আরাফ যেভাবে একদিনে তিনটা রোজা রাখে

করোনাভাইরাস প্রকোপের এ সময়ে সবাই এখন বাড়িতে। বড় ভাইয়া আর আমার অফিস চলছে বাড়ি থেকেই, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আরাফের স্কুল আগে থেকেই ছুটি। তিনটে ঘরের দুটো দখল করে বসে আছি আমি আর ভাইয়া।

বিপুল জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2020, 10:59 AM
Updated : 13 May 2020, 10:59 AM

ডাইনিং স্পেস এখন পূর্ণমাত্রায় ফ্যামিলি স্পেস। কোয়ারেন্টাইনে আরাফ খুবই আনন্দে আছে। অবশ্য বিকেলের দিকে একটু খেলতে বাইরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বুঝিয়ে বলাতে বুঝে গেছে এখন বাইরে যেতে হয় না। বাবা আর চাচ্চুও তো তাই বাইরে যাচ্ছে না। বাইরে খেলতে যেতে না পারার কষ্ট ভুলে বরং বেশি আনন্দেই থাকছে বাবা আর চাচ্চুকে বাড়িতে পেয়ে।

বাবাকে একটু সমীহ করেই চলে। আর ওর বাবার অফিস মিটিং সারাক্ষণ চলতেই থাকে। ফলে দিনের বেলা বাবার ঘরে তেমন যেতে পারে না। আমার অফিস তুলনামূলক শিথিল ধরনের। আরাফ সারাক্ষণ তার নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার স্যাপার নিয়ে পরামর্শ করতে আসে আমার কাছে। আজ এসেই বিছানায় বসে বলল, চাচ্চু ছোটমানুষ রোজা করে কীভাবে?

আমি প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। দুদিন পর রোজা। বাসায় রোজা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। বাজার সদাই করা হয়ে গেছে। গৃহ সহকর্মীর বাড়িতেও তার সদাইপাতি পাঠানো হয়েছে। রোজার সময়ে একটা ভিন্নরকম প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় বাসায়। সেটা নিয়েও নানা রকম কথা হয়েছে। সেসব সময়ে আরাফকে দেখেছি চুপচাপ শুনতে। কেউ আলাদাভাবে আরাফের কথা না ভাবলেও এখন দেখা যাচ্ছে আরাফ রোজা নিয়ে ভেবেছে। গত বছরের রোজার কথা তার মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু এবারের ব্যাপার ভিন্ন। সে এখন স্কুলে যায়। সে এখন চারপাশ লক্ষ্য করে। মনে রাখে। 

আমি বললাম, তুমি রোজা রাখতে চাও?

হু। কিন্তু আমি না খেয়ে থাকতে পারছি না। না খেয়ে থাকতে চেষ্টা করেছি। বেশিক্ষণ থাকা যায় না।

বেশিক্ষণ থাকা যায় না?

না।

এখন কী করতে চাও?

তুমি বলো!

কি ব্যাপারে, সেটা বলো!

আরে রোজা রাখা নিয়ে, ছোটরা রোজা রাখে কীভাবে? নিয়মকানুন এইসব।

আমি মনে মনে হেসে উঠলাম। আসলে আজকের শিশুরা কত অ্যাডভ্যান্সড। আর কত প্রক্রিয়াগতভাবে সঠিক। আমরা এই বয়সে রোজা কি বুঝতামও না, রোজা রাখতামও না। আর এরা প্রথমেই বুঝতে চায়। তারপর সে কীভাবে রোজা রাখবে তা জানতে চায়। আমি অল্পকথায় রোজা কী তা বললাম।

রোজা হচ্ছে তুমি ভোররাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া করবে না, পানি খাবে না। এগুলো হলো একটা দিক। আরেকটা দিক হলো এই সময়ে তুমি কোন দুষ্টুমি করতে পারবে না। যেমন মিথ্যে কথা বলবে না, মারামারি করবে না, কোন কিছু নিয়ে জেদ করবে না। সব ঠিকঠাক হলেই রোজা হয়ে যাবে।

আমি তো মনে করতাম এগুলো কোন সময়ও করতে হয় না।

হা হা হা। ঠিক, কোন সময়ই করতে হয় না। আর অন্য সময় না করার জন্য তো অভ্যাস করতে হয়। রোজার সময় সেই অভ্যাসটা হয়ে যায়। আর না খেয়ে থাকার ফলে সবসময় মনে পড়ে যে সে রোজা। আর রোজার সময় এসব করা যায় না। ফলে তার এসব থেকে দূরে থাকার অভ্যাস হয়ে যায়।

আর?

আর মনে করো তুমি না খেয়ে আছো। ক্ষুধা লেগেছে এটা থেকে তুমি বুঝতে পারলে খাবার না থাকলে কত কষ্ট হয়। তাহলে তুমি অন্যসময় আর খাবার নষ্ট করবে না।

খাবার নষ্ট না করার জন্য রোজায় না খেয়ে থাকতে হয়? কিন্তু খাবার বেশি দিলে তো আমি খেয়ে শেষ করতে পারবো না। এতে আমার কি দোষ?

