বেটোফেনের জানালায়

এ সঙ্গীতকার সৃষ্টি করেছেন সোনাটা ও সিম্ফনি, বাজিয়েছেন পিয়ানো অর্কেস্ট্রা৷

মেহনাজ আলতাফমেহনাজ আলতাফ
Published : 2 June 2023, 05:52 PM
Updated : 2 June 2023, 05:52 PM

কাঠের মেঝেতে পা দিতেই মনে হলো যেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে দেখলাম, পাশে পাশে হাঁটছেন আর মাথা নাড়ছেন, আমার দিকে তাকিয়ে যেন বললেন, ‘কিরে, বলেছিলাম না, ঠিক আমার মতো?’

দাঁড়িয়ে ছিলাম বেটোফেনের বাড়ির দোতলা বারান্দায় কাঠের পেঁচানো সিঁড়িটির পাশে। সেদিন রোদ হেসেছিল। তেমনি বৃষ্টি শুরু হচ্ছিল আচমকা। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, পেইন কিলার দিয়ে মাথাব্যথা চেপে ধরে যখন পৌঁছলাম বেটোফেনের বাড়ির জানালায়, মনে হলো ঠিক এমন একটি দুপুর আমার পাওনা ছিল জীবনের কাছে।

সাধারণত ছুটির দিনগুলোতে মিউজিয়াম লোকে ঠাসা থাকে। আমি গেলাম বৃহস্পতিবার। ভর দুপুরে। লোকশূন্য বাড়িতে। বেটোফেনের কাঠের বাড়িটি যেন সেদিন তার সমস্ত রহস্য নিয়ে আমার জন্য বসে ছিল। সেদিন সেই দুপুর, সেই রোদ, সেই জনশূন্যতা, বেটোফেনের অনেক অনেক আগের অদ্ভুত সেই উপস্থিতি যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অদ্ভুত কোনো প্যারালাল জগতে। ঘোর কাটতেই দ্বিতীয় দিন আমার বর মেহেদিকে ধরে নিয়ে যাই। আফসোস সেদিন ছুটির দিন ছিল। ভিড়ে সেই জগৎ ধরা দেয় না।

বেটোফেনের পুরো নাম লুডভিগ ফান বেটোফেন। জন্ম ১৭৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর, জার্মানির বন শহরে। এ সঙ্গীতকার সৃষ্টি করেছেন সোনাটা ও সিম্ফনি, বাজিয়েছেন পিয়ানো অর্কেস্ট্রা। তার সম্পর্কে আগে কিছুটা পরিচিতি থাকলেও এবার যেন তাকে একেবারে একান্ত করে চিনলাম। বৃহস্পতিবারের ফাঁকা দুপুরে যখন তার তিনতলা এই বাড়িটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মনে হচ্ছিল এই যে সিঁড়ির যেখানে হাত রাখছি এখানে প্রায় ২৫০ বছর আগে কখনো তার হাত পড়েছিল!

একটি জানালা থেকে বাড়ির অন্যান্য অংশগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি কামরাতেই বেটোফেনের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, উপহার, মিউজিকের স্কেচ বুক, পারিবারিক নথিপত্র ইত্যাদি হাজারো নানা জিনিস দিয়ে সাজানো। কিন্তু ছবি তোলা নিষেধ। গোটা বাড়ি কাঠের পাঠাতনের। কাঠের মেঝেতে বয়সের ছাপ লেগেছে, পায়ের চাপে মচমচ শব্দ দুপুরের জনশূন্য বাড়িটির নীরবতা যেন আরো একটুখানি বাড়াচ্ছে। রোদ্দুর এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। সামনের জানালা গলে ঝকঝকে জার্মান আকাশের নীল উপচে পরছে রুমের ভেতর। এমন এক সময়, ঝিম ধরা এই মাঝদুপুরে, বহু আগের এক সন্ধে চলে এলো, হঠাৎ করেই।

