মৌমাছিরা যে যেখানে পারে, সেখানেই দু-একটা হুল ফুটিয়ে দেয়। এমন অতর্কিত হামলায় কিশোররা কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ে।
Published : 21 Mar 2025, 12:56 AM
সামনের দিকে আঙুল দিয়ে কিছু একটা দেখিয়ে ‘ওই তো হরিণটা’ বলেই ইমরান আবার ছুট লাগায়। দেখাদেখি অন্যরাও তার পিছে পিছে ছুটতে থাকে। আর এই ছুটতে গিয়েই একটা বিরাট গোল বেঁধে যায়। একটু আগে মিঠুর কাছ থেকে জিসানের কাঁধে নেওয়া ব্যাগটা, নিচু হয়ে মাটির সমান্তরাল একটা গাছের ডালে থাকা মৌমাছির বাসায় লেগে যায়। মৌচাকের অনেকটা অংশ ভেঙে পড়ে। চাক ভাঙায় কয়েক হাজার মৌমাছি মুহূর্তেই আক্রোশে ফেটে পড়ে।
নিজেদের বাসা ভাঙার প্রতিশোধ নিতে, কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই মৌমাছিগুলো অভিযাত্রী দলকে আক্রমণ করে বসে। মৌমাছিরা যে যেখানে পারে, সেখানেই দু-একটা হুল ফুটিয়ে দেয়। এমন অতর্কিত হামলায় কিশোররা কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ে। কে কী করবে, কোনদিকে যাবে, কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কারও কপালে, কারও গালে, কারও কারও হাতে-মাথায়-ঘাড়ে দু’একটা হুল ফুটতেই, বিষের যন্ত্রণায় তাদের প্রাথমিক হতভম্ব ভাব কেটে যায়।
কিন্তু মৌমাছির চতুর্মুখী আক্রমণে, বোধ-বুদ্ধি খাটিয়ে করণীয় নির্ধারণ করার কোনো সময় ও সুযোগ তারা পায় না। তাই তারা শুধু এই জায়গা থেকে পালানোটাই ঠিক বলে মনে করে। ছুটতে ছুটতে তারা পালাতে থাকে অথবা পালানোর জন্য তারা ছুটতে থাকে। আর মৌমাছিরাও পিছু নিয়ে উড়তে-উড়তে ছুটতে-ছুটতে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে, আর কিশোররা দৌড়াতে থাকে। যন্ত্রণা ও ভয়ে কিশোরদের দু’একজন ততক্ষণে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদতে-কাঁদতে ছুটতে-ছুটতে কে কোথায় কোনদিকে গেছে, সেদিকে তাদের কারও কোনো খেয়াল থাকে না।
খেয়াল করার সুযোগও নেই। মৌমাছিরা তাদের কাউকেই সে সুযোগ দিচ্ছে না। শুধু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আর সুযোগ পেলেই হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ এভাবে চলার পর চার কিশোরের প্রত্যেকের পিছু নিতে গিয়ে মৌমাছিরাও কয়েকটি দলে-উপদলে ভাগ হয়ে পড়ে। কিশোরদের ওপর দয়া দেখিয়ে, নাকি নিজেরা দলে উপদলে ভাগ হয়ে পড়েছে বলে মৌমাছিরা হঠাৎ তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা বাদ দিয়েছে, বোঝা যায় না। কিন্তু একসময় মৌমাছিদের আর কোথাও দেখা যায় না।
মাথার ওপর মৌমাছিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ বন্ধ হয়েছে। আশপাশে আর মৌমাছি দেখা যাচ্ছে না। এসব খেয়াল করে, দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত কিশোররা অল্প-বিস্তর সময়ের ব্যবধানে একেকজন, একেক জায়গায় থামে। এতক্ষণ দৌড়ানোর ফলে বুকের ভেতর বাতাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই থেমে গিয়ে তারা হাঁপাতে থাকে। জোরে জোরে দম নিতে থাকে।
জিসান আর ইমরান একসাথে ঘাসের ওপর মাটিতে বসে পড়ে। দুজনেরই হাত, মুখ ও মাথার কয়েকটি জায়গায় হুল ফুটেছে। সেসব জায়গা ছোপ ছোপ গোলাপি বা লালচে দাগ নিয়ে ফুলে ফুলে উঠেছে। ব্যথার যন্ত্রণা জানান দিচ্ছে- মৌমাছির বিষ সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। জিসান চেষ্টা করেও আর বসে থাকতে পারে না। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে চার হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। ক্লান্তি ও ব্যথায় শরীরটা অবশ হয়ে আসে।
কিন্তু ইমরান দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করে। বসে থেকেই ফুলে উঠা ছোপ ছোপ লালচে জায়গাগুলোতে হাত বোলায়। হাত বোলাতে বোলাতেই চারপাশে তাকিয়ে খেয়াল করে, আদনান আর মিঠু তাদের সাথে নেই। নেই মানে নেই। কাছাকাছি কোথাও দুজনের কাউকেই দেখা যায় না। গাছঘন গহিন বনের ভেতর সংক্ষিপ্ত হয়ে আসা দৃষ্টিসীমায়, আদনান ও মিঠু কাউকেই তার চোখে পড়ে না।
‘এই জিসান, জিসান...... ওঠ, আরে তাড়াতাড়ি ওঠ না! মিঠু আর আদনানকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।’ – ইমরানের মায়াময় উদ্বেগ জড়ানো কণ্ঠস্বরে জিসান চট করে উঠে বসে। তারপর তড়িৎ চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ইমরানের দিকে ফিরে স্বাভাবিকভাবে বলে, ‘আরে মোটু আর কাঠি আমাদের সাথে দৌড়ে পারেনি। পিছিয়ে পড়েছে মনে হয়, এত চাপ নিস না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, দেখবি একে একে দুজনই চলে আসবে।’ ‘ওকে, একটু দেখে নিই। দে একটু পানির বোতলটা দে, গলাটা একটু ভিজাই। ভেতরটা একদম শুকিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।’
