সাহিদুল ইসলামের গল্প: সিনেমা ও স্বপ্ন

ক্ষুধা লাগে। তীব্র ক্ষুধা। এ ক্ষুধা কখনো মেটে পাউরুটি কিংবা দশ টাকার কেক, কখনও বিস্কিটে। তবে এ ক্ষুধার চেয়ে বড় ক্ষুধা- সিনেমা বানানোর স্বপ্ন।

সাহিদুল ইসলাম সাহিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2020, 07:47 AM
Updated : 25 Sept 2020, 07:47 AM

ক্ষুধার জ্বালায় যখন পেটের ভেতর ইঁদুর ছুটোছুটি করে তখনও মাথার ভেতর সিনেমা গিজগিজ করে, সিনেমা কিলবিল করে শুঁয়োপোকার মতো। তাইতো সিনেমার ক্ষুধায় সিনেমা খাই। রাত-বিরাতে যখন নতুন বিয়ে করা দম্পত্তি আকাশের অহংকারী সুখি চাঁদটা দেখে তখন চাঁদ আর ইলেক্ট্রিক বাতির মিশেলে আমার কলম চলে দুধ-সাদা কাগজে, সিনেমার গল্পে।

সে কি গল্প! হাত থমকে আসে ক্লান্তিতে, তবু সিকুয়েন্সের রাশি আমায় আলতো সুরে বলে, প্রিয়তম আরেকটু...আরেকটু...। ঘুম ভেসে আসে চোখ দুটোয় আর সিনেমার গল্পে পাত্র-পাত্রী সবুজ লতায় বাঁধানো দু’জোড়া ভেলায় চড়ে স্বপ্নের কুঁড়েঘরে যাত্রা করে। ঘুম এসে আমার চোখ ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্ধকার এক ঘোরের রাজ্যে। ঘোর ভাঙে সরু গলিতে রঙিন রিকশার বেলে কিংবা মানুষের হৈচৈ শুনে।

আবার কখনো একসঙ্গে কাজ করা আমার মতোই অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের ফোন-কলে। উসখো-খুশকো চুল আঁচড়ানোর জো থাকে না কখনোই। বড় এই এলোচুল সিনেমার খাতিরেই রাখা। চুল বড় রাখলে একটু ফিল্মমেকার ফিল্মমেকার ভাব আসে শরীরে। কুঁচকানো মলিন শার্টের হাতা জড়াতে জড়াতে রিকশায় চড়ে বাস-স্ট্যান্ডে। প্যান্টের পকেট লম্বায় অনেক বড় হলেও অল্প কয়েকটা নোট তলানিতে পড়ে আছে। তাইতো রিকশাওয়ালা মামার সঙ্গে নিশ্চিত ভাড়া নিয়ে প্যাচাল পারতে হবে। সঙ্গে দু’একটা মিথ্যে ছুড়তে হবে, আরে হ তুমি আমারে শিখাও! এই টাকাই তো দেই প্রতিদিন।

রিক্সার ঝামেলা শেষ করে বাসে চেপে ওঠা। ঝুলে পড়ে হাওয়া আর ধুলো খেতে খেতে যাত্রা। যাত্রা শেষে শ্যুটিং সেটে গিয়েই ডিরেক্টরকে হাজিরা দেওয়া, বস আসছি আজকের প্ল্যানটা বুঝায়ে দেন। প্ল্যান কি আর, নায়ক নায়িকাকে তোষামোদ করতে করতে শ্যুটের অবস্থা বারোটা। আর বারোটা তো বাজবেই সিনেমার গল্পের অবস্থাও তো বারোটা বাজানো। সেই একই গল্প। নায়ক, নায়িকা, ভিলেন, বড়লোক মেয়ের বাবা আর পুলিশ। যেমন গল্প তেমন সংলাপ, যেন কয়েকটা কাক মিলে মিটিং করে সংলাপগুলো লিখেছে।

তবু এমন সিনেমার সঙ্গেও কাজ করতে হয় পেটের দায়ে, কাজের হাত ঝালানোর দায়ে। বহুবার ভেবে একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এসব কাজের সঙ্গে আমি আর নেই। তবু গ্রামে ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ, মায়ের সংসার খরচ, নিজের থাকা খাওয়া আমাকে বারবার ভাবিয়ে এমন সিনেমার কাজে ফেরাচ্ছে। এসব সিনেমা দেখার সময় নিজের নামটা যখন অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের জায়গায় দেখি তখন খুব লজ্জা করে। মাথা নিচু হয়ে যায়।

