বইপাঠ মানুষের মগজের জন্য একটা চমৎকার ব্যায়াম। বইপাঠের অভ্যাস তৈরির জন্য বই কিনতে হয়।
Published : 06 Feb 2024, 12:05 PM
পিকনিকের মাঠে বসে আড্ডা হচ্ছে এক কিশোরীর সাথে। নবম শ্রেণিতে পড়ে। অবসরে গল্প লিখতে পছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেলো গল্পের উপাদান, চরিত্র, প্লট তৈরি নিয়ে আরও জানতে সে বই পড়ার চাইতে সিনেমা দেখতে বেশি পছন্দ করে, কারণ সিনেমাও একটা গল্প। কষ্ট করে পড়ার চাইতে ওর গল্প দেখাটা বেশি সহজ বলে মনে হয়েছে!
খুব সম্প্রতি বই পড়া নিয়ে এমন আরও একটি ঘটনার মুখোমুখি হলাম একটি বইয়ের দোকানে। দোকানে দাঁড়িয়ে বই দেখছি। পাশেই দুই যুবতী এবং এক যুবকের মধ্যকার আড্ডার কিছু অংশ কানে এলো। যুবক বলছে, আমি এ জীবনে একটামাত্র বই পুরো পড়েছি ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’। একজন যুবতী বললো, আমি এ জীবনে একটাও বই পুরোটা পড়ি নাই। আরে, আমিতো ক্লাসের বই-ই পুরোটা পড়ি না। খালি স্লাইড পড়ে পাশ করেছি। এ কথার পর তিনজনের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেলো!
বইপাঠের অভ্যাস তৈরি বেশ পরিশ্রমের। এই পরিশ্রম অভিভাবককেই করতে হয়। এ অভ্যাস শিশুবেলা থেকে বাড়ির পরিবেশেই গড়ে তুলতে হয়। বাড়ির পরিবেশে বড়দের মধ্যেও বইপড়ার অভ্যাস থাকতে হয়। জলজ্যান্ত উদাহরণ বা রোল মডেল না হলে শিশুদের পক্ষে কল্পনায় কোন কাজের বা অভ্যাসের ভালোটা বুঝে, চর্চা করে অভ্যাস তৈরি করাটা খুব কঠিন।
বইপাঠের অভ্যাস তৈরির জন্য বই কিনতে হয়। বই কেনার তালিকায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই এর পাশাপাশি অন্যান্য লেখকের লেখা বইয়ের কথাও বলা হচ্ছে। স্কুল ও কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো পড়ার চাপ। প্রথমে স্কুল, তারপর বাড়ি ফিরে গৃহশিক্ষক বা কোচিং! সময় কম। কিন্তু রাতে ঘুমাতে যাবার আগে? হাতে অন্তত ১০ মিনিট সময় থাকে। এই ১০ মিনিটই হতে পারে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোন বই পড়ার সময়!
