Published : 24 Jul 2023, 04:28 PM
চান্দুমামার মন খারাপ। পত্রিকায় একটা সংবাদ পড়তে পড়তে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমনিতে চান্দুমামা হাসিখুশি মানুষ। সারাক্ষণ আনন্দে ফুটছেন। মম-সিঁথিসহ সবাইকে সারাক্ষণ ক্ষেপাচ্ছেন। আর ওরা ক্ষেপলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন চান্দুমামা।
সেই চান্দুমামার মুড অফ হয়ে গেলে ভালো লাগে গিট্টুর? মোটেই না, তাই প্রশ্নটা করেই ফেললো গিট্টু।
ঘটনা কী মামা?
অদৃশ্য গিট্টুর দিকে তাকালেন মামা।
দৃশ্যমান হ তো বাপ। বাতাসের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে?
জি, মামা। বলেই দশ বারো বছরের কিশোরের রূপ নিয়ে গিট্টু চান্দুমামার মুখোমুখি বসে পড়ে।
এবার বলেন মামা, আপনার মন খারাপের কারণটা বলেন।
বাইক্কা বিলের কথা শুনেছিস কখনো?
বাইক্কা বিল? জিনিসটা কী মামা?
আরে গাধা, তুই ভূত হবার আগে কি পড়াশোনা কিছু করিসনি? বাইক্কা বিল সম্পর্কে কিছুই জানিস না? আমার মনটা ডাবল খারাপ হয়ে যাচ্ছে রে!
মামা, সবাই কি সবকিছু জানে? আপনি মন খারাপ না কইরা সংক্ষেপে বাইক্কা বিল সম্পর্কে বলেন। আমি শুনি।
চান্দুমামা বাইক্কা বিল সম্পর্কে বলা শুরু করলেন- ঢাকা থেকে অন্তত দুইশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা। সেখানে বিশাল একটা হাওর রয়েছে যার নাম হাইল হাওর। এই হাইল হাওরের পূর্ব পাশে অন্তত একশ হেক্টরের একটা জলাভূমির নাম বাইক্কা বিল।
২০০৩ সালের জুলাই মাসে বিলটাকে 'মাছের অভয়াশ্রম' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ এই বিলের মাছসহ কোন প্রাণী, জলবস্তু ও পাখিসহ কোন কিছুই নষ্ট করা যাবে না। আমাদের দেশিয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, পাখি ইত্যাদি এরমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যা আছে তা রক্ষা করার জন্যই এই ব্যবস্থা। এই বিলে আছে আইড়, কই, মেনি, কলি ও পাবদাসহ আরো অনেক দেশি মাছ।
আছে পানা, শাপলা ও পদ্মফুল। রঙিন ফড়িঙরা সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। পাখিদের মধ্যে আছে- পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, গো-বক, ধুপনি-বক, রাঙা-বক, দলপিপি, নেউপিপি, পানমুরগি, বেগুনি কালেম, কালোমাথা কাস্তেচরা, শঙ্খচিল, পালাসি কুড়া ঈগল ইত্যাদি। শীতে আসে নানা পরিযায়ী বা অতিথি পাখি। তাদের মধ্যে আছে- গেওয়ালা বাটান, মেটে মাথা টিটি, কালাপঙ্খ ঠেঙ্গি, ধলা বালিহাঁস, পাতিসরালি, রাজসরালি, মরচেং ভূতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঙ্গা হাঁস ও গুটি ঈগল ইত্যাদি।
২০১১ সালে বাইক্কা বিলে ২০৩ জাতের পরিযায়ী পাখি শনাক্ত করা হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, অভয়াশ্রম হওয়াতে নতুন চার প্রজাতির পরিযায়ী পাখি শনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- বড়ঠুঁটি নলফুটকি, উদয়ি নলফুটকি, বৈকাল নলফুটকি এবং সাইক্সের ফুটকি।
বাইক্কা বিলে দেশিমাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় মাছগুলো বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে ডিম পাড়ে। বাচ্চা হওয়ার পর সেই পোনামাছ সারা হাইল হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দের ব্যাপার হলো গত কয়েক বছর ধরে সারা হাওরে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। অতিথি পাখিরা ফিরে আসছে। দেশি-বিদেশি পর্যটক তা দেখে আনন্দ পাচ্ছে।
কিন্তু সম্প্রতি কিছু খারাপ মানুষ বিলটিকে নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা রাতের বেলা বাইক্কা বিল থেকে মা মাছসহ মাছ ধরে নিচ্ছে। ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি ধরছে। অর্থাৎ বাইক্কা বিলের মাধ্যমে সমস্ত হাইল হাওরে যে পরিবেশ উন্নয়ন হয়েছিল সেটা তারা ধ্বংস করতে শুরু করেছে।
চান্দুমামার কথা শুনে গিট্টুরও মন খারাপ হয়ে যায়। তার মনে হয় ভূত তো খারাপই, মানুষ এতো খারাপ কেন? এরা নিজেদের ভালোও বুঝে না? একটা সমাধান তো চাই।
কী চিন্তা করছিস গিট্টু? চান্দুমামা গিট্টুর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
এর কি কোন সমাধান নাই মামা?
