কাফকার প্রাগ, প্রাগের কাফকা

কল্পনা করুন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলেন পরিণত হয়েছেন আস্ত এক পোকায়!

কাউসার রুশোকাউসার রুশো
Published : 5 June 2023, 07:43 PM
Updated : 5 June 2023, 07:43 PM

গন্তব্য প্রাগ। যাত্রা বিরতি ফ্রাঙ্কফুর্টে। ইমিগ্রেশন কার্যক্রমও এখানেই। জার্মান অফিসার প্রাগ যাচ্ছি শুনে রীতিমত ভিরমি খেলেন! ‘হোয়াই প্রাগ?’ আমি বললাম, ঘুরতে যাচ্ছি।

জবাব শুনে অফিসার তেমন প্রীত হলেন বলে মনে হলো না। ফলস্বরূপ পরবর্তী মিনিট পনেরো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হলো। এই প্রশ্ন সেই প্রশ্ন শেষে জিজ্ঞেস করলেন, প্রাগে দেখার কী আছে? আমি কয়েকটা জায়গার নাম বললাম। তারপর একটু থেমে বললাম, ‘কাফকা মিউজিয়াম’। কাফকার নাম শুনেই কিনা জার্মান মশাই আমাদের পাসপোর্টে সিলমোহর বসিয়ে বিদেয় করে দিলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম!

প্রথমবারের মতো প্রাগে এসেছি। আর এসেই ভ্লতভা নদীর তীরে গড়ে ওঠা বোহেমিয়া অঞ্চলের এ শহরটির প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রাগের পাথুরে রাস্তা, দৃষ্টিনন্দন ঘর-বাড়ি, সাপের মত আঁকাবাঁকা ট্রাম লাইন, ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজ, ওল্ড টাউন সবকিছুর মাঝেই রয়েছে জাদুকরি সৌন্দর্য। ইউরোপের শিল্পকলা, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান যে এই প্রাগ, তা শহরটির অলিগলি দিয়ে হেঁটে গেলেও টের পাওয়া যায়।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে প্রাগ উদ্ভাসিত হয় অস্তিত্ববাদী লেখক ফ্রানৎস কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) জন্যই। কল্পনা করুন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলেন পরিণত হয়েছেন আস্ত এক পোকায়! অথবা এক সকালে পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেপ্তার করলো, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী আপনি জানেন না, কেউ বলছেও না। এমনই সব অন্ধকারময় অদ্ভুত ঘটনাপ্রবাহ দিয়ে কাফকা গল্প ফেঁদেছিলেন শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতার, সমাজের নানা কুৎসিত দিক, সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন নিয়ে। মাত্র ৪১ বছর বয়সে যার বিষাদগ্রস্ত জীবন ক্ষয় হয়েছিলো যক্ষ্মায় ভুগে। অথচ মৃত্যুর পর যিনি জগৎজোড়া খ্যাতি পেয়েছিলেন তার সাহিত্যকর্মের জন্য।

নোবেল বিজয়ী ত্রিশজনেরও বেশি সাহিত্যিক স্বীকার করে নিয়েছেন তাদের লেখায় কাফকার প্রভাব আছে। বিশ্বখ্যাত কলম্বিয়ান সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ পড়েই তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন। সাহিত্যে একটি টার্মই সৃষ্টি হয়েছে ‘কাফকায়েস্ক’। কাফকার লেখা গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে কিংবা অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার অগণিত চলচ্চিত্র। হলিউডের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অরসন ওয়েলেস কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ অবলম্বনে ১৯৬২ সালে নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র। কত শত মানুষই চেষ্টা করেছেন এবং করছেন কাফকাকে ব্যাখ্যা করতে। তবে এ প্রসঙ্গে চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরার ব্যাখ্যাটাই মনে হয় ঠিক। কুন্ডেরা বলেছেন, ‘কাফকাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা না করাই ভালো।’