কিন্তু এই বইগুলো পড়ার এতো তাগিদ কেনো? সার্টিফিকেট-ভিত্তিক বইপাঠ কি যথেষ্ট নয়! পৃথিবীর বুকে মানুষ ছাড়া আর কোনো সেরা জীব বুদ্ধিতে আমি দেখি না। আর বুদ্ধিমান এই মানুষ একে অপরের সাথেই বসবাস করে, থাকে, কথা বলে, নির্ভর করে বেঁচে থাকে, হাত ধরে, সমস্যার সমাধান করে, আবিষ্কার করে, পাশে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসে। দিন শেষে মানুষ মানুষের জন্য। ভেবে দেখলে একটা মানুষ শৈশব থেকে বাবা মায়ের সংস্পর্শে একরকমভাবে শেখে, ইন্টার্যাক্ট করে, পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়।
আবার স্কুলে গিয়ে অন্য আরেক ডাইমেনশনের জ্ঞান, তথ্য, তত্ত্ব ভেতরে নেয়। তারপর চাকরিক্ষেত্রে আরও নানা রকমের মানুষ জীবনে আসে। বিয়ের পর জীবনে আসে জীবনসঙ্গী। জীবনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নানা মানুষের সংস্পর্শে আসে। এ মানুষগুলো তখন আমাদের মানুষের রূপ সম্পর্কে বোঝায়, টিকে থাকতে শেখায়। নানা সম্পর্কের কাছাকাছি এসে আমাদের নিজেদের গ্রোথ হয় ভাবনায়, চিন্তায়, বুদ্ধিতে। মানুষ হয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা এবং আদান-প্রদানের মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে নেওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা মানুষ তাই মানুষের কাছ থেকেই নিই। এই নেওয়াটা সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে, মুখোমুখি বসে, ফোনে, সোশ্যাল মিডিয়ার, বইপাঠের মাধ্যমে; নানাভাবেই হতে পারে। মানুষ হয়ে মানুষ সম্পর্কে জানতে তাই কোন মাধ্যমকেই ছোট করে দেখা যায় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো মাধ্যম অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়া হচ্ছে, তাহলে আবার বই কেনো? বই পড়লে কী হয় এ সম্পর্কে বলার প্রয়োজন মনে হয় নেই। কারণ একজন যিনি পড়েন না তাকে জিজ্ঞাসা করলেও বইপাঠের গুণাগুণ সম্পর্কে দুই কি তিন লাইন বলে ফেলতে পারবেন। যেভাবে সারাবছর বই না পড়ে বইমেলায় একদিন গিয়েই বইপাঠ ও পড়া নিয়ে অনেকেই বলে ফেলতে পারেন! কাজেই বই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা জানি।
এখন পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যসব বই পড়া কেন? কারণ লেখার মাধ্যমে আমরা নানা মানুষ, নানা চরিত্র সম্পর্কে জানি। এই যেমন গল্পের অনেকগুলো চরিত্র একসাথে কথা বলছে, ভাবছে, উত্তর দিচ্ছে। এই যে কথোপকথন এগুলো আমাদের মানুষ নিয়ে চিন্তার নানা ক্ষেত্রে পরিকল্পিত এবং অপরিকল্পিতভাবে আঘাত করে। এ আঘাত সিনেমা করে, এ আঘাত নাটক করে, কিন্তু বিশেষভাবে বই করে। বইপাঠের সময় কল্পনায় আমরা চরিত্রগুলোকে দেখতে পাই। চরিত্রগুলোকে দাঁড় করাই, সাজাই, মনের মতো করে পোশাক পরাই। পুরো কল্পনাটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে। এটা একটা ক্ষমতা। এটা একটা শক্তি।
এ আমাদের কল্পনার জায়গাটাকে শাণিত করে। একটা চরিত্র নিয়ে কত বিশদ বর্ণনা থাকে! জে কে রাউলিং-এর সিনেমাগুলো যারা আলাদা করে দেখেছেন আর বইগুলোও পড়েছেন; লেখা ও সিনেমার পার্থক্য তারা খুব ভালো জানেন। লেখায় পাঠক তার নিজের কল্পনা ম্যানুফ্যাকচার করে! আর সিনেমায় একটা তৈরি করা কল্পনার জগতে পাঠক ট্যুর দেন! দুটো নিশ্চয়ই এক নয়! এই যে পার্থক্য এটা বোঝার জন্যও ভাবতে হয়। ভাবনা ছাড়া আছে কোন গতি? মানুষ হয়ে কেউ বলতে পারবে যে, না ভেবেই জীবনটা বিন্দাস পার করে দিলাম বা দেবো? দিলেও তার পরিণতি কি খুব ভালো হয়!
