হোমওয়ার্ক করতে আরাফের যে কারণে ভালো লাগে না

আমাদের লক্ষ্মীবাচ্চা আরাফ হঠাৎ করে বিগড়ে গেছে। বিগড়ে গেছে মানে সে ঘোষণা দিয়েছে সে হোমওয়ার্ক করবে না। তার হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগে না।

বিপুল জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2019, 07:45 AM
Updated : 9 Nov 2019, 07:49 AM

আজ বাড়ি ফিরতেই ভাবি এসে বলল, নাও তোমার ভাতিজা। সামলাও। যেমন ঝড়ের মতো ভাবি এলো তেমনি ঝড়ের মতো চলে গেল। আরাফ দেখি স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে।

কিরে বেটা? কি খবর?

খবর ভালো।

আম্মু রাগছে কেন?

আম্মু হোমওয়ার্ক করতে বলছে, আমি বলছি হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগে না। আম্মু বলছে, কেন ভালো লাগছে না? আমি বলছি জানি না। তারপর আম্মু বলছে...

বলছে কিরে বেটা, বলেছে...

তুমিওতো বলছে বলো...

ভুল বলি। আর বলবো না।

ওকে। আম্মু তখন বলল, ভালো না লাগলেও আমরা অনেক কিছু করি, করতে হয়। আসো, হোমওয়ার্ক করো। আমি তখন বলেছি, না, যা ভালো লাগে না তা করতে হয় না। চাচ্চু বলেছে।

বলেই আরাফ ফিক করে হেসে ফেলল।

হাসিস কেনরে বেটা? আম্মুকে রাগিয়ে দিয়ে খুব হাসা হচ্ছে না?

কই আমি রাগিয়ে দিয়েছি? আম্মু রেগে গেলে আমি কি করবো? আম্মু যেভাবে রেগে গিয়ে বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো সেটা মনে করেই এখন হাসি পেল।

তুই হাসতেছিস আর আমিতো ভয়ে শেষ।

কেন, কেন? ভয় কেন চাচ্চু?

যেমন রেগে গিয়েছে তাতে তোর কি মনে হয় আজ আমাদের রাতে কিছু খেতে দেবে? যদি না খাইয়ে রাখে?

কেন?  না খাইয়ে রাখবে কেন?

আমরা অপরাধী না?

আমরা অপরাধী মানে? আমাদের অপরাধ কী?

ছোট্ট আরাফ অপরাধ মানে কী জানে। মোড়ের মাথায় কিছুদিন আগে সকাল বিকেল 'মেয়ে তুই অপরাধী' বলে এক গান বাজতো। সেটা শুনে আরাফ জিজ্ঞেস করেছিল, চাচ্চু অপরাধী মানে কী? তখন অপরাধ এবং অপরাধী কী তা তাকে সে বুঝতে পারে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেও এক গল্পই বটে। থাক সেদিনের কথা।

আমি তার এখনকার উত্তরে বললাম, বাহ, আমরা অপরাধী না? আমাদের হোমওয়ার্ক করার কথা, সেটা করছি না তাহলে আমরা অপরাধী না?

কিন্তু চাচু, যা ভালো লাগে না সেটা করাও তো ঠিক না, তাই না?

হু।

তাহলে এখন জোর করে হোমওয়ার্ক করলেও তো আমরা অপরাধী হয়ে যাবো, তাই না?

হু। সমস্যা সেটা না। হোমওয়ার্ক এমন একটা জিনিস সেটা করতে সবার ভালো লাগে। ভালো লাগছে না মানে অন্যকিছুতে কোনো সমস্যা হয়েছে। আমাদের সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। বুঝেছিস?

হু।

গুড। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় সেটাতো বুঝতে পারছি না। তুই কিছু বুঝতে পারছিস?

হু। তোমার মোটু-পাতলুর মোটুর মতো হয়েছে। খালি পেটে তোমার মাথা কাজ করে না।

ঠিক বলেছিস। একদম ঠিক। আয়তো দেখি এরা আমাদের কিছু খেতে দেয় কিনা।

আরাফকে পিঠে নিতে নিতে বললাম, তোর মোটু ক্ষুধা পেলে কী খায়? মানে কী খেলে তার বুদ্ধি বের হয়?