ফ্রানৎস কাফকার জন্ম ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই, তৎকালীন বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী প্রাগে। প্রাগ তখন ছিলো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের চেকোস্লোভাকিয়ার অধীনে। ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে কাফকা সবার বড়। ফ্রানৎস কাফকার বাবা হারমান কাফকা প্রথম জীবনে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। পরবর্তীতে সৈনিক জীবন ছেড়ে প্রাগের কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসের দোকান দিয়ে ব্যবসায় নামেন। মাঝে কিছুদিন ফেরিওয়ালার কাজও করেছিলেন। এ ব্যবসাই কাফকাদের দীর্ঘমেয়াদী পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়। কাফকার মা ইয়ুলি কাফকা ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। তিনি তার স্বামীর চেয়েও বেশি শিক্ষিত ছিলেন। ব্যবসায় ব্যস্ত থাকায় তারা দুজনই সন্তানদের খুব একটা সময় দিতে পারতেন না।

কাফকা কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়তে শুরু করলেও সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই বিষয় পরিবর্তন করে আইনের ছাত্র বনে যান। আইনশাস্ত্রও তার খুব পছন্দের ছিল না।  কিন্তু কাফকার বাবা খুশি হয়েছিলেন এই ভেবে যে, ছেলে তার হবে মস্ত বড় উকিল। ছাত্রবস্থা থেকেই সাহিত্যচর্চার প্রতি কাফকার ঝোঁক ছিলো। আগাগোড়া একজন লেখক হতে চেয়েছিলেন কাফকা। কিন্তু জীবিকার তাগিদ আর পিতার প্রতি ভীতি ও সম্পর্কের দূরত্ব তাকে কষ্ট দিয়েছে। এসব বিষয় তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই কাফকার পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ম্যাক্স ব্রডের সঙ্গে। এই ম্যাক্স ব্রড মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ, তা পরে বলছি।

কাফকা পড়াশোনা শেষে আইনজীবী হিসেবে একটি বীমা কোম্পানিতে কাজ করেছেন বহু বছর। যদিও উপভোগ করেননি। প্রায়ই শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকতেন। বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়েছেন, প্রেম করেছেন। কিন্তু সবই ছিলো অসুখী সম্পর্ক। জীবিত অবস্থায় লেখালেখি করেও নাম করতে পারেননি। এসব কিছুই পীড়া দিত কাফকাকে।

ফিরে আসি প্রাগে। সমগ্র প্রাগ শহরটাই কাফকাময়। তার নামে একাধিক ক্যাফে আর শপ রয়েছে প্রাগে।  সবার আগে দেখতে গেলাম ইহুদি কোয়ার্টারে কাফকার বিখ্যাত ভাস্কর্যটি । মস্তকবিহীন এক মানবের ঘাড়ে চেপে বসে আছেন জনাব কাফকা। ১৯১২ সালে লেখা কাফকার ‘ডেসক্রিপশন অফ অ্যা স্ট্রাগল’ গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন জারোস্লাভ রোনা। ২০০৩ সালে ভাস্কর্যটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

পরের গন্তব্য কাফকা জাদুঘর। সেজন্য পাড়ি দিতে হবে চার্লস ব্রিজ। এই চার্লস ব্রিজ প্রাগের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। চৌদ্দ শতকে নির্মিত পাথরের এ সেতুটি প্রাগ শহরের দুই প্রান্তকে জুড়েছে। ষোল শতকের শুরু আর সতেরো শতকের শেষভাগে এ সেতুর দুধারের রেলিংজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে অপূর্ব সব ভাস্কর্য। ট্যুরিস্টদের পদচারণায় মুখরিত এই ব্রিজটিতে প্রতিদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন এক আনন্দমেলা বসে। শিল্পীরা ছবি আঁকছেন, বাদকরা বাজাচ্ছেন অদ্ভুত সব বাদ্যযন্ত্র, ফেরিওয়ালারা নিয়ে বসেছেন খুশির হাট।

তবে চার্লস ব্রিজে কোন গাড়ি চলাচল করতে পারে না। পদব্রজেই পার হতে হয়। কিন্তু চার্লস ব্রিজে হেঁটে বেড়ানো অসামান্য অভিজ্ঞতা। আমার সৌভাগ্য এই ব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যটাকে ভ্লতভা নদীতে হারিয়ে যেতে দেখেছি। ব্রিজের শেষ মাথায় গেলে পাওয়া যায় প্রাগের ঐতিহ্যবাহী ট্রেডেলনিক কেক। ইংরেজি ‘o’ আকৃতির এই কেকের মধ্যে আইসক্রিম বা হুইপড ক্রিম দিয়ে খেতে হয়ে। এ ট্রেডেলনিক চিবোতে চিবোতে রওয়ানা হলাম কাফকাদর্শনে।

