১৯৫৫ সালে এক শিক্ষকের কাছে একটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান লোকগবেষক এনামুল হক।
Published : 23 Jan 2025, 04:43 PM
চট্টগ্রাম কলেজে তখন অধ্যাপনা করেন লোকগবেষক এনামুল হক। সালটা ১৯৫৫। এক শিক্ষকের কাছে একটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান তিনি। পাণ্ডুলিপিটা মধ্যযুগীয় কবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ ভাবা হলেও পাঠানুসন্ধানের পর জানা যায়, এটি কবি শ্রীমতী রহিমুন্নেচার অনুলিখিত একটি পুঁথি।
পুঁথিতে রহিমুন্নেচার জন্মসাল উল্লেখ ছিল না। কবির জন্মসাল নিয়ে মতভিন্নতা তৈরি হলো। লোকগবেষক এনামুল হক আবিষ্কৃত পুঁথিখানা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসেন, কবি শ্রীমতী রহিমুন্নেচা ১৭৯০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে জন্ম নেন। তিনি ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মুসলমান মহিলা কবি’ শিরোনামে বাংলা একাডেমী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রবন্ধ প্রকাশ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শ্রীমতী রহিমুন্নেচাকে বলা হয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ‘প্রথম ও একমাত্র মুসলমান নারী কবি’। গবেষক মো. জোবায়ের আলী জুয়েল তার ‘প্রথম মুসলমান গদ্য লেখিকা’ শিরোনামে প্রবন্ধে লিখেন, “অষ্টাদশ শতকে প্রথম মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নেসাকে দেখা যায়। তাঁর পূর্বে মুসলিম লেখিকার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না।” চট্টগ্রামে রহিমুন্নেচার সমাধিস্থলে প্রস্তরফলকে তার জন্মসাল লেখা আছে- ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
কবি রহিমুন্নেচা উল্লিখিত পুঁথিতে উল্লেখ করেছেন, তার পিতৃপুরুষ মক্কার কোরাইশ বংশের উত্তরসূরি। কারবালা যুদ্ধের পর তার দাদা সপরিবারে বাগদাদ থেকে বিহারের মুঙ্গে আসেন। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মুঙ্গেরে বাংলার নবাব মীর কাশিম ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলে রহিমুন্নেচার পিতামহ সর্বস্ব হারিয়ে সপরিবারে চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে ‘জঙ্গল শাহ’ নাম ধারণ করেন। এখানে অনেককে মুরিদ করেন তিনি। চট্টগ্রামের শুলকবহরে জঙ্গি শাহের মাজার এখনও আছে।
কবি রহিমুন্নেচার পিতা আবদুল কাদির চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার শুলকবহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। এখানে কবি শ্রীমতী রহিমুন্নেচা জন্ম নেন। তার শৈশব কেটেছে শুলকবহরে। এটা তিনি তার অনুলিখিত পুঁথিতেও বিস্তারিত লিখেছেন- “নাম গোত্র বিরচিয়া করিমু বর্ণন। /কর্ণগতে শুন মন দিয়া কবিগণ। /জংলী শাহা নাম করি গুণে অনুপাম। /আহালে কোরেশ বংশে উৎপত্তি তাহান।…/অনেক লাঘবে নিজ জম্মভূমি ছাড়ি। / চট্টগ্রামে আসিয়া রহিলা বাস করি। / পির হই শিষ্য কৈলা কত কত গ্রাম। /প্রকাশ হইল তান যশ কৃতি নাম।”
এনামুল হক আবিষ্কৃত পুঁথির শেষাংশে কবি রহিমুন্নেচার আত্মজৈবনিক বর্ণনায় বংশ পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে কবি লিখেছেন, “পীর হই রহে চট্টগ্রামেতে আসিআ। /সেক কোরসের বংশে জনম হইআ। /বহু সিস্ব করিলেক একাতে রহিআ। /তাহান মুরব্বীগণ দুষ্কিত হইআ। /মক্কা দেশ হন্তে এথা রহিল আসিয়া।”
কবি রহিমুন্নেচা শুধু নিজের নামের আগে ‘শ্রীমতী’ লিখতেন এমনটি নয়, মায়ের নামের আগেও শ্রীমতী লিখেছেন। মায়ের নাম ছিল শ্রীমতী আলিমন্নিচা। রহিমুন্নেচারা তিন ভাই ও এক বোন ছিলেন। তিনি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার মেখল গ্রামের প্রাচীন জমিদার নন্দন আহমদ আলীকে বিয়ে করেন। আহমদ আলী রহিমুন্নেচার কোনো এক ভাইয়ের মুরিদ ছিলেন। তিনি রসিক ও ধার্মিক ছিলেন। কবি রহিমুন্নেচার শ্বশুড়বাড়িও ছিল চট্টগ্রামে। শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে এ পরিবারেও ঐতিহ্য রয়েছে।
