, কিছু মুখেও দাওনি, ওমনি চলে এসেছো এখানে! এক্ষুণি চলো।

মায়ের মৃদু ধমকে তানিশা মুখ ভার করে মায়ের পিছু নিলো।

দুপুরে তানিশা ঘুমোলো না। মুখটা ভার করে জানালার ধারে বসে রইল। ওর মন ভাল না। গাছদের ওপর খুব রাগ হচ্ছে ওর। সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে ওর ঘরে যে রঙিন পাতাবাহার গাছটি আছে, ওটার ওপর।  ছাদের বা বারান্দার গাছগুলো ওর সঙ্গে না হয় নাই কথা বললো কিন্তু রং গাছটাতো ওর ঘরে থাকে। তানিশা কত আদর করে ওই গাছটাকে ওর ঘরে রেখেছে, কত আদর করে গাছটার নাম রেখেছে ‘রং গাছ’!

রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় তানিশা রং গাছটাকে ‘গুড নাইট’ বলে ঘুমোতে যায় আবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই রঙ গাছটাকে ‘গুড মর্নিং’ জানায়। কিন্তু  তবুও রং গাছটা কোনদিন তানিশার সঙ্গে একটা কথাও বললো না। অভিমানি তানিশা রঙ গাছসহ অন্যান্য গাছদের এমন ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নিল এখন থেকে সে আর কখনও গাছের সঙ্গে কথা বলবে না।

নিজের ঘরে বসে তানিশা যখন এসব ভাবছিল ঠিক তখনই সে শুনতে পেল বাইরে থেকে কে যেন কিচির-মিচির করে ওর নাম ধরে ডাকছে। তানিশা বুঝতে পারল না কে তাকে এমন করে ডাকছে। তবে ও খেয়াল করল ডাকটা বারান্দার দিক থেকে আসছে। তানিশা বারান্দায় যেতেই দেখল একটা টিয়াপাখি বারান্দার গ্রিলে বসে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর তানিশা তানিশা করে ডাকছে। ওকে দেখেই টিয়া পাখিটা বলে উঠল, ‘তানিশা, তানিশা’। টিয়াপাখির মুখে নিজের নাম শুনে থ হয়ে দাড়িয়ে রইল তানিশা। ওর চুপ থাকা দেখে টিয়া পাখিটা আবার বলতে লাগল, কি তানিশা, আমাকে চিনতে পারলে না?  আমি মিঠু, এই ছয় মাসেই ভুলে গেলে আমাকে! 

তানিশা ভাবতেই পারছে না মিঠুর সঙ্গে ওর আবার দেখা হবে। মিঠু ওর পোষা টিয়াপাখি ছিল। পাখিটাকে বাবা ওকে ওর জন্মদিনে গিফট করেছিল। টিয়াপাখি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল তানিশা! তারপর থেকে সারাদিন শুধু টিয়াপাখিটার সঙ্গেই ওর সময় কাটতো। টিয়াপাখি ঠিকমতো খেল কিনা, টিয়াপাখি অসুখ বিসুখ করল কিনা, সারাক্ষণ এসব নিয়ে তানিশা ব্যস্ত থাকত। এমনকি সে রাতে ওঠেও দেখত টিয়াপাখিটা ঠিকমতো ঘুমোচ্ছে কিনা।

তানিশা পাখিটার নাম রেখেছিল ‘মিঠু’। এভাবে মিঠুকে নিয়ে যখন তানিশার আনন্দে দিন কাটছিল তখন একদিন ক্লাসে ওর মিসের নিকট থেকে তানিশা জানতে পেল পাখিদের খাঁচায় বন্দি রাখা ভাল নয়। মানুষের যেমন স্বাধীনতা আছে তেমনই পাখিদেরও স্বাধীনতা আছে, মুক্তভাবে বাঁচার অধিকার আছে। আর কারও স্বাধীনতা হরণ করা খুব অন্যায়৷ মিসের কথাগুলো শুনে তানিশারও মনে হলো সেওতো শুধু শুধু মিঠুকে বন্দি করে রেখেছে। সেওতো অন্যায় করছে তাহলে! সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই মিঠুকে ছেড়ে দিয়েছিল তানিশা। সেতো আজ ছয় মাস আগের কথা।

এতদিন পর মিঠুকে দেখে তানিশা জিজ্ঞেস করল, মিঠু, কেমন আছ তুমি? এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল তোমার?

তোমার কথা আমার সবসময়ই মনে পড়ে তানিশা। কিন্তু কি করবো বলো? ঘর সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকিতো তাই আসা হয় না। আজ এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম এই ফাঁকে তোমার সঙ্গেও একটু দেখা করে যাই। এবার বলো তুমি কেমন আছো তানিশা?  চিঁ চিঁ করে কথাগুলো বললো পাখিটা।

তানিশা জানালো তার মন ভাল নেই। মনটা খুব খারাপ তার।

কেন কি হয়েছে তোমার? বাবা বকেছে? নাকি মা মেরেছে?

না মিঠু। আসলে ব্যাপারটা তা না। আমার মন অন্য একটা কারণে খারাপ।

কি কারণ, বলো শুনি? দেখি তোমাকে কোনো সাহায্য-টাহায্য করতে পারি কিনা।

মিঠু সাহায্য করবে শুনে তানিশা খুব খুশি হয়ে মিঠুকে বললো, সত্যিই তুমি আমাকে সাহায্য করবে মিঠু?

করতেও তো পারি। কে কখন কাকে সাহায্য করে বলা যায়?

তাহলে শোনো, তুমিতো জানো গাছ আমার কতো প্রিয়! গাছ আমি কতো ভালবাসি! 

হ্যাঁ, তুমিতো সারাক্ষণ গাছেদের সঙ্গেই সময় কাটাও। তোমার ছাদবাগানে তুমি কত গাছ রেখেছ। তুমি ওদের কত ভালবাস, যত্ন নাও আর সারাক্ষণ ওদের সঙ্গে কথা বলো।

হুম, কিন্তু গাছ আমার সঙ্গে কথা বলে না মিঠু। আমি সারাদিন ওদের কত কথা জিজ্ঞেস করি! ওরা কোনো উত্তরই দেয় না।

তানিশা মুখটা কালো করে কথাগুলো বললো। তানিশার শুকনো মুখ দেখে মিঠুরও খুব মায়া হলো।

মিঠু তানিশাকে বললো- শোন তানিশা, গাছদের রাজার সঙ্গে আমার আলাপ আছে। গাছের রাজার পাশের গাছটাতেই আমি বৌ-বাচ্চা নিয়ে বাস করি।  রোজই তার সঙ্গে আমার কথা হয়। তার সঙ্গে আমি তোমার ব্যাপারে  আলাপ করে দেখি। সে নিশ্চয়ই একটা কিছু বলতে পারবে।

 সত্যি? গাছের রাজার সঙ্গে তোমার আলাপ আছে? তুমি আমার ব্যাপারে কথা বলবে গাছের রাজার সঙ্গে?

 হ্যাঁ বলবো তানিশা, বলবো।  আচ্ছা ঠিক আছে আমি আজ যাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলি তাহলে তানিশা, ভালো থেকো।

মিঠু ফুরুৎ করে উড়ে গেল। আর যেতে যেতে বলে গেল, সামনে সপ্তাহে তোমার কাছে গাছের রাজার খবর নিয়ে আসব বুঝেছ!

চলবে…...

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!