বইপাঠ মানুষের মগজের জন্য একটা চমৎকার ব্যায়াম। আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি। এ সিনেমার গল্পও পড়া হয়েছে। এ সিনেমায় ভীষণ নিখুঁতভাবে লেখকের কল্পনাকে দর্শকের সামনে এনেছেন নির্মাতা। কোথাও কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু বই আরও বিশদ, গল্প আরও দীর্ঘ। রায় সাহেব আমাদের সবার হয়ে সব চাইতে কঠিন কাজটাই করেছেন পড়ে, ভেবে, কল্পনা করে, সিনেমা তৈরি করেছেন। তার মগজের ব্যবহার ও প্রয়োগ এখানে সর্বোচ্চ! কারণ লেখার বর্ণনা কল্পনা করে কিছু বানানো একেবারেই সহজ নয়! কাজেই সিনেমা আমাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু সিনেমা দেখেই কি বলে ফেলা যায় আমার জে কে রাউলিং বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে জানা হয়ে গেছে! আমি প্রশ্ন করছি; এ উত্তর পাঠক দেবেন।
পাঠ্যবই ভীষণ প্রয়োজনীয়। ওটাও পরীক্ষার ভয় ও ভীতি বাদ দিয়ে ঠিকঠাকভাবে পুরোটা পড়লেও ভালো পাঠ হয়। কিন্তু এখানে স্লাইড, গাইড বই এবং বেছে বেছে পড়ার অভ্যাস আমাদের লেখক, লেখা, গল্প সম্পর্কে জানতেই দিচ্ছে না! আমরা মগজের কম ব্যবহার সম্পর্কে মনে হয় সার্টিফিকেটভিত্তিক লেখাপড়া করতে গিয়েই শিখি। কাজেই অন্য বই পড়া তখন চাপ। একজন শিক্ষক, অভিভাবক যদি পাঠ্যবইয়ের লেখা পড়েন এবং লেখক সম্পর্কে আরও জানতে লেখকের আরও কিছু লেখা শিশুর সাথে পাঠ করেন, পড়তে দেন তাহলে নিঃসন্দেহে বোর্ডের পরীক্ষায় সেই শিক্ষার্থী লেখক সম্পর্কে আরও দুটো সৃজনশীল লাইন বেশি লিখতে পারবে। কাজেই বইপড়া চাই মগজের ভালো রকমের দলাই ও মলাইয়ের জন্য। কিন্তু তা না করে মগজের কম ব্যবহার নিয়ে কেউ সন্তুষ্ট হয়ে বই পড়তে না চাইলে তিনি বই হয়তো পড়লেন না, কিন্তু জীবনের নানা ক্ষেত্রেই মগজের কম ব্যবহার সম্পর্কে জেনে গেলেন।
সাংসারিক জীবনেও এসব মানুষ মগজ খাটিয়ে ভাববেন বা কর্মক্ষেত্রেও ভাববেন এমনটা মনে হয় না। কাজেই শিশুবেলা থেকে বই পড়া, পাঠের অভ্যাস মগজের জন্য এমন পুষ্টি সরবরাহ করে যা অদৃশ্য হয়ে থেকে আজীবন আমাদের সমস্যার সমাধানে, জীবন পরিচালনায়, ভাবনায়, এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পাশে থেকে যায়! বই অবসরের বন্ধু। বই শেখায়, ভাবায়। বই জানায়। বই আলোকিত করে ‘মানুষ’ ও তার জ্ঞান সম্পর্কে।
বইপাঠের বিকল্প অনেকেই খোঁজেন। কিন্তু সত্যি ভেবে দেখুন তো একটা বই যা পড়েছেন তা আপনার ভেতরেই গেছে আপনার আত্মার ভেতরেই রয়ে গেছে। এ কেউ নিতে বা দিতে পারেনি। আপনি নিজেই নিজের জন্য এটা করলেন! এটা সময়ের, পরিশ্রমের, কিন্তু মগজ খাটিয়ে ভাবলে আনন্দের। সেটা শেষ করার, পড়ার, কিছু করার। এটা বুঝতে গেলেও ভাবতে হবে। সময় দিতে হবে। ভাববেন, সময় দেবেন আর জানবেন ‘বই ছাড়া গৃহ আর মগজ ছাড়া দেহ’, কন্সেপচুয়ালি একই কথা বলে।