চার্লস ব্রিজ পেরিয়ে ওল্ড টাউনকে একপাশে রেখে আরেকটু ভেতরের দিকে কাফকা জাদুঘরের অবস্থান। জাদুঘর ভবনের আকৃতি অনেকটা অর্ধচন্দ্র বা ইংরেজি ‘সি’-এর মতো। মিউজিয়ামের গ্যালারি নদীর ধার ঘেঁষে। মাঝে একটা ক্যাফে আর গ্যালারির বিপরীত দিকে স্যুভেনির শপ। খালি জায়গাটাতে রয়েছে ‘পেস’ (Piss) নামে বিখ্যাত এক ভাস্কর্য, এ ভাস্কর্যের শিল্পী ডেভিড চার্নি। স্থানীয় ‘দ্য প্রাগ পোস্ট’ পত্রিকা এটিকে প্রাগের ১০টি বিস্ময়কর ভাস্কর্যের মধ্যে সবার সেরা বলে প্রতিবেদন ছেপেছে।

তার একপাশে বিশাল আকারের ইংরেজি ‘কে’। গ্যালারির অভ্যর্থনা কক্ষেই টিকেট কাউন্টার। মধ্যবয়সী এক নারী স্মিত হেসে স্বাগত জানালেন। টিকেটের দাম ২০০ চেক করুনা বা ক্রাউন। আমার কাছে চেক মুদ্রা ছিলো না, তাই ইউরো দিয়েই টিকেট কাটলাম। পুরো চেক রিপাবলিক জুড়ে ইউরোর প্রচলন থাকলেও এরা নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

জাদুঘরে ঢুকতেই একটা কাঠের সিঁড়ি। তারপর যেন এক গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেলাম। পুরো জায়গাটা অন্ধকার করে রাখা। দেয়াল সাজানো ছবি আর লেখা দিয়ে। সেখানে শোভা পাচ্ছে কাফকার বিভিন্ন বয়সের ছবি, বাড়ির ছবি, কাফকা পরিবারের ছবি ইত্যাদি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে অন্ধকার থেকে অস্বস্তিকর এক লাল আলো ঘিরে ফেলে। কাফকার গল্পের চরিত্রগুলো নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে জীবনের মানে যেভাবে খুঁজে বেড়ায়, আমিও যেন খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। 

তবে জাদুঘরে সব মিলিয়ে খুব বেশি কিছু নেই। কাফকার লেখা কিছু চিঠি প্রদর্শিত হচ্ছে জাদুঘরটিতে। এসব চিঠির মধ্যে রয়েছে নিজের পিতাকে লেখা, প্রেমিকা মিলেনাকে লেখা আর বন্ধুদের লেখা চিঠি। এছাড়া আছে কাফকার আঁকা ছবি, পাণ্ডুলিপি এবং বইয়ের বিভিন্ন সংস্করণ আর প্রচ্ছদ। কাফকার লেখা চিঠি আর বই থেকে উদ্ধৃতি টাঙানো আছে জাদুঘরের দেয়ালে।

জাদুঘর থেকে বেড়িয়ে স্যুভেনির শপে ঢুঁ মারলাম। তারপর চার্লস ব্রিজ ধরে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। জাদুঘর ঘুরে ভাবছিলাম কাফকার জীবনের কথা, তার লেখার কথা। আর ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে। জীবন সায়াহ্নে কাফকা নিজের সমস্ত পাণ্ডুলিপি ম্যাক্সকে দিয়ে বলেছিলেন, সব লেখা পুড়িয়ে ফেলতে। কিন্তু ম্যাক্স লেখাগুলো না পুড়িয়ে, বন্ধুর মৃত্যুর পর সেগুলো ছাপাতে শুরু করেন। ম্যাক্সের কল্যাণে সবার পরিচয় ঘটে সাহিত্যের এক দুঃখী রাজপুত্রের সঙ্গে। আর কাফকা হয়ে উঠেন জগৎবিখ্যাত। ভাগ্যিস ম্যাক্স কাফকার কথা রাখেননি!