বেটোফেন পিয়ানো বাজাচ্ছেন, তাকে ঘিরে রাজ্যের লোকের ভিড়। কারো গ্লাসের ওয়াইন, কারো প্রয়োজনীয় কথা সব থেমে গেছে প্রথম সুরে। একদল সুসজ্জিত জনতাকে মুগ্ধতায় যেন স্থবির করে দিয়েছেন তিনি, এই মুহূর্তে বাকি সবকিছু মিথ্যে, কেবল সত্য, ‘পিয়ানো কোয়াটেট নাম্বার থ্রি ইন সি মেজর’।

পরিবেশনা শেষ হলো, বেটোফেন থামলেন দ্বিতীয় সোনাটার প্রস্তুতির জন্য। শুনতে পেলাম প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো উৎফুল্ল জনতার মৃদু গুঞ্জন, কাচের গ্লাসের টুং টাং আর উজ্জ্বল নারীর স্নিগ্ধ হাসি। জানালায় রোদ সরে গিয়ে মেঘের পর্দা ফিরে এলে, ফিরে এলাম সেই দুপুরে, ২৫০ বছর পরে।

বাড়ির এক কোণে কিছু যন্ত্রপাতি রাখা যত্ন করে, ভাবলাম রসুইঘরের কিছু একটা, মিউজিয়াম লেবেল পড়ে জানলাম এসব দারুণ ভারি দেখতে পেতলের তৈরি সেকালের হিয়ারিং এইড, বেটোফেনের জন্য বিশেষ করে বানানো। মনে পড়লো, যে মানুষটি একের পর এক অপূর্ব সব সুর তৈরি করে গেছেন, একসময় তার শ্রবণশক্তি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না! এমনকি তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ পিয়ানো যাতে তিনি সুর বানানোর সময় কী বানাচ্ছেন তা যেন শুনতে পান। একথা ভেবে অবাক লাগে যে তিনি যে সুরগুলো সৃষ্টি করে গেছেন সারা পৃথিবীর জন্য, তা আমরা ঠিক যেভাবে শুনি, তিনি সম্ভবত ঠিক সেভাবে কখনোই শুনতে পারেননি।

তার যেন জন্মই হয়েছিল এইসব সুর পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য, তাই কোনো বাধাই যেন ঠিক ধোপে টেকেনি– না জীবনযুদ্ধ, না শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। একসময় অ্যালকোহল ডুবে থাকতেন, হয়তো বিষণ্নতায়, একাকীত্বে। জীবনে যাকেই ভালোবেসেছেন তার জন্যই হয়ে দাঁড়িয়েছেন অভিশাপ, কি অদ্ভুত! শৈশব থেকেই ভালোবাসাবঞ্চিত এই মানুষটির পুরো জীবনটা দেখলে মনে হয় যেন তার এই ভালোবাসাহীন পরিবেশটা, এই ভালোবাসতে না পারার পরিবেশটাই দরকার ছিল, নয়তো তার ঠিক যেন বেটোফেন হয়ে উঠা হতো না!

একটা প্যাথিটিক জীবন ভ্যান গঘকে যেমন তাড়িত করতো সুন্দরের সৃষ্টিতে, ঠিক তেমনি যেন করুণাময় একটি জীবন বেটোফেনকে দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে একের পর এক আশ্চর্য সব সঙ্গীত। তিনি দারুণ এক কায়দায় কমিউনিকেট করতেন। সঙ্গে করে বয়ে বেড়াতেন ডায়েরি যেখানে প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন লিখতেন। শোনা যায় এরকম প্রায় ৪০০ কনভারসেশন বুক ছিল তার। 

কথায় আছে যে কোনো কিছুর বাড়তিটুকুই বিষ! এ কথার প্রমাণ দিতেই যেন তার সেক্রেটারি যিনি তাকে প্রবল ভালোবাসতেন, এর প্রায় বেশিরভাগই পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, যাতে লোকে বেটোফেনের চরিত্রের ক্ষেপাটে দিকগুলো না জানতে পায়।