ছোটবেলা থেকেই যখন সিনেমা ভালোবাসা শুরু করি তখন থেকেই ডিরেক্টরের জায়গায় নিজের নামটা দেখার প্রচণ্ড শখ ছিল। এখন হয়ত অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের জায়গায় নিজের নাম দেখি। কিন্তু কোনো আনন্দ পাই না। আমার যে কতো কতো সিনেমার গল্প আছে। মাথাভর্তি কনসেপ্টের ঝুড়ি। দিস্তায় দিস্তায় খাতায় লেখা গল্পগুলো। এছাড়া ভাঙা স্ক্রিনের ফোনটার ওয়ার্ড ফাইলের গল্পগুলো। কেউ একটুখানি পরশ মাখায় না গল্পগুলোর মাথায়। গল্পগুলো পূর্ণতা পেতে কারো কাছে গিয়েও আশা পাই না।

তবে বেশিরভাগ টাকাওয়ালা প্রডিউসার আশা দেয়। গল্প শুনে মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁকে স্ক্রিপ্টে একটু চোখ বুলিয়ে সাহিত্য-বুঝদার ভাব নিয়ে খানিক সুরে বলে, গল্পটা ভালো। কিন্তু আমি তো কমার্শিয়াল বানাই।

কেউবা লস খাওয়ার ভয়ে লগ্নি করে না। কারো আবার এমন স্ক্রিপ্ট বোঝার মাথাটাও নেই। যেসব ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদেরও কতো অনুরোধ করি। আমার একটা গল্পে কাজ করতে দরকার হলে স্ক্রিপ্টের জন্য সম্মানি নেবো না। তাও একটু পূর্ণতা পাক আমার গল্প। হয় না, ফিরে আসতে হয় বারবার।

আমাকে শুধু গল্প না টাকার অংকেও অনেকবার ফিরতে হয়েছে। এইতো সেদিন যেদিন বৃষ্টি শেষে প্রেমিকার হাতে গাছ থেকে কদম ছিঁড়ে দিনের সূর্যের শেষ আলোও ভিজে পিচডালা রাস্তায় নিজের দুই হাজার টাকার ভাড়ায় ফিনকে রুমের বাসাটার দিকে যাচ্ছিলাম, চায়ের টং-এ টিভিতে নাটক চলছে। বেশ কয়েকজন দর্শক। চায়ে চুমুক দিচ্ছে আর শেষ দৃশ্যে হা করে তাকিয়ে আছে। কারো সিগারেট জ্বলছে, কিন্তু টান দেওয়ার ফুসরত নেই। চোখ টিভিতে চলা নাটকে। আমার লেখা নাটক। এছাড়া নাটকটায় অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরও ছিলাম।

কিন্তু ওই যে টাকার অংকে ফিরে আসা। এখনো গল্পের আর চিত্রনাট্যের সম্মানি পেলাম না। কিন্তু নাটক শেষে দর্শকদের তৃপ্তি। আর গল্প, চিত্রনাট্য ও অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিজের নাম দেখে মনটা ভরে গেল। মেঘের ফাঁকে উঁকি দেওয়া সূর্যের মতো মনের ভেতর আনন্দ ধরা দিল। কিন্তু খানিক পরই আবার বিষণ্নতা। বিষণ্ণতা তো লেগেই থাকে একেরপর এক। কেউ একজন বলেছিলো এই লাইনে ভেবেচিন্তে যাস, অনেক আগুনে পুড়তে হবে, শরীরকে কাঠ না লোহা বানাতে হবে।

কিন্তু তখন বিশ্বাস হয়নি। বিশ্বাস হওয়া শুরু করে যখন ফুটো পকেটে রাস্তা চলতে হয়। মাস শেষে ঠিকমতো টাকা না পাঠাতে পারার যন্ত্রণা। সিনেমা ভালো না বাসা প্রেমিকা, কিন্তু তাকেও আমি ভালোবেসেছি সে যখন বলে, এসব সিনেটা-টিনেমা ছাড়ো ভালো একটা চাকরি করো, তখনো বিষণ্ণতায় পড়েছি। অন্য কিছুও তো আমি করতে পারি, কিন্তু তেমন কিছুই তো পারি না। পড়ালেখা করলেও মন তো সেটায় তেমন ছিল না, মন তো পড়ে ছিল সিনেমায়। এই একটা কাজই তো পারি শুধু। এটাকেই ভালোবাসি। বিষণ্ণতা তাই সইছি।

