প্রকৃতি ও পরিবেশ
প্রায় সব ফুলেরই জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু মিথ। আইরিসও তার ব্যতিক্রম নয়।
Published : 13 Jun 2024, 11:43 PM
১৮৮৯ সাল। দারিদ্র, শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক অশান্তি নিয়ে চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ নিজেই ভর্তি হয়ে যান প্যারিসের সেইন্ট রেমির মানসিক চিকিৎসার আশ্রয়কেন্দ্রে। সেই আশ্রয়কেন্দ্রে শিল্পীর চলাফেরা ছিল সীমিত।
তবে আশ্রয়কেন্দ্রের ছোট্ট বাগানে তার প্রবেশাধিকার ছিল। সেই বাগানেই দেখেছিলেন এই আইরিস ফুল। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকালে তিনি মোট ১৩০টির মতো ছবি এঁকেছিলেন, তার মধ্যে আইরিসকে কেন্দ্র করে আঁকা চারটি ছবি ছিল।
ভিনসেন্টের ভাই থিও আইরিস নিয়ে আঁকা একটি ছবি প্যারিসে প্রদর্শনের জন্য দেন। মূলত সেই প্রদর্শনী থেকে ছবিটি শিল্পবোদ্ধাদের নজর কাড়ে। ১৮৯২ সালে প্যারিসে ছবিটি বিক্রি হয় তিনশ ফ্রাঁ’র বিনিময়ে।
বর্তমানে ভ্যানগঘের এই ‘আইরিস’ শিরোনামের ছবিটি ‘সবচেয়ে দামি চিত্রকর্ম’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে। ১৯৮৭ সালে নিলামে ৫৩.৯ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয় এটি। তারপর ১৯৯২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের জে পল গেটি মিউজিয়াম অজানা মূল্যে এই ছবিটি তাদের সংরক্ষণে নিয়ে নেয়।
আইরিসের চেয়ে বিখ্যাত ছবি ভ্যান গঘের ‘সান ফ্লাওয়ার’। আইরিস বাংলাদেশে অনেকটাই অপরিচিত ফুল। তাই ভ্যান গঘ আইরিস আঁকলেও তা আলাদা করে আমাদের নজরে পড়েনি। টিস্যু পেপারের মতো মোলায়েম পাপড়ি আইরিসের, ছয় পাপড়ির একটি উপরের দিকে আর একটি নিচের দিকে বিন্যস্ত থাকে। সামান্য বাতাসে এমনভাবে নড়তে থাকে যে দেখলে মনে হয় একটি উড়ন্ত প্রজাপতি।
আইরিসের প্রতিটি ফুলের রং এতো স্নিগ্ধ যে, কেউ দেখলে তার ভালো লাগবেই। আর রঙের এতো বৈচিত্র্য মনে হয় অন্য কোন ফুলের মধ্য পাওয়া যায় না। উত্তর গোলার্ধ থেকে বলছিলাম আইরিস ফুলের কথা, তবে এর বিস্তৃতি ইউরোপ থেকে এশিয়ার শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে। ধারণা করা হয়, এর আদি বাসস্থান জাপানে।
প্রায় সব ফুলেরই জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু মিথ। আইরিসও তার ব্যতিক্রম নয়। আইরিস ফুলের নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক দেবী ‘আইরিস’-এর নামানুসারে। আইরিস ছিলো রংধনুর দেবী। তার একটি বড় পরিচয়, সে ছিলো বার্তাবাহক। গ্রিক দেবতা জিউস এবং তার স্ত্রী হেরার নির্দেশে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে রংধনুর রথে চড়ে বার্তা নিয়ে আসতো। কী কারণে গ্রিক দেবীর নাম অনুসারে এ ফুলের নাম ‘আইরিস’ হলো তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ফুলের রং বৈচিত্র্যের কারণে রংধনু থেকে হয়তো এর নাম হয়েছে ‘আইরিস’।
প্রকৃতির অন্যতম প্রাচীন এই ফুলটির সবচেয়ে বেশি কদর দিয়েছে সম্ভবত ফ্রান্স। হালকা বেগুনি রঙের মিষ্টি আইরিস প্রজাতিটি ফ্রান্সের জাতীয় ফুল। তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে এটি স্থান পেয়েছে। জর্ডানের জাতীয় ফুল কালো আইরিস। কানাডার নিজস্ব কোন জাতীয় ফুল নেই, তবে কুইবেক অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ফুল ‘ব্লু ফ্ল্যাগ আইরিস’। আগে কুইবেকের জাতীয় ফুল ছিল সাদা রঙের ম্যাডোনা লিলি।
১৯৯৯ সালের ৫ নভেম্বর কুইবেকের পার্লামেন্ট ব্লু ফ্ল্যাগ আইরিসকে তাদের জাতীয় ফুল হিসেবে গ্রহণ করে। কাশ্মির ও মরক্কোর মুসলিম জনগোষ্ঠী আইরিসকে ‘পবিত্র ফুল’ হিসেবে বিবেচনা করে, এ কারণে তাদের কবরস্থানগুলোতে এই ফুল বেশি জন্মাতে দেখা যায়।
আইরিস শীতপ্রধান দেশের ফুল। খুব যে একটা জনপ্রিয় তা নয়। তারপর এর স্থায়িত্ব আবার সপ্তাহখানেক। এসব বিবেচনায় এটি জনপ্রিয় হতে পারেনি অনেকের কাছে। আমার মন কেড়েছে এর মনোহর রং, রূপ আর স্নিগ্ধতা। দেশের কলাবতীর মতো পাতলা এ ফুলের পাপড়ি।
অনেকগুলো রঙের প্রায় ২০০ প্রজাতি আছে আইরিসের, আছে অজস্র শংকর জাত। এই শংকর জাতের আইরিসের আকার এবং বিচিত্র রং দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। বসন্তে যখন রং-বেরঙের এ ফুল ফোটে তখন অজস্র প্রজাপতি এসে ভিড় করে। তখন ফুল আর প্রজাপতির মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়।
তার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে বাগান করার প্রথম বছর থেকে শুরু করেছিলাম আইরিস সংগ্রহ। উত্তর আমেরিকার নার্সারিগুলো একেকটি আইরিসের চারা বিক্রি করে ১৫-২০ ডলারে, যা অনেকটা নাগালের বাইরে। আমি খুঁজে বের করেছিলাম বিকল্প উপায়। ফেইসবুকের মার্কেটপ্লেসে অনেকেই তাদের অতিরিক্ত আইরিস বিক্রি করে দেন।
৩-৫ ডলারেই পাওয়া যায় এক একটি আইরিসের রাইজোম। গত পাঁচ বছরে এভাবেই সংগ্রহ করেছি আমাদের বাগানের আইরিসগুলো। এমনও হয়েছে বিরল রঙের ৫ ডলারের একটি আইরিসের চারা সংগ্রহ করার জন্য নিজেই গাড়ি চালিয়ে গিয়েছি ৫০ কিলোমিটার!