কীভাবে হবে বল? মানুষ যদি নিজেরা সচেতন না হয় তবে সমাধান কীভাবে হবে? এটা তো ডোবা, পুকুর, দীঘি নয়, কিংবা ছোট বিল নয় যে পাহারা বসিয়ে রক্ষা করা যাবে। একশ হেক্টরের একটা জলাভূমি। এটা কি পাহারা দেওয়া সম্ভব? বিশাল পরিমাণ লোকবল ছাড়া এটা পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হবে। অসম্ভব একটা ব্যাপার।
তাহলে তো চিন্তার কথা মামা।
একদম।
আচ্ছা মামা একবার চলেন না সবাই মিলে বাইক্কা বিল ঘুরে আসি! স্পটে গেলে লোকজনের সাথে কথার্বাতা বললে একটা সমাধান বের হলেও তো হতে পারে।
এটা ঠিকই বলেছিস তুই। একবার যাওয়া উচিত। মম, সিঁথি আর তোর মামিও কখনো বাইক্কা বিল দেখেনি। ওদেরও দেখা হয়ে যাবে।
হুররে! ফাটাফাটি একটা ভ্রমণ হবে মামা। আমি যাচ্ছি তো?
কি যে বলিস, তোকে ছাড়া আমি কি যেতে পারি ভাগনে।
আনন্দে সুপার একটা নাচ নাচে গিট্টু। তারপর ফুস করে অদৃশ্য হয়ে যায়।
প্ল্যান প্রোগ্রাম পাক্কা। শুক্র আর শনিবারের সাথে আরও তিনদিনের নৈমিত্তিক ছুটি নেন চান্দুমামা। বৃহস্পতিবার রাতে যাত্রা শুরু হবে। মঙ্গলবার বিকেলে আবার ঢাকার পানে যাত্রা। শুনে মম ও সিঁথি লাফিয়ে উঠলো। শ্রীমঙ্গলের জন্য ওদের অনেক টান। নিজের এলাকা বলে কথা। বৃহস্পতিবার রাতে উপবনের চারটি শোভন চেয়ারের টিকিট অনলাইনে করে ফেললো মম। চান্দুমামা বলেছিলেন ফার্স্ট ক্লাস বার্থ নিতে। তাহলে রাতের জার্নিতে আরামে যাওয়া যাবে।
মম-সিঁথি দুজনেই ক্ষেপে গেলো। বলো কি? মাত্র চার ঘণ্টার জার্নিতে ঘুমিয়ে যাবো?
তাই তো! চেয়ারে গেলে আড্ডাও দেওয়া যাবে আর নানা খাবার খেতে খেতে যাবো। সিঁথির বক্তব্য শুনে চান্দুমামা বললেন- ওরে তোদের জন্যই তো বললাম। আমারতো ভালোই হলো, চেয়ারেই আমি কমফোর্ট ফিল করি। তবে কথা হলো, ট্রেনে উঠেই তোদের মোবাইল ফোন বন্ধ করে ফেলতে হবে। বিশেষ করে ফেইসবুকে চোখ রাখা যাবে না। চেয়ারে যখন যাবো তখন আড্ডা দিতে দিতেই যেতে হবে।
ঠিক আছে...ঠিক আছে...সমস্বরে বলে ওঠে মম ও সিঁথি। বৃহস্পতিবার আসতে খুব দেরি নেই। সবাই শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের পরিকল্পানায় মেতে ওঠে।
চলবে...