তা ঠিক। সেক্ষেত্রে তোমাকে দেয়ার সময়ই বলে দিবে যে আর দিও না।

ওকে।

আর শুধু খাবার যেন নষ্ট না করো সেজন্যই না, বরং অন্যরা না খেয়ে থাকলে তাদের কেমন কষ্ট হয় সেটাও যেন বুঝতে পারো সেটাও রোজার একটা শিক্ষা।

তাদের কষ্ট জানার পর? লিখবো? এটা আমার হোমওয়ার্ক? আরাফ বললো।

কষ্ট যদি তুমি জানতে পারো তবে তুমি বুঝে ফেলবা কী করতে হবে।

ওকে। কিন্তু আমি তো রোজা রাখতে পারি না। কষ্ট হয়।

তোমার জন্য নিয়ম আছে। শিশুদের আল্লাহ বেশি ভালোবাসেন তো, তাই তোমাদের বেশি বেশি রোজা করার সুযোগ দিয়েছেন।

সত্যি?

হুম। ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে একটা রোজা হয়ে যাবে। তারপর সকালে নাস্তা করে ফেলবে। আবার সকাল থেকে দুপুর না খেয়ে থাকবে। একটা রোজা হয়ে যাবে। তারপর দুপুরে খেয়ে নিবে। আবার সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থেকে সবার সঙ্গে ইফতার করববে। ব্যস, তোমার তিনটে রোজা একসঙ্গে হয়ে যাবে।

আমি খেলামই তো, তাহলে আমার রোজা হলো কই? আরাফ জিজ্ঞেস করে।

হবে। মনে করো, তুমি এসবের মাঝে, চিপস, চকলেট এইসব খেলে না বা দুষ্টুমি করলে না, আম্মুকে জ্বালাতন করলে না। গোসলের সময় হলেই গোসল করে ফেললে। তুমি যদি মেনে চলো তাহলেই রোজা হয়ে যাবে।

আর তোমাদের মতো বড় রোজা কবে রাখতে পারবো?

যখন আমাদের মতো বড় হবে তুমি।

এইকথা বলে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে দিলাম। আরাফ চিন্তিত মুখে রুম থেকে বের হলো। এতক্ষণ ধরে যে কথা বলছিলাম ও হয়ত সেকথা-ই ভাবছিল। সন্ধ্যায় অফিসের ঝামেলা শেষ করে অনলাইন থেকে অফলাইন হয়েছি। পাশের ঘরে বেশ একটু উত্তপ্ত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। আরাফের প্রশ্ন আর ওর মায়ের বকাঝকা। সঙ্গে আরাফের আব্বুর হাসি। কিছুক্ষণ পর আরাফ দেখি একটা কাগজ নিয়ে হাজির। 

হাসি হাসি মুখে বলল, আমার সেহরি আর ইফতারের টাইম ঠিক করে দাও। 

ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতে জানা গেল আরাফের আব্বু সেহরি আর ইফতারের টাইম টেবল প্রিন্ট আউট করেছে। কিন্তু সেখানে আরাফ দেখে আরাফের সেহরি ইফতারের সময়সূচি নেই। আরাফ জিজ্ঞেস করেছে তার ইফতারের সময় নেই কেন? ছোটদের ইফতারের ব্যাপার আম্মু জানে না দেখে আরাফ খুব করে বুঝিয়েছে আজ সকালের প্রাপ্ত জ্ঞান। হার মেনে তার মা বলেছে, তোর চাচ্চু ছোটদের রোজা সম্পর্কে জানে যখন তাহলে ছোটদের ইফতারের সময় হয় কখন সেটাও নিশ্চয়ই জানবে। এই কথা বলে হাতে একটা সাদা কাগজ ধরিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু লিখলেই তো আর হবে না। আরাফের খাবার তৈরিও তো হতে হবে। আর সেটি অবশ্যই রসুইখানা আওতাধীন। ফলে আরাফকে নিয়ে চললাম ভাবীর খোঁজে। গৃহ সহকর্মী না থাকায় আরাফের বু (দাদী) আর আরাফের আম্মুই সব কাজ সামলাচ্ছে। ফলে এ বিষয়ে তাদের সায় ও পরামর্শ ছাড়া যে কোন একটা সময় লিখলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আরাফ আর আমি, দুই অপরাধীর চেহারা দেখেই দুই বিচারক আরাফের আম্মু আর বু বলে উঠলো, লিখে দাও একটা সময়। কোন অসুবিধে নেই। 

সকালের খাবার সাড়ে আটটায় আর দুপুরের খাবার দেড়টায়?

না, সকালের খাবার নয়টায়।

ব্যস। অল্পকথায় কাজ সেরে ফেলতে পারায় আমরা চাচা ভাইপোতে খুবই খুশি। আর সেইভাবেই হয়ে গেল। আরাফের রোজার বিশেষ সেহরি ও রোযার সময়সূচি। সেই সময়সূচি অনুযায়ী আরাফ প্রতিদিন রোজা রেখে চলেছে। আমাদের একটা রোজা হয় আর আরাফের হয় তিন তিনটে।

আর হ্যাঁ, রোজার ভেতরে আরাফ একদম দুষ্টুমি করে না। সন্ধ্যার পর একটু বেশি লাফালাফি করলে বা ঝাপাঝাপি করলে তাকে যদি চুপ করে বসে থাকতে বলা হয় তবে সে অবাক হয়ে বলে, কেন? এখন তো রোজা না? রোজা তো দিনের বেলা, তাই না?

তার এই মোক্ষম প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে না।

এই লেখকের আরও লেখা

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা  kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!