‘জোখ’ মেসোআমেরিকার একটি প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী। এ ভাষায় কথা বলার মানুষের সংখ্যা মাত্র ৭৫ হাজার।
Published : 23 Oct 2024, 12:32 AM
অনূদিত কবিতাগুলো লেখা হয় জোখ ও স্প্যানিশ ভাষায়। সেখান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ওয়েন্ডি ক্যাল ও শুক। এগুলো সানচেজের সর্বশেষ কবিতার বই ‘হাউ টু বি অ্যা গুড স্যাভেজ অ্যান্ড আদার পয়েমস’ এর অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে বইটি প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি অব গুয়াদালাজারা প্রেস।
জোখ মেক্সিকোর একটি আদিবাসী ভাষা। চিয়াপাস রাজ্যের জোখ জনগোষ্ঠী এই ভাষায় কথা বলে। এরা মেসোআমেরিকার একটি প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জোখ ভাষা চিয়াপাসের আশপাশের অল্পকিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ভাষায় কথা বলার মানুষের সংখ্যা মাত্র ৭৫ হাজার। বর্তমানে এটি মেক্সিকোর বিপন্ন আদিবাসী ভাষাগুলোর একটি।
মিকেয়াস সানচেজ প্রথম কোনো মেক্সিকান নারী, যিনি জোখ ভাষায় কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। সানচেজের ইংরেজি অনুবাদক ক্যালের মতে, মেক্সিকোর অভিজাত সাহিত্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত প্রতিরোধের অংশ হিসেবে তিনি কবিতা লেখার ক্ষেত্রে জোখ ভাষাকে বেছে নিয়েছেন।
৪৪ বছর বয়সী সানচেজের জন্ম ১৯৮০ সালে চিয়াপাস রাজ্যের। আজ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬। এই কবি জোখ জনগোষ্ঠীর সংগঠন ‘জোডেভিটে’ এর প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগঠনটি মেক্সিকোর চিয়াপাসে জোখদের ভূখণ্ডে নানা হুমকির বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।
সানচেজের কবিতায় মিশে আছে সবাই একসঙ্গে কাজ করার প্রতি অঙ্গীকার। ২০১৮ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সানচেজ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “এটি মিকেয়াসের কবিতা নয়, বরং আমার সম্প্রদায়ের ভেতরে থাকা কবিতা। তারা যে নিজেদের মধ্যে এই কবিতা বহন করে চলেছে, এটা হয়তো জানেও না।…এক ধরনের শামান হিসেবে সম্প্রদায়ে আমার দাদার পরিচিতি ছিল। তাই আমি মনে করি, এই কবিতাগুলো এক ধরনের মন্ত্রও। এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের আহ্বান করার একটি উপায়, সেইসঙ্গে তাদের সঙ্গে আবার জন্ম নেওয়ারও।”
বাবা দিয়েছিলেন এক উপহার
যখন ছোট ছিলাম, বাবা এনে দিলেন এক উপহার
হলুদ একটা পাখি, গায়ে যার কমলা দাগ।
একটা ছোট্ট পাখি, ঠিক আমার মুখের সোজাসুজি
গান গাইত যা
আর শেখাত বিভিন্ন জিনিসের নাম।
উই, উই, উই
ওর, ওর, ওর
উইক উইক উইক
যখন বয়স ছিল কম,
পিচ্চি হলুদ একটা পাখি
গাইতে শেখাল জোখ ভাষায়,
আর পুরো পৃথিবীকে মেলে ধরলো সামনে
দেখাল আমাকে সমগ্র মানবজাতির ভাষা।
যদি তুমি কথা দাও, অবশ্যই সেটা রাখবে,
মিথ্যা যদি বল, তবে নিজেকেই অপমান করবে।
আর এ কারণেই আমাদেরকে ডাকা হয়, ‘ওরেপাত’, ‘ওরেওমো’
আমরা সেই নারী-পুরুষ, কথা দিয়ে যারা কথা রাখি।
ওই যে পাহাড়, সেখানে বেড়ে ওঠে ‘উয়েউয়ে’,
একটা হলুদ ফুল, শরীরে যার কমলা ক্ষত,
একটা পাখি, যা গান গায়,
আর গাইতে শেখায় জোখদের
উই, উই, উই
ওরে, ওরে, ওরে
উইক, উইক, উইক।
এক মোকায়া নারীকে অভ্যর্থনা
মোকায়া,
আদরের কন্যা আমার,
তোমার আসাতে আমরা সম্মানিত অনুভব করছি।
পৃথিবীর পাতাল থেকে তুমি এসেছ
সঙ্গে এনেছ বজ্রপুরুষের অভিবাদন,
আর বাতাস-দেবীর শক্তি।
সঙ্গীতময় আত্মা তুমি
আজওয়ের পূর্বসূরী নারীদের।
কেউ কেউ বলে, আর কোনো মোকায়া থাকবে না,
আমরা যাচ্ছি বিলুপ্তির দিকে।
কিন্তু তুমি, প্রিয় সন্তান আমার
আসো, আবার নতুন কর আমাদের।
সেই সিবা গাছের শিরায়
আমাদের রক্ত প্রবাহিত
পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে,
ততদিন বেঁচে থাকবে তারাও।
অন্তর দিয়ে চিন্তা
দাদা বলতেন,
আমরা জোখরা শব্দের উত্তরাধিকারী।
কিন্তু এখন শব্দের ধার কে ধারে?