সমুচা।

আরাফের দাদি যাকে ও বলে 'বু' মানে আমার আম্মু বলল, এই সন্ধ্যেবেলায় আর তেলেভাজা সমুচা খেতে হবে না। দুধ সেমাই রেঁধেছি, দুজনে খাও। আর খেয়ে পড়াশোনা করো। আম্মু কিন্তু অনেক রাগ করেছে।'

আরাফের আম্মু রাগ যে করেছে আমি আর আরাফ দু'জনেই বুঝেছি। আর বুঝেছি বলেই ভালো ছেলে হয়ে আমরা দুধ সেমাই খাচ্ছি, নইলে আমরা নুডলস নুডলস বলে আন্দোলন শুরু করতাম।

কিন্তু আমরা থামলে কি হবে, আরাফের 'বু', আমার আম্মু, তিনি থামছেন না। তিনি বলেই চলেছেন, আজ হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগছে না, কাল স্কুল যেতে ভালো লাগছে। এই সব চলবে। আর আরেকজন এইসব প্রশ্রয় দিচ্ছে।

এই ফাঁকে আরাফ আবার আমাকে প্রশ্ন করলো, ‘প্রছ্রয়’ কী? আমি বললাম, ‘প্রছ্রয়’ না প্রশ্রয়।  পরে বলছি এখন না।

আরাফের বু তখনও বলে যাচ্ছে, এখন শুরু হয়েছে ইমোশনাল ব্লাকমেইল। হোমওয়ার্ক করবে না। কি? না, ভালো লাগে না। আর করবে না যে বললি তাতে আম্মুর কি খুব ভালো লেগেছে। আম্মু কত্ত কষ্ট পেল! কেউ কোনদিন আম্মুকে কষ্ট দেয়? তোর চাচু কখনও হোমওয়ার্ক ফেলে রেখেছে? স্কুল থেকে এসেই কোন কোন দিন টেবিল-চেয়ারে বসে যেত। হোমওয়ার্ক করতে।

আরাফ অবাক হয়ে বলল, তাই চাচ্চু। স্কুল থেকে এসেই হোমওয়ার্ক করতে?

আমি বলে উঠলাম, পেয়েছি!

কী পেয়েছো?

পেয়েছি কেন তোমার হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগছে না। সম্ভবত।

প্রবল উত্তেজিত আমরা দু'জন টেবিল ছেড়ে যেতে গেলেই আম্মু হাজির , খাওয়া শেষ করে যাও।

আরাফ বললো, ওকে, ওকে। শেষ করেই যাচ্ছি। চাচু, তুমি আবার ভুলে যেও না কথাটা।

আমি বললাম, এখন আর কোন কথা বলা যাবে না। কথা বললেই ব্যাপারটা ভুলে যাবো।

তাহলে কথা বলো না। কেন কথা বলছো?

আমি বললাম, ওকে, ওকে।

তারপর আম্মু বিখ্যাত দুধ সেমাই খেয়ে এবং আম্মুকে থ্যাংক্স জানিয়ে আমরা দু'জন ফিরে এলাম আমাদের ডেরায়। আরাফ ডেরা অর্থ জানে। হিন্দিতে চ্যানেলে ডেরা শব্দ শুনে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বাংলা ডেরার অর্থ বলে দিয়েছি।

ঘরে এসে বললাম, তোমার কি এতদিন হোমওয়ার্ক করতে খারাপ লাগতো?

না।

যে কাজগুলো করতে দিয়েছে সেগুলো নিয়ে কোন আপত্তি আছে?

না।

আমি হেসে বললাম, তার মানে যে পরিবেশে তুমি এখন হোমওয়ার্ক করছো সেটা তোমার মধ্যে অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। পরিবেশ চেঞ্জ করতে হবে।

মানে?

মানে হলো তোমাদের স্কুলে তোমরা কোথায় বসো, লেখো কোথায়?

কেন, ক্লাসরুমে!

