‘মনের সুতো বাঁধো বইয়ের সঙ্গে’

‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তরুণ শিশুসাহিত্যিক মাসুম আওয়াল।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2023, 07:38 AM
Updated : 27 Feb 2023, 07:38 AM

মাসুম আওয়াল একজন তরুণ শিশুসাহিত্যিক। শিশু-কিশোরদের জন্য তার প্রকা‌শিত বই ৮‌টি- ‘সবুজ ফ‌ড়িং হলুদ ফ‌ড়িং’, ‘ছুট‌ছে মজার ছড়ার গা‌ড়ি’, ‘জটা কবিরাজ ও ভুতু‌ড়ে বটগাছ’, ‘ভূততাড়ুয়া’, ‘আমিও ফ‌ড়িং তু‌মিও ফ‌ড়িং’, ‘টই টই হই চই’, ‘আশেকীন স‌্যা‌রের ক্লা‌সে মি‌ষ্টি একটা প‌রি’ এবং ‘বাক‌শো ভরা এক‌শো ছড়া’।

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন মাসুম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার। 

এবারের মেলায় আপনার নতুন কী বই প্রকাশিত হয়েছে? বিষয়বস্তু কী?

মেলায় প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম উপন্যাস ‘গোয়েন্দা ডব্লিউ হিং টিং ছট’। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস এটি, প্রকাশ করেছে অর্জন প্রকাশন। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রের নাম 'ডব্লিউ হিং টিং ছট'। তার তিন সহকারী- অংকন, অরূপ ও মুনিয়া। প্রচুর রহস্যের সমাধান করেছে তারা, তাদেরই দুর্ধর্ষ এক অভিযানের কাহিনি নিয়ে এ উপন্যাস।

একটা গল্প, কবিতা বা ছড়া কখন শিশু-কিশোর উপযোগী হয়ে ওঠে?

একটা লেখা তখনই শিশু-কিশোর উপযোগী হয়ে ওঠে যখন সেটা শিশু-কিশোরদের বোধগম্য হয়, শিশুকে টানে এবং তাকে স্বপ্ন দেখতে সহযোগিতা করে। শিশুরা নির্মল, সুন্দর। তাদের মনে কোনো জটিলতা থাকে না। তাদের ফাঁকি দেওয়া কঠিন। ছোটদের জন্য লেখার কাজটি সহজ নয় মোটেও। আর ভালো লেখার তো কোনো মাপকাঠি নেই, ভালো লেখাটা ঠিকই গ্রহণ করবে শিশু-কিশোররা।

প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীর পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। শিশু-কিশোরদের কাছে আমরা যা আড়াল করতে চাই ইন্টারনেট বা টেলিভিশনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে তারা হয়তো সেসব জেনে বসে আছে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় শিশুসাহিত্য কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? 

প্রত্যেক লেখক প্রথমত দায়বদ্ধ নিজের কাছে। কী লিখি? কেন লিখি? এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সব লেখকেরই পরিচ্ছন্ন বোঝাপড়া থাকা প্রয়োজন। মজার ব্যাপার হলো শিশুসাহিত্যের পাঠক শুধু শিশুরাই নয়, বড়রাও। আমরা বড় হই, কিন্তু মনের ভেতর একটা শিশু লুকিয়েই থাকে। তাই শিশুসাহিত্য রচনা করতে হলে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বুঝতে হবে। শিশুরা আসলে কী চায়! শিশুরা স্বপ্ন দেখতে চায়, এমন সব চরিত্রের ভেতর তারা প্রবেশ করতে চায় যেসবের মধ্য দিয়ে নিজেদের ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, হোক সেটা কাল্পনিক।

শিশু-কিশোরদের বই পড়ার অভ্যাস গড়তে কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?

শিশু-কিশোরদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেন বাবা-মা। একজন শিশু নিজে নিজে বই কিনতে পারে না বা কোন বইটা তাকে পড়তে হবে সেটাও বাবা-মাকেই ঠিক করে দিতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রথমত বাবা-মাকে বুঝতে হয় যে কোন বইটা সন্তানকে পড়তে দেবেন। আমরা শিশুদের যেভাবে গড়ে তুলবো তারা ঠিক সেভাবেই বেড়ে উঠবে। তাই তাদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। সৃজনশীল বই পড়ে তারা সৃজনী শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠবে।

বইমেলার কোন দিকটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে আপনাকে?

বইমেলায় আমরা তাদেরই খুঁজে পাই যারা বই ভালোবাসেন। লেখক, পাঠক কিংবা প্রকাশক যেই হন না কেনো, সবার মনের সুতো বাঁধা বইয়ের সঙ্গে। একসঙ্গে হাজার হাজার বইপ্রেমীদের মিলনমেলা এ এখানেই সম্ভব। আমার সেটাই ভালো লাগে। মেলার মাঠে বইপ্রেমীদের দেখি আর ভাবি এত এত মানুষ যারা সবাই বিশ্বাস করে অ্যাকাডেমিক বইয়ের বাইরেও জ্ঞানচর্চা ও আনন্দপাঠের এক বিশাল জগৎ আছে।

আপনার বই পড়া শুরু কীভাবে? প্রথম পড়া বই কোনটি? শৈশব-কৈশোরে পড়া কোনো বই কি এখনও আপনার মনে পড়ে?

