সুস্বাস্থ্যের জন্য ওজন কমানো কতটা জরুরি?

সুস্বাস্থ্য আসলে কী? ডায়েট করলে কী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যাবে?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2022, 06:50 AM
Updated : 31 August 2022, 06:50 AM

“ওজন নিয়ে আর মাথা ঘামাব না, খাবার নিয়েও আর বাছ-বিচার করব না।”

এরকম ভাবতে ভালোই লাগে। কিন্তু সেটা কী শরীরের জন্য ভালো?

বিজ্ঞাপন আর পপ সংস্কৃতিতে ক্ষীণতনুদের জয়জয়কার। এমনকি চিকিৎসকরাও ওজন নিয়ে একই সুরে কথা বলেন: হালকা শরীর মানেই সুস্বাস্থ্য, মোটা মানেই অস্বাস্থ্যকর।

তবে জেনেট টমসন-ওয়েসেন বলছেন, স্বাস্থ্য ও শরীরের ভালো-মন্দ বিচার করার বিষয়টি অতটা সরল নয়। একেক জনের বেলায় সুস্বাস্থ্য একেকভাবে ধরা দিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের এই পুষ্টিবিদ সুস্বাস্থ্যের শর্ত হিসেবে ওজন কমানোর ওপর জোর দিতে রাজি নন।

ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের টাচস্টোন ডায়াবেটিস সেন্টারের ইন্টারনাল মেডিসিনের অধ্যাপক ও পরিচালক ফিলিপ শেরের বলছেন, বডি মাস ইনডেস্ক (বিএমআই- ব্যক্তির ওজন আর আকারের অনুপাত) বেশি হলে সেটা ডায়বেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

তবে একজন ব্যক্তি কতটা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, তা বিচারের ক্ষেত্রে বিএমআই এর হিসাব নিয়ে বিতর্ক আছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চিকিৎসক ও অধিকারকর্মী আশের লারমি বলছেন, মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যতগুলো সূচক আছে, বিএমআই কেবল তার একটি।

আমাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা আসলে কেমন, চিকিৎসা, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা এবং শারীরিক গড়নের মত সূচকগুলোই সেটা নির্ধারণ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অফ ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড হেলথ থেকে ‘হেলদি পিপল ২০২০’ নামে একটি ক্যাম্পেইনে এরকম বার্তাই দেওয়া হয়েছে।

তারপরও স্বাস্থ্য বিচার করতে গিয়ে ‘কেমন দেখাচ্ছে’ তার ওপরই মানুষ বেশি নজর দেয়। যদি সমাজের বেঁধে দেওয়া সৌন্দর্য্যের মাপকাঠিকে খারিজ করে দেওয়া যায়, তারপরও নিজের শরীরের মাপ দেখে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা অনেকের জন্য কঠিন হয় বলে মনে করেন নিউ ইয়র্কের পুষ্টিবিদ শানা মিনেই স্পেন্স।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওজন থেকে নজর সরিয়ে এখন তাকাতে হবে অভ্যাসের দিকে; এই অভ্যাসই নির্ধারণ করে দেয়, আমাদের স্বাস্থ্য কেমন হবে।

লারমি বললেন, অতিরিক্ত মেদ জমাই যে সব সময় শরীরের নানা অসুস্থতার কারণ ঘটাচ্ছে, তা নাও হতে পারে। অনেক সময় ওই অসুস্থতাও শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার কারণ হতে পারে, সেটা বুঝতে হবে।

গবেষণা বলে, যাদের ওজন বেশি, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকিও বেশি। তবে ওজনের কারণেই কেউ হৃদযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে কি না, সেটা সেই গবেষণা থেকে বলা যায় না।

অবশ্য শেরেরের মতে, এসব গবেষণাকে হিসাবের বাইরে রাখা যাবে না। ওজন আর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র আছে, আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা এই যোগসূত্রগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, আরও অনেক বিষয় এর পেছনে কাজ করে, যেমন রোগীকে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাচ্ছে কি না।

যাদের শরীর অতিরিক্ত ভারী হয়ে গেছে, তাদের জন্য ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় বলে জানালেন নিউ জার্সির বডি ইমেজ কোচ ব্রি ক্যামপোস।

তিনি নিজে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে সবাইকে প্রশিক্ষক দেন। কিন্তু তার কাছে যারা আসেন, তাদের অনেকের মত তিনি নিজেও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় ওজনের কারণে খোঁটা শোনার ভয়ে থাকেন।