প্রায় সবাই মিথ্যাকে বেছে নেয়
পৃথিবীর রত্ন লুট করতে।
দাদা বলতেন,
আমাদের এই ভূমি ছিল ধন-সম্পদে ভরা
সে কারণেই মাইনাররা এলো
আর চুরি করতে চাইল শেষ পাথরটাও।
দাদা বলতেন,
অমূল্য সেই ভাণ্ডারের কথা,
আমাদের চিন্তা ও হৃদয়ে যা ভাষাকে ফুটিয়ে তুলত
আর আমাদের অসামান্য গাছ ‘উয়েউয়ে’র কথা।
‘উয়েউয়ে’ উসকে দেয় শিশুর মুখে ফুল ফোটাতে
আর নকল করতে কার্ডিনাল ও কালো পাখিদের
আমাদের মাটিতে যারা বয়ে আনে আনন্দের বন্যা।
এ কারণেই নহকিরাওয়ারা কখনও বুঝতে পারেনি আমাদের
ওরা চিন্তা করে মাথা দিয়ে, আর আমরা অন্তর দিয়ে।
কী করে একজন ভালো আদিম হওয়া যায়
আমার দাদা সিমোন একজন ভালো আদিম হতে চেয়েছিলেন,
উনি শিখেছিলেন স্প্যানিশ,
আর সব সাধুর নাম।
নেচেছিলেন বেদির সামনে,
আর একটা হাসি দিয়েই হয়ে গেলেন ব্যাপ্টাইজড।
রেড থান্ডারের শক্তি ছিল আমার দাদার,
আর তার নাগুয়াল ছিল একটা বাঘ।
আমার দাদা ছিলেন একজন কবি
শব্দ দিয়ে যিনি সারিয়ে তুলতেন।
কিন্তু তিনি একজন ভালো আদিম হতে চেয়েছিলেন
চামচ দিয়ে খেতে শিখেছিলেন,
আর ‘নহকিরাওয়া’র বৈদ্যুতিক বাতিগুলো
মুগ্ধ করেছিল তাকে।
আমার দাদা ছিলেন ক্ষমতাধর একজন শামান
যিনি কথা বলতেন দেবতার ভাষায়,
তিনি একজন ভালো আদিম হতে চেয়েছিলেন,
কিন্তু কী করে হতে হয়
কখনোই সেটা পুরোপুরি শিখতে পারেননি।
টীকা
‘বাবা দিয়েছিলেন এক উপহার’ কবিতায় ব্যবহৃত ‘ওরেপাত’ ও ‘ওরেওমো’ শব্দ দুটি জোখ ভাষার। ‘ওরেপাত’ হচ্ছে যারা কথা দিয়ে কথা রাখে। আর ‘ওরেওমো’ মানে যারা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করে, কথার মর্যাদা রাখে।
‘উই, উই, উই’, ‘ওরে, ওরে, ওরে’, ‘উইক, উইক, উইক’ হলো পাখির ডাক। প্রতীকী অর্থে যে পাখি জোখ ভাষা শেখায় এবং প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ককে প্রকাশ করে। একই সঙ্গে তার মাধুর্যময় কণ্ঠের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞান পৌঁছে দেয়। ‘উয়েউয়ে’ জোক সংস্কৃতিতে এক ধরনের হলুদ ফুল, পাহাড়ি বনাঞ্চলে জন্মায়। ফুঁ দিলে এটিতে পাখির গানের মতো এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়।
‘কী করে একজন ভালো আদিম হওয়া যায়’ কবিতায় ব্যবহৃত নাগুয়াল (নাহুয়াল) শব্দটি মেসোআমেরিকান ও টলটেক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষ করে, এটি মেক্সিকোর নাহুয়া জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের অংশ। নাগুয়াল বলতে এমন আধ্যাত্মিক সত্তা বা ব্যক্তি বোঝায়, যিনি কোনো নির্দিষ্ট প্রাণী বা প্রাকৃতিক রূপে তার আকার পরিবর্তন করতে পারেন। এটি প্রায়শই ‘রক্ষাকর্তা আত্মা’ বা কারো ‘আধ্যাত্মিক জমজ’ রূপে বিবেচিত হয়। কিছুক্ষেত্রে এটি চিতা, ঈগল, কায়োট বা আমেরিকান শেয়ালের মতো প্রাণীর রূপধারণ করতে পারে।