তবে এই মুহূর্তের বিষণ্ণতা হলো, নাটকের গল্প আর চিত্রনাট্যের সম্মানিটা পেলে বাসা ভাড়াটা দিতে পারতাম। কি আর করার, বাড়িওয়ালার ঘ্যানঘ্যান শুনতে হবে। আমার বিষণ্ণতায় মাঝে মাঝেই কিছু আনন্দ ধরা দেয়। নিজের বানানো একটা একদম ছুটো পয়সায় বানানো একটা সিনেমা বিদেশি একটা ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পায়। বেশ কিছু টাকাও পেয়েছিলাম। সিনেমা দেখার জন্য একটা প্রজেক্টর কিনে ফেলেছিলাম কিছু না ভেবেই। বাকি টাকা মাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বছরে দু’একবার নিজের বানানো কয়েকটা শর্ট-ফিল্ম থেকে এভাবে আনন্দ ধরা দেয়। এগুলো আরো কাজের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। গভীর স্বপ্ন দেখায় সিনেমা বানানোর।

তাই কলম চলতে থাকে সাদা কাগজে গল্প ছড়াতে। দেখতে দেখতে বহু সিনেমার গল্প লেখা হয়ে গিয়েছে। এখনো কাজ করি প্রডিউসারদের পিছনে, ছুটতে থাকি গল্পগুলোকে পূর্ণতা দিতে। ছুটতে ছুটতে এখন নিজেকেই নিজে চিনি না। নিজের চেহারাটা আয়নায় ঠিক কবে ভালোমতো দেখেছি তাও মনে নেই। সিনেমার গল্পের মতো আমার উসখো-খুশকো জীবনে মোড় আসে, সিনেমার ভাষায় যাকে বলে ক্লাইমেক্স।

কয়েকদিন কাজের চাপে বাড়িতে যোগাযোগ নেই। হঠাৎ একদিন ভাঙা স্ক্রিনের ফোনে একটা কল এলো। কন্টাক্ট নাম্বারে লেখা ‘মা’। কিন্তু ফোন ধরে ছোটভাইয়ের শান্ত কণ্ঠ শুনতে পেলাম। জানতে পারি মা অনেক অসুস্থ। ছোটভাই অনেক কষ্টে হসপিটালে নিয়েছে। এখন দরকার ভালো চিকিৎসা। দরকার টাকা। এদিকে আমার ফুটো পকেটে সামান্য কিছু টাকা। এ টাকায় কিছুই হবে না। তবুও টাকাটা পাঠিয়ে দিলাম। মাথায় ভর করে বসলো টাকার চিন্তা। সিডিউলে দুইদিন পর একটা শ্যুটিং, ওখান থেকে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু আরো টাকা লাগবে। বাকিটাকা কিভাবে জোগাড় হবে!

ঘণ্টাখানেক পর একটা ফোন আসলো। কোনো খারাপ সংবাদ নয়তো! নিজেকে সাহস দিয়ে ফোনের কাছে গেলাম। লেখা ‘আবিদুর রহমান’। কিছুদিন আগে যাকে গল্প শুনিয়ে আসলাম প্রডিউস করার জন্য। সে বলেছিল পরে সিদ্ধান্ত জানাবে। সে এখন ফোন দিয়েছে। তার মানে কি রাজি হয়ে গেল! রাজি হলে তো স্বপ্নটা পূরণ হবে আর চিকিৎসার টাকাটাও হয়ে যাবে। নাকি প্রতিবারের মতো অন্য প্রডিসারদের মতোই না করে দেবে!

আমার ভেতর এখন কী চলছে এটা আমি কখনো স্ক্রিপ্টের সিকুয়েন্সে প্রকাশ করতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। আশা আর নিরাশা দুটোর প্রস্তুতি নিয়ে ফোনটা হাতে তুললাম। রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে এলো...।

লেখক পরিচিতি: ছাত্র, একাদশ শ্রেণি, সাভার সরকারি কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!