ব্রি ক্যামপোস বলেন, ঠোঁটে ঘা হলে কিংবা শরীরে র‌্যাশ উঠলে তিনি ডাক্তারের কাছে যান। কিন্তু অন্য কিছু হলেই তিনি ভয়ে থাকেন, কারণ ডাক্তার হয়ত প্রথমেই বলবে যে ‘আগে তোমার ওজন কমাতে হবে’।

পুষ্টিবিদ শানা মিনেই স্পেন্সের ভাষায়, শরীর কারও ‘বিজনেস কার্ড’ নয় যে একবার দেখেই তার স্বাস্থ্য, অভ্যাস আর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করে ফেলা যায়।

“আমরা কি তার মেডিকেল রেকর্ডস দেখেছি? তার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি? অনেক সময়ই শরীর আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অনেক রকমের অসুস্থতা শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।”

গবেষণার সময় অনেক মানুষের তথ্য মেলালে শরীরের আকার আর শরীরিক দশার মধ্যে একটি যোগসূত্র দেখা যায়। কিন্তু ব্যক্তি ধরে ধরে বিচার করতে গেলে সেই যোগসূত্র সব সময় ততটা স্পষ্ট থাকে না বলে মনে করেন শেরের।

তিনি বলেন, যাদেরেই বিএমআই অনেক বেশি, তাদের সবারই যে টাইপ টু ডায়বেটিস হয়েছে, বিষয়টা তেমন নয়।

“হালকা-পাতলা শরীর যাদের, তাদেরও হৃদরোগ কিংবা ডায়াবেটিস হতে পারে। আবার যারা মোটা, তাদের ক্ষেত্রেও পুরোপুরি স্বাভাবিক বিপাক ক্রিয়া দেখা গেছে।”

শেরের মনে করেন, “আসলে জিনগতভাবে আমরা কী কী বৈশিষ্ট্য পেয়েছি এবং আমরা জমা অতিরিক্ত ক্যালরি আমরা কীভাবে খরচ করছি, এটা (ডায়াবেটিস) তারই ফলাফল।”

ডায়েট করলে কি শরীর বেশি সুস্থ থাকে?

সুস্বাস্থ্য আসলে কী? ডায়েট করলে কী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে একজন কোন ধরনের স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তার ওপর।

সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে অনেক ধরনের বিষয়ের ওপর। অসুস্থতা এড়িয়ে চলা এর মধ্যে একটি। সেই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিতে হবে।

আর সেজন্য স্পেন্সের পরামর্শ, সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে এবং মানসিক চাপ কমাতে হবে।

“খাবার থেকে ক্যালরি কমিয়ে দেওয়া কিংবা কিছু খাবার এড়িয়ে চলা স্বাস্থ্যকর নাও হতে পারে। এতে করে মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে; আর তাতে বন্ধু ও পরিবারে সঙ্গ আগের মত উপভোগ্য নাও মনে হতে পারে।”

শুধু তাই নয়, ওসব করে হয়ত দ্রুত শরীরের ওজন কমানো গেল, কিন্তু তাতে পুষ্টির ঘাটতি থেকে যেতে পারে।

বেশিরভাগ মানুষের বেলায় ডায়েটিং ওজন কমাতে কাজ দেয় না। ২০১৮ সালের এক গবেষণা বলছে, এভাবে ওজন যারা কমিয়েছেন, দেখা গেছে, পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের ৮০ শতাংশের ওজন আবার বেড়ে গেছে।

ওজন কমানোর চিন্তা বাদ দিলে সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের কোন দিকে নজর দিতে হবে?

লারমি বলেন, কিছু অভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে, শারীরিক সক্রিয়তা বাড়াতে হবে। ঘুমটা হতে হবে ভালো। চাপমুক্ত থাকতে হবে। আর শরীরের কাজে লাগছে- এমন খাবারই খেতে হবে।

ওজন কমানো এসব কাজের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু হয়ত দেখা যাবে স্বাস্থ্যকর এসব অভ্যাসের চর্চা করলে ওজনও কমে গেছে।

জেনেট টমসন-ওয়েসেন বলেন, “যদি আমরা ওজনের চিন্তা মাথা থেকে সরাতে পারি, তাহলে সত্যিকার অর্থে কিছু স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাসের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়ত আমাদের জন্য সহজ হবে, আর সেটা হবে টেকসই।”