ওহহো, ক্লাসরুমের কথা হচ্ছে না। বলছি কিসের উপর বসো?

চেয়ারের উপর বসি।

চেয়ার? এরকম চেয়ার এতো বড়?

এতো বড় হবে কেন? বাচ্চারা এই চেয়ারে বসে লিখতে পারে? ছোট ছোট চেয়ার। প্লাসটিকের। রঙিন।

কী রঙের?

একেকটা একেক রঙের। হলুদ, লাল, সবুজ ,নীল, কমলা, বেগুনি। খুব সুন্দর।

ওর মুখ এখন বেশ হাসি হাসি।

আর লেখো কিসে? মানে কিসের উপরে রেখে?

ডেস্কে! ওগুলোও রঙিন। জানো চাচু, আমাদের স্কুলের নিয়ম হলো যে রঙের চেয়ার সে রঙের ডেস্ক একসাথে থাকবে না। অন্য রঙের হবে। লাল চেয়ারের সঙ্গে কখনও লাল ডেস্ক থাকে না।

কী থাকে? সবুজ?

সবুজ হতে পারে, নীল হতে পারে, হলুদ হতে পারে। কিন্তু লাল না।

এখন ব্যাপার হলো, তুমি ডেস্ক-চেয়ারে লিখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ। তাই বিছানায় লিখতে তোমার অস্বস্তি হয়। তাই তোমার হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগে না। যদিও হোমওয়ার্ক হিসেবে যে কাজগুলো দেয়া হয়, হয়েছে সেগুলো তোমার ভালোই লাগে।

কিন্তু চাচ্চু আমি তো আগে থেকেই বিছানায় পড়েছি, স্কুলে ভর্তি হওয়ারও আগে এখন বিছানায় লিখতে আমার খারাপ লাগবে কেন?

কারণ আগে তুমি স্কুলে যেতে না। এখন তুমি প্রতিদিন স্কুলে চার পাঁচ ঘণ্টা করে থাকো। তুমি ডেস্ক-চেয়ারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছো। আর লেখাপড়ার কাজ করার জন্য চেয়ার-টেবিল জিনিসটা ভালোই। সব অফিসেও আছে।

তাহলে?

তাহলে আগামীকাল অফিস থেকে ফেরার সময় তোমার জন্য আমি ভিন্ন ভিন্ন রঙের চেয়ার আর ডেস্ক নিয়ে আসবো।

আর আজ?

আজ আমার চেয়ার টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক করো তুমি।

আরাফ কী বলবে বুঝেই আমি, লেট মি ফিনিস, লেট মি ফিনিস। তুমি ঠেই পাবে না। তাই আমার চেয়ার বালিশ, কাঁথা, কম্বল দিয়ে উচু করে দেব যেন তুমি ঠিক ঠাক ঠেই পাও। ওকে?

ওকে।

তারপর আমরা আরাফদের ঘর থেকে বইয়ের ব্যাগ এনে হোমওয়ার্ক করে ফেললাম। তারপর আরাফের আব্বু এলো। আমরা একসঙ্গে খেতে বসলাম। আরাফ লক্ষ্মীছেলের মতো হোমওয়ার্ক শেষ করেছে বলে ওর আম্মুও ওকে লক্ষ্মীছেলের প্রাপ্য আদর গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিল।

তখন আমি বললাম, কাল আমি আরাফের জন্য ডেস্ক আর চেয়ার নিয়ে আসবো। ছোট ডেস্ক, ছোট চেয়ার। ওদের স্কুলেও আছে।

কি ছেলেরে বাবা? চাচুর কাছে বায়না করেছে।

আম্মুরা মনে হয় একটু বেশি বোঝে। আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম, না না। ও বলেনি। আমরা গবেষণা করে বের করেছি।

আরাফের আব্বু অবাক হয়ে বলল, গবেষণা?

আরাফ তাড়াতাড়ি করে বলল, কোন কিছু চিন্তা ভাবনা করে বের করাকে ‘গবেষণা’ বলে বাবা।

মুচকি হেসে ওর আব্বু বলল, ও, তাই বুঝি!

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!