নানাবাড়ি মামাবাড়ি

ছোটবেলায় বাঙালি নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াতাম। নদীর পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের জীবন ও তাদের সংগ্রাম দেখতাম।

তাসনিম সাজিদতাসনিম সাজিদ
Published : 17 March 2024, 07:18 AM
Updated : 17 March 2024, 07:18 AM

আমার নানাবাড়ি বগুড়ার দেবডাঙ্গা গ্রামে, যমুনা ও বাঙালি নদীর মধ্যবর্তী তীরে। সেখানে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। একসময় শহরে চলে এলেও আমার মা ওখানকার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় মাঝেমধ্যেই মায়ের সঙ্গে নানুবাড়ি যাওয়া হতো।

ছোটবেলায় বাঙালি নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াতাম। নদীর পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের জীবন ও তাদের সংগ্রাম দেখতাম। হাঁটতে হাঁটতেই চোখের সামনে উদয় হতো লাল টকটকে সূর্য। গ্রামে খুব ভোরে বাজারে বেচাকেনা হতো। বাজার পার হতেই দেখা যেত যমুনা নদীর পাড়। নদীর ধারে দখিনা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে ফিরতাম ঘরে। দেখতাম নানি সকালের নাস্তা তৈরি করে রেখেছেন। বানিয়েছেন নানির হাতের আমার পছন্দের সেই লাল আটার রুটি, ডিম পোঁচ ও সবজি।

নাস্তা সেরে নানি ‘বাইডগ্যা’ বসতে বলতেন। উঠোনকে বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘বাইডগ্যা’। বাইডগ্যা বসে নানা ভাইয়ের সঙ্গে পত্রিকা পড়তাম। খানিকক্ষণ পরেই নানি হাজির হতেন দুধ-চা আর মুড়ির মোয়া নিয়ে। একদিন মধ্যসকালে আমরা ভাই-বন্ধুরা পরিকল্পনা করলাম নদীতে গোসল করার। মূলত আমরা কেউই সাঁতার না জানায় মামা আমাদের সঙ্গে নিয়ে গেলেন। কখনও জমিতে পানি সেচ দেওয়ার শ্যালো মেশিনের পাইপের তলে গোসল করতাম।

নানাবাড়ির পেছনে একটি বাঁশবাগান ছিল। বাঁশ দিয়ে তৈরি এক ধরনের বসার আসন থাকতো, আমরা সেটাকে ‘চরাট’ ডাকতাম। খুব শীতল ছিল জায়গাটা, গ্রীষ্মের দুপুরে আমরা সেখানে বসে গল্প করতাম। গ্রামে মাঝে মাঝে পরিত্যক্ত হাঁড়িপাতিল, আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপাতি কেনার জন্য ভাঙারির লোক আসত। বিনিময়ে তারা টাকা অথবা খাবার জিনিস দিত, যেমন- চানাচুর, বাদাম, বুট ভাজা এসব। মাঝেমধ্যে আমি টিনের টুকরো, পুরনো লোহা-লক্কড় নিজের কাছে সংরক্ষণ করতাম, আর অপেক্ষা করতাম কবে আসবে সেই মামা যিনি এসে আমার কাছ থেকে এসব ভাঙাচোরা নেবেন, বিনিময়ে বাদাম খেতে দেবেন!

বিকেলবেলা আমাদের ক্রিকেট, ফুটবল, কানামাছি, চোর-পুলিশসহ যে কত খেলার আসর বসত! খেলা শেষ হতে যখন মাগরিবের আজান পড়ত তখনই ঘর থেকে নানা ভাইয়ের ডাক পরত। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতে বলতেন, কখনো একটু দেরিতে ঘরে ফিরলে আচ্ছামতো বকুনি খেতে হতো। কখনো কখনো বিকেলে নানা ভাইয়ের সঙ্গে হাটে যেতাম। হাট থেকে নানা ভাই আমার পছন্দের মাছ, মাংস, শাকসবজির সঙ্গে কিনতেন আমার প্রিয় তিলের খাজা, বাতাসা, সন্দেশ এসব। গুড় আর বাদাম দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার, নাম তার বাদাম পাটালি। আমাদের গ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় ওটাকে ‘নৈ’ বলে ডাকে। নানা ভাইয়ের কাছ থেকে নৈ খাওয়ার জন্য কত যে বায়না করেছি!