কবি রহিমুন্নেচা দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জননী ছিলেন। চট্টগ্রামের মুসলিমলীগের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও ফজলুল কবির চৌধুরীর মাতা ফাতেমা খাতুন চৌধুরাণী ছিলেন কবির পৌত্রী। ফাতেমা খাতুন চৌধুরাণী কবি রহিমুন্নেচাকে দেখেছেন। তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমানোর স্মৃতিচারণ করেছেন গবেষক আবদুল হক চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। তিনি কবির স্মৃতিফলকে লেখা জন্ম ও মৃত্যু সালকে ‘সঠিক’ বলেও মত দিয়েছিলেন।
রহিমুন্নেচার শৈশবে তার বাবা মারা যান। আলিমন্নিচার তত্ত্বাবধানে তার লেখাপড়া চলে। এসময় তাকে তার ছোট ভাই আলেম আবদুল গাফফারও সহায়তা করেন। ভাইয়ের কাছে তিনি নানা বিষয়ে শিক্ষা নেন। এছাড়া মায়ের তত্ত্বাবধানে তিনি পটিয়ার পণ্ডিত আবুল হোসেনের কাছে বাড়িতে শিক্ষা পান।
রহিমুন্নেচার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে বিয়ের পর। এক্ষেত্রে বেশি কাজ করেছে স্বামীর উৎসাহ, যেমনটি পরে আমরা বেগম রোকেয়ার জীবনেও দেখি।
স্বামীর আগ্রহ ও অনুপ্রেরণায় আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের অনুলিখন করেন রহিমুন্নেচা। এনামুল হক রহিমুন্নেচার অনুলিখিত আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ জনসম্মুখে তুলে ধরেন। পরে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কবির আরেকটি আত্মপরিচয়ের সন্ধান পান। এটি দৌলত কাজী বাহরাম খাঁর লেখা ‘লাইলী মজনু’ কাব্যের অনুলেখন শেষে উল্লেখ আছে। এখানে রহিমুন্নেচা তার ভাইদের পরিচয় তুলে ধরেন।
মধ্যযুগের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার মধ্যে বড় হয়ে উঠলেও কবি শ্রীমতী রহিমুন্নেচা অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার অধিকারী ছিলেন। তার কাব্যে ‘পূর্বজন্ম’ ও ‘ঈশ্বর বন্দনা’ প্রসঙ্গের উল্লেখ এরই সাক্ষ্য বহন করে। তিনি লিখেছেন, “পূর্ব জন্মে কৈলু পাপ, সে দোষে ফলিল তাপ, /আশাভ্রষ্ট হৈলমি অনাথ।”
কনি রহিমুন্নেচা ধার্মিক ছিলেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। নিজের হাতে কোরআন ও কায়দা আমপারা লিখেছিলেন, তার মা শ্রীমতি আলিমন্নিচা এগুলো নিয়মিত পাঠ করতেন। রহিমুন্নেচার মৌলিক রচনার মধ্যে আছে- ‘আত্মবিবরণী’, ‘দোরদানা বিলাপ’ ও ‘ভ্রাতৃ বিলাপ’। ‘আত্মবিবরণী’-তে ৪৮টি শ্লোক আছে এবং ‘দোরদানা-বিলাপ’-এ ২০টি শ্লোক আছে।
‘দোরদানা-বিলাপ’ মূলত শোকগাঁথা। মধ্যযুগের প্রাচীন বাংলার অন্তঃপুরের নারীর সুখ-দুঃখ-কষ্টের গাঁথা আছে এখানে। ‘ভ্রাতৃ বিলাপ’-এর মধ্যেও এমন একটা সর্বজনীন দৃশ্যকল্প পাওয়া যায়। এটি তিনি লিখেছিলেন ছোট ভাই আলেম আবদুল গাফফারের মৃত্যুর পর। রহিমুন্নেচার ভাষাশৈলী ও বানান-রীতির সঙ্গে চর্যাপদের মিল পাওয়া যায়। প্রাচীন পুঁথি-সাহিত্যেরও একটা প্রভাব আছে। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্বামী আহমদ আলী মারা গেলে শোকে কাতর কবি শ্রীমতী রহিমুন্নেচার সাহিত্যচর্চার সমাপ্তি ঘটে।
রহিমুন্নেচার মৃত্যু নিয়েও আছে মতভিন্নতা। গবেষক আবদুল হক চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, কবি রহিমুন্নেচা ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ মারা যান। তার সমাধিস্থলে লেখা আছে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ। কবির একমাত্র ছেলে শেখ সিদ্দিক আহমদ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় হাটাজারি উপজেলার জাফরাবাদের নাম পরে ‘রহিমপুর’ করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি রহিমুন্নেসা, আহমেদ আবদুল্লাহ
২. রহিমুন্নিসা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র, শাহানা ইসলাম
৩. মধ্যযুগের মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নিসা, মো. জোবায়েদ আলী জুয়েল
৪. প্রথম মুসলমান গদ্য লেখিকা, মো.আলাউদ্দীন
৫. ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, গোলাম কুদ্দুছ।