একটি দেশপ্রেমের চলচ্চিত্র ও তার নির্মাতার কথা

ছবির পোস্টারে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র...’, যা আসলে আমাদের আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যটিকেই সামনে নিয়ে আসে।

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 7 August 2022, 07:47 AM
Updated : 7 August 2022, 07:47 AM

তোমরা যারা আমার এই সিরিজটি একেবারে প্রথম থেকে পড়ে আসছ তাদের মনে থাকার কথা, এর উদ্বোধনী পর্বটি ছিল বাংলা ভাষার বহু বিখ্যাত ও অমর একটি গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’কে নিয়ে। সেই লেখাতে আমি একটি সমান বিখ্যাত সিনেমার কথাও বলেছিলাম, যেখানে এই গানটির খুব সুন্দর ও সার্থক প্রয়োগ ছিল।

‘জীবন থেকে নেয়া’ নামের সেই সিনেমাটিতেই আমরা প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, নগ্নপদ প্রভাতফেরির চমৎকার দৃশ্যায়ন দেখতে পাই। দেখি হাজার হাজার মানুষ আবেগভরে এই গানটি গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে, যখন সারা দেশ জাতীয় নির্বাচন ও স্বাধিকার আন্দোলনের দাবিতে উত্তাল।

সেই অসাধারণ ছবিটি আর তার অসমসাহসী ও শক্তিশালী পরিচালক জহির রায়হানের জীবনের গল্পই শিল্পের সিন্দুক-এর এই পর্বের উপজীব্য। এখানে উল্লেখ্য, জহির রায়হান শুধু একজন চিত্রনির্মাতাই ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি একজন সৃষ্টিশীল লেখকও ছিলেন, যার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হাজার বছর ধরে’, ‘বরফগলা নদী’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘আর কতদিন’ ও ‘কয়েকটি মৃত্যু’ ইত্যাদি।

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে, যখন সারা দেশ জাতীয় নির্বাচন ও স্বাধিকার আন্দোলনের দাবিতে উত্তাল। এই সময়ে জহির রায়হান অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্তভাবে একটি রূপক গল্পের আবরণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ওপর পশ্চিমাদের শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা এবং তার বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র প্রতিবাদ ও জাগরণের কথা তুলে ধরেন।

এমনকি এর মাধ্যমে ইঙ্গিতে তিনি আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতার স্পৃহা ও স্বপ্নের কথাও উচ্চারণ করেন। এই ছবির পোস্টারে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল এই কথা কয়টি ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র...’, যা আসলে আমাদের আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যটিকেই সামনে নিয়ে আসে এবং দেশবাসীকে অনিবার্য এক মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে তৈরি করে তোলে।

কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় এই ছবিটি দেখিয়ে তিনি একদিকে যেমন এই যুদ্ধের প্রতি সবার সমর্থন আদায় ও জনমত গঠনের কাজ করলেন, তেমনি ছবির টিকিট বিক্রির টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন রণাঙ্গনে লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধা ও সীমান্তের এপারে চলে আসা লক্ষ লক্ষ অসহায় শরণার্থীদের।

এই ছবির আরেকটি বিস্ময়কর বিষয় এই যে, তিনি এতে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটাকেও খুব সুন্দরভাবে, গভীর আবেগের সঙ্গে উপস্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অসাধারণ গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠার পেছনে নিশ্চয় এরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। শুধু এই গানই নয়, তিনি তাতে বিদ্রোহী কবি নজরুলেরও একটি বিখ্যাত সংগ্রামী গান, ‘কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’কেও দারুণ শিল্পিত ও প্রতীকীভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

কী আশ্চর্যরকম দূরদর্শীই না ছিলেন জহির রায়হান! তার এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আমদের ওপর নেমে আসে পাকিস্তানিদের বর্বর আগ্রাসন। আর তার প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয়ে যায় আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ যার ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা তার এই চলচ্চিত্রটিতে। তিনি নিজেও পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন এই আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তাই আর কালবিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্রগঠনের এই মহান সংগ্রামে।