আইরিস বংশবিস্তার করে আদার মতো রাইজোমের মাধ্যমে। এটি বাগানে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। দুই-তিন বছর পর পর এটিকে পাতলা করে দিতে হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বছরে সংগ্রহ করা আমাদের বাগানের আইরিসও পাতলা করে দিতে হয়েছে। এই অতিরিক্ত রাইজোম আমিও মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করে এ বাবদ বিনিয়োগ তুলে নিয়েছি।
এখন প্রতি বছর বসন্তে শুধু আইরিসের রাইজোম বিক্রি করে বাগানের পুরো খরচ তুলে ফেলি। বিক্রি করার জন্য বেছে নিই ফেইসবুকের মার্কেটপ্লেস। যোগাযোগ করে ড্রাইভওয়ের পাশে রেখে দিই। তারা নিয়ে ডলার রেখে যায় মেইলবক্সে। ক্রেতার সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ হয় না। এ নিয়ে অনেক মজার এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বছর দুয়েক আগে কালো রঙের একটি আইরিসের পাঁচটি রেখে বাকি পাঁচটি তুলে ড্রাইভওয়ের পাশে রেখে মার্কেটপ্লেসে পোস্ট করি। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো রেসপন্স পেয়ে যাই। তারা শুধু লিখে ‘অ্যাড্রেস প্লিজ’, আমি তিনজনকে ঠিকানা জানিয়ে দিই। মিনিট পনেরো পর আমার শহরের একজন এসে ২৫ ডলার দিয়ে পাঁচটি রাইজোম নিয়ে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘সোল্ড’ লিখে দিই।
কিন্তু ঠিকানা পেয়েই বারলিংটন এবং ওয়াটারলু থেকে রওনা দিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যে আরও দুজন এসে হাজির! আইরিস না পেয়ে তারা নিরাশ। তাদের হতাশা এবং বারবার অনুরোধে বাগান থেকে দুজনকেই একটি করে রাইজোম তুলে দিতে হয়েছিল।
গত বছরের ঘটনা। ড্রাইভওয়েতে বিক্রির জন্য সাদা এবং গাঢ় বেগুনি রঙের বেশকিছু আইরিসের চারা রাখা ছিল। মার্কেটপ্লেসের বিজ্ঞাপন দেখে এক বয়স্ক নারী এসে সেগুলো নিয়েছেন। কিন্তু তার দৃষ্টি চলে যায় বাগানের ভেতর। সেখানে ফুটে আছে সোনা রঙের বেশকিছু আইরিস।
তা দেখে কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করে আমাকে মেসেজ করেন তিনি। আমি কাজে ছিলাম বলে মানা করে দিই। তিনি তখন বাসার কলিংবেল চাপেন। আমার স্ত্রী রুমুর ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তখন রুমুকে অনুরোধ করতে থাকেন। তার আগ্রহ দেখে রুমু যোগাযোগ করে আমার সঙ্গে। আমি রুমুকেও না বলে দিই। কারণ বাগানে সোনা রঙের আইরিস গত বছরের সংগ্রহ। এবার সবে তিনটি গাছ হয়েছে। রুমুর ভাষায়, ওই নারী ভীষণ মন খারাপ করে শেষ পর্যন্ত চলে যান।
বর্তমানে আমাদের বাগানে ২৫-এরও বেশি প্রজাতির আইরিস আছে। বসন্তের পুরোটা সময় মনোহর রঙের এসব আইরিস ফুটে আমাদের এবং পথচারীদের মুগ্ধ করে রাখে। তবে এই আইরিসকে খুব বেশি বাড়তে দিই না। একেকটি প্রজাতির পাঁচ-সাতটি রেখে বাকিগুলো তুলে বিক্রি করি। অনেক সংগ্রহের নেশার মতো আইরিস সংগ্রহও এখন আমার ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।