গ্রামে রাতে অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুৎ থাকত না, তাই হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসতাম। নানি হারিকেনের আলোতে রাতের খাবার খেতে দিতেন। আমাদের বাড়ির উঠোনে একটা বিশাল চৌকি থাকত। গরমের সময় রাতের বেলা আমরা সব ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন সেই চৌকিতে বসে থাকতাম। সেখানে একরকম গল্পের আসর বসে যেত, মায়ের মুখে কতো যে ভূতের গল্প শুনেছি। 

শীতের সকালে নানি তৈরি করতেন প্রিয় মজার সব পিঠা, পায়েস, নাড়ু ইত্যাদি। ছিল দুধ পিঠা, পাটিসাপটা, নারিকেলের নাড়ু, জামাই পিঠা, পুলি পিঠা ও চিতই পিঠা ইত্যাদি।

গ্রামের মানুষের রাতে কোন কাজকর্ম থাকত না, তাই সবাই রাতে ঘুমোতে বেশি দেরি করত না। রাত নয়টা-দশটা বাজার আগেই সবাই ঘুমিয়ে যেত। আমরাও তাই সকাল সকালই ঘুমাতাম। নানি মশারি টানিয়ে দিতেন। আমি নানির সঙ্গে ঘুমাতাম। নানি মজার মজার গল্প বলে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।

মনে পড়ে শীতের সময়ের কথা, সন্ধ্যাবেলা আমরা বন্ধুরা কাঠ, লাকড়ি জ্বালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করতাম। একদিন শীতের সন্ধ্যার এক মজার কলার ঘটনা বলি- আমরা বন্ধুরা একটা কলাবাগানের সন্ধান পাই। পরিকল্পনা করি আজ কলা পুড়িয়ে খাব। সবাই লুকিয়ে কাঁচাকলা চুরি করলাম, তারপর সে কলা আগুনে পুড়িয়ে ঝাল-লবণ মাখিয়ে খেলাম। পোড়া কলা খেতে কতোই যে মজা লাগত!

শীতের সকালে নানি তৈরি করতেন প্রিয় মজার সব পিঠা, পায়েস, নাড়ু ইত্যাদি। ছিল দুধ পিঠা, পাটিসাপটা, নারিকেলের নাড়ু, জামাই পিঠা, পুলি পিঠা ও চিতই পিঠা ইত্যাদি। নানি যখন চিতই পিঠা বানাতেন, আমাকে তখন মরিচ ও ধনিয়া পাতার ভর্তা দিয়ে খেতে দিতেন। আহা! সেই ঝাল আর গরম গরম পিঠার স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে।

শীতের সকালের দুটি মজার খাবারের কথা বলি যা ছাড়া আমার শীত পরিপূর্ণই লাগত না। রাতে যখন ভাত বেঁচে যেত তখন সে ভাত নানি সংরক্ষণ করতেন। সেই ভাত সকালে তেল-মরিচ-ধনিয়া পাতা, পেঁয়াজ এসব দিয়ে মাখিয়ে ভাজতেন। সেই ভাত ভাজাকে আমরা ‘করকরা ভাজা’ বলে ডাকতাম। খেতে খুব মজা লাগত। আরেকটি খাবারের নাম হচ্ছে খুদ সেদ্ধ বা খুদের ভাত, এটা তৈরি করা হয় খুদ বা ভাঙা চাল দিয়ে। সেই খুদ সেদ্ধ আমার বড় মামি শুঁটকি মাছভর্তা, ধনিয়া পাতা ও মরিচ দিয়ে মাখতেন। খেতে খুব মজা লাগত।

একটা মজার অ্যাডভেঞ্চার বলি- আমার নানা ভাই এলাকায় অনেক সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতেন। কোন স্থানে ঝগড়া-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হলে সবাই নানা ভাইকে ডাকতেন, নানা ভাই সমস্যার সমাধান করতেন। একবার আমাদের গ্রাম থেকে ৪-৫ কিলোমিটারের মতো দূরে একটা গ্রামে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়, সেখানে নানা ভাইকে ডেকেছিল। আমরা সব ভাইয়েরা প্ল্যান করি আমরা ওখানে যাব। নানা ভাইকে না জানিয়ে তার পেছন পেছন যাই। আমাদের সঙ্গে নিয়েছিলাম কলা, রুটি এসব। আমাদের তখন অনুভূতি ছিল যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিচ্ছি। পরে অবশ্য এজন্য নানা ভাইয়ের বকুনি খেতে হয়েছিল।

এখন আর নানাবাড়ি যাওয়া হয় না। নানি-নানা ভাই দুজনেই অসুস্থ, নানি হাঁটতে পারেন না। মনে পড়ে নানির হাতের সেই তৃপ্তির রান্না, মনে পড়ে নানাবাড়ি।