প্রথম কী বই পড়েছি সেভাবে মনে নেই। বর্ণমালার বই হবে নিশ্চই। তবে ছোটবেলা থেকে ছন্দ টানতো আমাকে। বাংলা বইয়ের ছড়াগুলো আগে পড়ে ফেলতাম। ছোটদের যে কোনো ম্যাগাজিন পেলেই পড়তাম। মূলত পড়ার ঝোঁকটা তৈরি হয় উচ্চমাধ্যমিকে ওঠে। তখন সবে ছড়া লেখারও চেষ্টা করছি। পলিটেকনিকে ভর্তি হলাম ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে থাকতো গণগ্রন্থাগারে। ক্লাস শেষ করেই সোজা গিয়ে ঢুকে পড়তাম রাজশাহীর বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগারে। অনেক বই পড়েছি। তবে সেই সময় মনের ভেতর অন্যরকম এক আবহাওয়া তৈরি করেছিল হুমায়ুন আজাদের ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটি। তার লেখা আরও একটি বই আমাকে খুব আন্দোলিত করেছিল, 'আব্বুকে মনে পড়ে’। তারও আগে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ কতবার যে পড়েছি! আর পড়েছি প্রচুর ছড়ার বই। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ এক অন্যজগতে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে।

আপনার প্রিয় লেখক কে এবং কেন? প্রিয় কোন বই?

প্রিয় লেখকের তালিকা অনেক দীর্ঘ হবে। আলাদা করে কারও নাম বলতে গেলে অনেক প্রিয় লেখকের নাম বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যার লেখা পড়ে ভালো লাগে সে-ই আমার প্রিয় লেখক। অনেক তরুণ লেখকও আছেন এ তালিকায়। হয়তো কারও একটা লেখা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, সেই কারণেই তাকে প্রিয় লেখক হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে।

আপনার জীবনে কোন শিক্ষক আছেন কি এখনও বেঞ্চে বসে যার ক্লাস করতে ইচ্ছে করে?

আমার জীবনে একজন খুব ভালো শিক্ষক আছেন, তার নাম আশফাকুল আশেকীন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক নন, কিন্তু তাকে সবসময় ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করি। এক সময় সরকারি স্কুলের ড্রয়িং টিচার ছিলেন। দুর্দান্ত ছবি আঁকেন, ছড়া লিখেন, কবিতা লিখেন। এই অশীতিপর মানুষটাই শিশুদের ছবি আঁকা শেখাচ্ছেন নিজের স্কুলে। আমি মাঝেমধ্যে তার স্কুলে গিয়ে বসে থাকি। আমার কয়েকটা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করেছেন তিনি। এ মেলায় প্রকাশিত ‘গোয়েন্দা ডাব্লিউ হিং টিং ছট’ এর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ তারই করা। মজার ব্যাপার হলো তার সঙ্গে গল্প করলেই অসংখ্য থিম মাথার ভেতরে ভিড় করে। মনে হয় অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করার আছে। লেখক জীবনে আশেকীন স্যারের মতো একজন শিক্ষকের প্রয়োজন ছিলো আমার।

ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোতে শিশুদের জন্য পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ নেই। এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে ঢাকায় নতুন করে কোন পার্ক গড়ে ওঠেনি। কেবল বই পড়িয়েই কি শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব?

মন সুস্থ রাখবে বই, আর শরীর সুস্থ রাখবে খেলার মাঠ। কোনো শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ এসবের কোনো বিকল্প নেই। আর এসব না পাওয়ার কারণে আমাদের শিশুরা দিনে দিনে রোবোটিক হয়ে উঠছে। তাদের বন্ধু এখন কম্পিউটার, গেম এসব। শুধু বইপাঠ করে শিশুদের ভবিষ্যৎ প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। শারীরিকভাবে দুর্বল কোনো শিশু কীভাবে জাতির ভবিষ্যৎ হবে!

ভবিষ্যতে আর কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে?

শিশুসাহিত্য নিয়েই আমৃত্যু কাজ করে যেতে চাই। ছড়া লিখে আনন্দ পাই। ছোটদের জন্য গল্প লিখেছি, লিখছি। কিশোর উপন্যাসও লেখা হলো। আরও কয়েকটা কিশোর উপন্যাস লেখার কাজ চলছে। ছড়া, কিশোর-কবিতা নিয়ে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টা করছি। এমন কিছু করতে চাই যে কাজটা আগে করা হয়নি, যে কাজটা আমিই প্রথম করছি। জানি না সেই লেখাগুলো কখন, কীভাবে, কোথায় তৈরি হবে। শুধু গল্প উপন্যাসেই নয়, ছড়াসাহিত্যে সুপারহিরোদের মতো ক্যারেক্টার তৈরি করতে চাই, যা শিশুদের নিয়ে যাবে নতুন এক জগতে।