প্রথম সুযোগেই তিনি সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন, তার শৈশবের বেড়ে ওঠার শহর কলকাতায়; সঙ্গে বুদ্ধি করে নিয়ে গেলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির বাক্সবন্দি সব রিল। কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় এই ছবিটি দেখিয়ে তিনি একদিকে যেমন এই যুদ্ধের প্রতি সবার সমর্থন আদায় ও জনমত গঠনের কাজ করলেন, তেমনি ছবির টিকিট বিক্রির টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন রণাঙ্গনে লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধা ও সীমান্তের এপারে চলে আসা লক্ষ লক্ষ অসহায় শরণার্থীদের।

পাশাপাশি তিনি তার আসল কাজ, চলচ্চিত্র নির্মাণও অব্যাহত রাখেন। তিনি ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন ঘুরে ঘুরে তার ছবির রসদ সংগ্রহ করেন। সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি পরপর কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’, ‘চিলড্রেন অভ বাংলাদেশ’, ‘সারেন্ডার’ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি যে ছবিটি দিয়ে, সেটিও একটি প্রামাণ্যচিত্র, নাম ‘স্টপ জেনোসাইড’।

সব কাজ ফেলে জহির রায়হান তার খুব প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খোঁজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ একদিন খোঁজ পেলেন ঢাকার মিরপুরের কোনো এক বাড়িতে নাকি বিহারিরা তাকে আটকে রেখেছে। তিনি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কয়েকজন সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলেন তাকে উদ্ধার করে আনতে।

এতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার বাহিনী যে নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তার মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরেন। পাশাপাশি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যৌক্তিকতাকেও জোরালো ও যুক্তিনিষ্ঠ ভাষায়, অকাট্য তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরেন। এতে করে বিদেশের মাটিতে আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে ব্যাপক সমর্থন ও জনমত গড়ে ওঠে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে সন্দেহ নেই। শুধু তা-ই নয়, চলচ্চিত্রশিল্প হিসেবেও এটি এতটাই উন্নতমানের ছিল যে, দেশে-বিদেশে তার সুনামের কথা উচ্চারিত হয়ে থাকে আজও। ছবিটি খুব বেশি বড় নয়, মাত্র ত্রিশ মিনিটের মতো এবং এটি ইউটিউবেও খুব সহজেই খুঁজে পাবে তোমরা। আশা করি সময়-সুযোগ করে তোমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক মূল্যবান দলিল এই ছবিটি দেখে নেবে।

জহির রায়হান ও তার মতো আরও হাজারও মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে একসময় দেশ স্বাধীন হয়। বুকভরা স্বপ্ন আর আশা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে মনের মতো করে গড়ে তুলবেন বলে। কিন্তু দেশে ফিরেই পেলেন সেই ভয়ংকর দুঃসংবাদটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক দুদিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকহানাদার বাহিনীর কুখ্যাত দেশীয় দালালের দল, আল বদর আর আল শামস বাহিনীর সদস্যেরা তার বড় ভাই, বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই।

সব কাজ ফেলে জহির রায়হান তখন তার খুব প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাইকে খোঁজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ একদিন খোঁজ পেলেন ঢাকার মিরপুরের কোনো এক বাড়িতে নাকি বিহারিরা তাকে আটকে রেখেছে। তিনি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কয়েকজন সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলেন তাকে উদ্ধার করে আনতে। কিন্তু বিহারিরা তাদের দেখে হঠাৎ জোরেসোরে গোলাগুলি শুরু করে। আরম্ভ হয় প্রচণ্ড এক বন্দুকযুদ্ধ। ধারণা করা হয়, সেই যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে নিরস্ত্র জহির রায়হান নিহত হন, যদিও তার লাশটিকে আর কখনও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই দিনটি ছিল ৩০ এপ্রিল। সেই থেকে এই দিনটি বাংলাদেশে জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস তথা তার চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস, যে-দেশটিকে তিনি ও তার মতো আরও সহস্র যোদ্ধা লড়াই করে, প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার আগেই তিনি হারিয়ে গেলেন অকাতরে।

আমার এই ছোট্ট লেখাটির মাধ্যমে আমি একদিকে যেমন আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল রত্ন ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কথা তোমাদের জানাতে চেয়েছি, তেমনি এর নির্মাতা জহির রায়হান (১৯ অগাস্ট ১৯৩৫ — ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২), যিনি একইসঙ্গে একজন দায়বদ্ধ সাংবাদিক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও প্রথমশ্রেণির কথাসাহিত্যিক ছিলেন, তার প্রতিও আমাদের অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছি।

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!