এ বছর ডেঙ্গু চিকিৎসায় মোট ব্যয়ের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে একজন গবেষকের ধারণা।
Published : 19 Aug 2023, 01:23 AM
সপ্তাহ খানেক আগে চুয়াডাঙ্গা থেকে ১৪ মাস বয়সী আরশীকে নিয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে এসেছেন অভিভাবকরা। ডেঙ্গু আক্রান্ত আরশীকে প্রথমে কেবিনে, পরে পেয়িং বেডে এবং সবশেষ ফ্রি বেডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার আরশীকে আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে টাকার সমস্যার কারণে ভর্তি করাতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বাবা আলমগীর হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর তিনি বলেন, গত কয়েকদিনে তারা অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছেন। হাসপাতাল বেড আর কিছু ওষুধ দিচ্ছে বিনামূল্যে। তবে বেশিরভাগই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
“আমার বাচ্চার রক্তে, হার্টে কিছুটা সমস্যা আছে। প্রতিদিন বাচ্চার জন্য ছয় থেকে সাতটা ইনজেকশন লাগে, সেটা কিনে আনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেশিরভাগ হাসপাতাল থেকেই করি। তাও অন্তত ৪৫ হাজার টাকার মত খরচ হয়েছে এখন পর্যন্ত। আমি এলাকায় ছোট একটা হোটেল চালাই, সামনে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। এত টাকা কীভাবে দেব বুঝতে পারছি না।”
ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বজনরা। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় এমনিতেই বেশি। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলেও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি বিপাকে পড়েছেন।
চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সরকারকে এই মুহূর্তে একটি জরুরি সহায়তা তহবিল গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড থেকে বৃহস্পতিবার ছাড়া পেয়েছে ছয় বছরের আদ্রীয় সাহা রোদ। তার মা রিংগু সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাসপাতালে বেডের জন্য কোনো টাকা দিতে হয়নি, কিন্তু বেশিরভাগ ওষুধই কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে।
“এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। রোদের বাবা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। গ্রামের বাড়ি থেকে কিছু এনেছি, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করেছি।”
গত ৯ অগাস্ট রাজধানীর মিরপুরের এমআর খান শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ছয় বছর বয়সী ইয়ামিনকে। তার বাবা রঙমিস্ত্রির সহকারী আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওষুধের পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেশি টাকা খরচ হচ্ছে।
“প্রতিদিন একটা করে সিবিসি করাতে লাগে ৪০০ টাকা। এক ব্যাগ প্লেইটলেট দিছি ২২ হাজার টাকা খরচ করে। দৈনিক বেড ভাড়া ১১শ টাকা। টুকটাক অন্যান্য খরচ তো আছেই। সব মিলে ৪০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আমার দৈনিক হাজিরা (মজুরি) ৫০০ টাকা। ধারদেনা করে খরচ দিচ্ছি, কীভাবে শোধ করব জানি না।”
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮ অগাস্ট থেকে ঢাকার ডেল্টা হাসপাতালে ভর্তি নতুন বাজারের সুজন বিশ্বাসের ভাই মিল্টন বিশ্বাস।
সুজন বলেন, “বেড ভাড়া ২৪০০ টাকা করে, সাতদিন হয়েছে, আরও একদিন থাকা লাগবে। ওষুধপত্রসহ দৈনিক দুই আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন ডাবই খাওয়াইছি ৭-৮টা করে। ডেঙ্গুর এই চিকিৎসার খরচ আমাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।”
লক্ষ্মীপুর থেকে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে আসা সেলিনা বেগমের মেয়ে তানিয়া জানান, এ হাসপাতালে বেশিরভাগ ওষুধ সরবরাহ করা হয়। তার পরও কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।
“একটা স্যালাইন, দুই ধরনের ইনজেকশন এবং এক ধরনের ট্যাবলেট বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি।”
ডিএনসিসি হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেঙ্গুর জন্য বেশিরভাগ ওষুধই হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়। যেসব রোগীর কোমর্বিডিটি আছে, তাদের জন্য কিছু ওষুধ বাইরে থেকে নিতে হয়।
“কিছু রোগীর অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট আছে। কেউ শকে গেলে অ্যালবুমিন, প্লাজমাসল লাগতে পারে। এগুলো দামি ওষুধ, সাপ্লাই নাই, এ ধরনের কয়েকটি ওষুধ কিনতে হয়। এছাড়া কারও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সেটার জন্য আলাদা ওষুধ লাগে, যা কিনতে হয়।”
২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় হাসপাতালে রোগীর ব্যয় নিয়ে গবেষণা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ ও তার সহকর্মীরা। তারা দেখেন, সরকারি হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগীর গড় খরচ হয় ১১ হাজার টাকা। আর ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীর ২০ হাজার টাকা খরচ হয়।
তারা বেসরকারি হাসপাতালের খরচকে তিনটি শ্রেণি ভাগ করেন। তাতে ‘ক’ শ্রেণির হাসপাতালে গড় খরচ দুই লাখ টাকা। এছাড়া ‘খ’ শ্রেণির হাসপাতালে গড়ে ৪১ হাজার এবং ‘গ’ শ্রেণির হাসপাতালে খরচ ছিল ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা।
অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সে সময় ডেঙ্গুর চিকিৎসায় দেশে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল বলে তারা হিসাব করে দেখেছিলেন। এ বছর তা বেড়ে এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এবার জিনিসপত্রের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এবার আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়বে।”
সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, মানুষ জ্বর বা অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য একটা হিসাব করে রাখে। কিন্তু ডেঙ্গুর মত বড় অসুখ হঠাৎ করে আসে। তা সামাল দিতে মধবিত্ত হিমশিম খায়।
“আর নিম্নবিত্ত একেবারে নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে, বিক্রি করে এটাও না পারলে হাত পাততে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোর বার্ষিক যে বাজেট থাকে তাতে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীকে সেবা দেওয়া যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে একটি জরুরি তহবিল তৈরি জরুরি।
“ধরুন একটি হাসপাতালের ৫০০ বেডের রোগীর জন্য বাজেট করল, সেখানে রোগী আসছে ৭-৮শ করে। রোগীর জন্য যে বরাদ্দ থাকছে তাতে রোগীর প্রয়োজন মিটছে না। বাইরে থেকে সেবা কিনতে হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে।
“এ অবস্থায় সরকার থোক বরাদ্দ দিতে পারে কম দামে সেবা দেওয়ার জন্য। এটা সরকারি বেসরকারি দুই হাসপাতালেই হতে পারে। মানুষকে হাসপাতালগুলো সেবা দিবে কম দামে, ভর্তুকির টাকা সরকার হাসপাতালকে দিয়ে দেবে।”
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৪ হাজারের বেশি রোগী। তাদের মধ্যে ৪২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েও পরীক্ষা করাননি, কিংবা ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হননি, তাদের তথ্য এ হিসাবে আসেনি। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হবে বলে চিকিৎসকদের ধারণা।