জিসান ব্যাগ খুলে পানির বোতলটা দিতেই, ইমরান ঢক ঢক করে বোতল থেকে গলায় পানি ঢালে। জিসানও গলায় পানি ঢেলে বুকের সাহারায় বৃষ্টি নামায়। তারপর দুজনই মৌমাছির কামড়ের জায়গাগুলোতে ব্যাগে করে নিয়ে আসা অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগায়।
সময় গড়িয়ে যায়। শরীরের ব্যথাটা সহনীয় পর্যায়ে থিতু হয়ে আসে। গহিন বনের শ্যামলিমা ছায়ার শীতল ঝিরঝিরে বাতাসে, দুই বন্ধুর ক্লান্ত শরীর শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তাদের অপর দুই বন্ধু তখনও ফিরে আসে না। আদনান আর মিঠুর কোনো দেখা নেই। অনেকটা সময় গড়িয়ে গেলেও ওরা এসে পৌঁছায় না। এবার আর কেউ স্থির থাকতে পারে না। দুই বন্ধুর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে চারপাশে তাকাতে তাকাতে যেদিক থেকে দৌড়ে এসেছিল, তারা আবার সেদিকে পিছিয়ে যেতে থাকে।
না, কারও কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। আরও একটু পিছিয়ে এসে এদিক সেদিক খোঁজ করতেই একটা গাছের নিচে জবুথুবু হয়ে বসে থাকা অবস্থায় আদনানকে পাওয়া যায়। ঠোঁটের একাংশ ফুলে আছে। গালে, থুতনিতে এবং আরও কিছু জায়গায় গোল গোল গোলাপি দাগ, মৌমাছির অত্যাচারের সত্যতা ঘোষণা করছে। দুই বন্ধু মিলে কামড়ের জায়গাগুলোতে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দেয়। পানি খেতে দেয়। আরও কিছুক্ষণ সেবা-যত্ন করলে আদনান একটু সোজা ও শক্ত হয়ে বসে। কিন্তু মিঠু! মিঠুকে আশপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
সূর্য পশ্চিম আকাশে কতটুকু হেলে পড়েছে দেখা যায় না। গাছের ফাঁক দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, তাতে বোঝা যায় ঘন ধূসর মেঘ আকাশের দখল নিয়েছে আরও আগেই। তাদের এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকানোর সুযোগ মেলেনি অথবা বলা যায়- মৌমাছি তাদের সে সুযোগ দেয়নি। মেঘের আড়ালে দিনের আলো মুছে গেছে। গহিন বনে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি খেলা করেছে। অথচ জিসান মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখে- পাঁচটা বাজতে এখনো তেরো মিনিট বাকি। মাগরিবের আজান পড়তে এখনো প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে।
কিন্তু স্টেশনে গিয়ে ফিরতি বাস পেতে হলে এখনই রওয়ানা দেওয়া প্রয়োজন। জিসানের কাছ থেকে সময় জেনে নিয়ে ইমরান সবাইকে কথাটা মনে করিয়ে দেয় এবং মিঠুকে খোঁজার জন্য উঠে পড়ে। আদনান উঠে দাঁড়ালে জিসান জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে হাঁটতে পারবি তো?’ প্রশ্ন করে জবাব পাওয়ার আগেই ‘কষ্ট হলে, নে আমার হাতটা ধরে থাক’ বলে আদনানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় সে।
আদনান, জিসানকে ধরে ধরে একটু সময় হাঁটতেই তার শরীরের জড়তা কেটে যায়। মৌমাছির কামড়ের ব্যথাও সহনীয় হয়ে এসেছে প্রায়। কিন্তু মিঠুকে পাওয়া যায় না। তিন বন্ধু মিলে এলোমেলো এদিক-সেদিক ঘুরে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে আর কাঁদতে-কাঁদতে মিঠুকে খোঁজে।
এদিকে সময় গড়িয়ে যায়। আবছা অন্ধকার এখন প্রায় ঘন হতে চলেছে। স্টেশনে গিয়ে বাস না পেলে মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। বাস ছাড়া এতদূর যাওয়ার জন্য সিএনজি বা অন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। আর পাওয়া গেলেও তাদের কাছে সে পরিমাণ টাকা নেই। এত টাকা ভাড়া দিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে না। এসব ভাবনা মাথায় নিয়ে ইমরান এদিক-ওদিক মিঠুকে খোঁজে। বাড়ি ফেরার তাড়না ও মা-বাবার বকা খাওয়ার ভয় নিয়ে আদনান আর জিসান বন্ধুর খোঁজ করতে থাকে।
প্রথমে খুঁজতে খুঁজতে বিরক্তি নিয়ে ‘বোকা, গাধা, উল্লুক-ভাল্লুক’ গালাগাল দিয়েছে সবাই। ইমরান তো বলেই ফেলেছে, ‘এই জন্যই ওরে আনতে চাইনি, তোদের আহ্লাদে নিয়ে এসে এখন কী মুসিবতের মধ্যে পড়লাম! পোলাডা যে কোনদিকে গেল কে জানে!’ কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবার প্রাথমিক ধারণাগুলো বদলে যায় বা বদলে গেছে বলা যায়।
চলবে...