কত মানুষের কত কত প্রশ্ন এতে লিখা, বাজারের হিসাব থেকে শুরু করে মিউজিকের উচ্চমার্গীয় আলাপ কি নেই তাতে! তবে আফসোস এসবের উত্তরে বেটোফেন কী বলেছিলেন তা জানার কোনো উপায় জীবন রাখেনি, তিনি সব উত্তর দিয়ে গেছেন মৌখিকভাবে। বেটোফেনকে নিয়ে কত কত গল্প! শোনা যায় একবার তিনি এক সিনেটের মাথায় চেয়ার ভেঙেছেন রাগের মাথায়। পরে আবার তার কাছেই গেছেন টাকা ধার চাইতে। যথেষ্ট কারণেই টাকা দিতে রাজি হননি সিনেট আর এতে বেটোফেন নাকি আরো খানিকটা রেগে গিয়েছিলেন।

আলোছায়ার জনশূন্য বাড়িজুড়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এক্ষুণি বোধ হয় সামনের কামরা থেকে বেটোফেন বেরিয়ে আসবেন তার লেখার কলমটি খুঁজতে। বাড়ির শেষ প্রান্তের শেষ কক্ষটি শেষ হয়েছে দেয়ালজুড়ে আয়না নিয়ে। আয়নায় দুলে দুলে ভেসে উঠছে জার্মান ভাষায় কিছু লেখা। মেঝেতে মেটালের তৈরি প্ল্যাটফর্ম। প্রথমে ভেবেছিলাম হাঁটলে লেখাগুলো ভেসে উঠছে, কিন্তু তা নয়। আয়নাটি মনিটরের মতো কাজ করছে। আয়নায় যা লেখা রয়েছে তার বাংলা অনুবাদ হতে পারে এমন- “হে পবিত্র, আমার জগৎ শূন্যেই। শব্দও ঘূর্ণি তৈরি করে শূন্যে, যেমনটা করে বাতাস আর আত্মা।”

জীবনের বেশকিছু সময় ভাড়াটে বাড়িতে কাটাতে হয়েছে বেটোফেনের, কিন্তু তার বাড়ি ভাড়া পাওয়াটাও ছিল এক জটিল সমস্যা। একবার বহু খুঁজে খুঁজে শেষে এক পাথরের দেয়ালের  বাড়ি ভাড়া পেলেন। বাড়ি বেশ ভালো, তবে তার মনে হলো শোবারঘরে একখান জানালা দরকার। যা ভাবা তাই কাজ, পাথরের দেয়াল খুঁড়ে জানালা বসিয়ে নিলেন মনমতো। তবে বাড়িওয়ালাকে যে একথা জানানো দরকার, সেটা ঠিক যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি বেটোফেনের কাছে। কাজেই সেবারও বাড়িটি হারাতে হয়।

বেটোফেন মারা যান যখন তখন তার খ্যাতি তুঙ্গে। দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন জাঁদরেল সংস্থা তখন তাকে রীতিমতো খুঁজছে। সাধারণ মানুষ তাকে বহু আগে থেকেই মোজার্টের পুনর্জন্ম হিসেবে চেনে। মোজার্ট হলেন অস্ট্রিয় সুরকার ভোল্‌ফগাংক আমাডেয়ুস মোজার্ট (১৭৫৬-১৭৯১)।

সেই বেটোফেন মারা গেলেন প্রচণ্ড ঝড়ের এক রাতে, আপনজন ছাড়া পাশে ছিলেন কেবল দুইজন মানুষ। একজন এক প্রকার বন্ধু বলা চলে, আর একজন তার এককালের বড় শত্রু। এই যে তাকে ঘিরে রাজ্যজুড়ে উন্মাদনা তার কিছুই যেন ছুঁতে পারেনি বেটোফেনকে। লক্ষ লোকের ভালো লাগার বেটোফেন ১৮২৭ সালের ২৬ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এক বুক আজন্মের হাহাকার নিয়ে। মৃত্যুর দুদিন আগে বলা তার শেষ কথা ছিল– “অ্যাপ্লোড, মাই ফ্রেন্ডস, দ্য কমেডি ইজ ওভার।”