নিপা ভাইরাস: সতর্কবার্তার মধ্যেও চলছে খেজুরের রসের প্রচার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিপা ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় কাঁচা খেজুর রস পান না করা।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2023, 06:26 PM
Updated : 25 Dec 2023, 06:26 PM

দেশে গত শীতে নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী মিলেছিল সাতটি জেলায়, যার মধ্যে চারটি জেলার বাদুড়ের মুখের লালা ও প্রস্রাব পরীক্ষায় মেলে ভাইরাস। এ রোগ থেকে বাঁচতে চিকিৎসকরা খেজুরের রস পান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে এলেও এ রস পানে উৎসাহিত করতে নানা ধরনের প্রচার বন্ধ নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক দিকে নিপা ভাইরাস নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত সতর্কবার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে সোশাল মিডিয়ায় ছড়ানো বিজ্ঞাপনে দাবি করা হচ্ছে, তাদের সংগৃহীত রস ‘নিপা ভাইরাসমুক্ত’। এমনকি অনলাইনে অর্ডার নিয়ে দেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় পাঠানো হচ্ছে খেজুরের রস।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই দাবির কোনো ভিত্তি নেই। বরং এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল, এলাকা থেকে এলাকান্তরে খেজুরের রস বিপণনের মাধ্যমেও নিপা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা আছে। নিপা ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় কাঁচা খেজুর রস পান না করা।

ঠাণ্ডা রসের প্রচারে ‘গরম’ ফেইসবুক

শীত আসার পর থেকেই সোশাল মিডিয়ায় খেজুর রস খাওয়া, বিক্রি নিয়ে সরব প্রচার চলছে। উদ্যোক্তাদের অনেকেই দাবি করেছেন, ভাইরাসের বিষয়টি মাথায় রেখেই নিরাপদ উপায়ে তারা রস সংগ্রহ করে থাকেন।

খেজুর রস বেচতে ‘ইট ফর লাইফ’ নামে একটি ফেইসবুক পেইজের পোস্টে বলা হয়েছে, তাদের সংগৃহীত রস সম্পূর্ণ নির্ভেজাল, গাছগুলো বক্স করা থাকে এবং রস পাইপের মাধ্যমে বোতলজাত করা হয়। বাগান থেকে সংগ্রহের পর সরাসরি ফ্রিজিং ভ্যানে করে ঢাকায় আনা হয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে আনা সেই রস ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আনা হয়, সেখান থেকে সরবরাহ করা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায়।

‘ইটস ফর লাইফের’ উদ্যোক্তা ইশরাত শাহরিয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, নিপা ভাইরাস সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে। এজন্য সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই রস সংগ্রহ করছেন।

“আমরা যে গাছগুলো থেকে রস আনি, সেগুলো বক্স করা থাকে। রসে হাত লাগানো হয় না। পাইপের মাধ্যমে খেজুর রস বোতলে আসে। খেজুর রস আমি নিজে না খেয়ে ওই জায়গা থেকে আনব না। যদি কিছু হয় আমারও হবে। আমি রসটা আনাচ্ছি পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য বলে। গত বছরও তাদের কাছ থেকে এনেছি।”

‘অনলাইন বেচাকেনা’ নামে আরেকটি ফেইসবুক পেইজে খেজুর রস বিক্রি প্রচার করা হচ্ছে। তারা ঝিনাইদহ থেকে খেজুর রস সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন।

‘অনলাইন বেচাকেনা’র উদ্যোক্তা ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ফুরকান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের গ্রামে তিনশর বেশি খেজুর গাছ আছে; সেসব গাছের রস সংগ্রহ করে বিক্রি করি আমরা।”

এগুলোর মধ্যে যেসব গাছের রস বিক্রির জন্য রাখা হয় সেগুলো জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় বলে ফুরকানের ভাষ্য।

“যেসব গাছের রস থেকে গুড় হয়, তাতে নেট (জাল) লাগানো হয় না। আমরা সেফটির জন্য নেট দিয়া ঘিরে দিই। তাতে বাদুড়ের সংস্পর্শে আসার সুযোগ নাই।”

অনলাইনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে খেজুর রস বিক্রি করে ‘রসবালি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাদুড়সহ সব ধরনের পোকামাকড় থেকে তাদের খেজুর রস ‘নিরাপদ’।

খেজুর রস নিরাপদ তা পরীক্ষা করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ‘রসবালি’র উদ্যোক্তা হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রস নিরাপদ রাখতে পাত্রের মুখ বেঁধে গাছের কাটা অংশ পুরোটা বস্তা দিয়ে ঢেকে দেন তারা।

“আমরা পাত্রের মুখ নেট দিয়ে বাঁধি এবং গোটা গাছটাই বস্তা দিয়ে ঢেকে ফেলি। এ কারণে সেখানে বাদুড় যেতে পারে না। বাদুড় না গেলে নিপা ভাইরাস যাওয়ার কথা না। আমি বলতে পারি আমাদের খেজুর গাছের রস ১০০ ভাগ নিরাপদ।”

কিন্তু আইইডিসিআর এর মুখ্য বিজ্ঞানী শারমিন সুলতানা বলছেন, গাছ বা পাত্র ঢেকে রাখলেও রস ‘নিপা ভাইরাসমুক্ত’ বলার সুযোগ নেই।

“বাদুড় গাছে বাধা নল থেকে বা গাছের যে অংশ কাটা হয়েছে, সেখান থেকে চেটে রস খায়। এজন্য খেজুর গাছের কাটা অংশে বসার চেষ্টা করে সে।

“সে যখন দেখবে নেট দিয়ে ঘেরা, তখনও সে নেটের বসার চেষ্টা করে এবং সেখানেই ঘুরতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বাদুড় ক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে, ক্ষিপ্ত হলেই সেটি মূত্র ত্যাগ করে। নেটের ওপর মূত্র ত্যাগ করলেও সেটি রসের পাত্রে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।”

বাহক: নিপা ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ।

রোগলক্ষণ: এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর ও মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। এক পর্যায়ে খিচুনিও দেখা দিতে পারে। মস্তিস্কে ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয়।

সাবধানতা: নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে পাখি বা বাদুড়ের আংশিক খাওয়া ফল না খেতে এবং যে কোনো ফল পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ‘রসের মেলা’ আয়োজন করে ‘রঙ্গে ভরা বঙ্গ’ নামে একটি সংগঠন। সেখানে অন্যান্য লোকজ খাবারের সঙ্গে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ানো হয়।

তবে নিপা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় এ বছর খেজুরের রস রাখছেন না বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ইমরান উজ জামান।

তিনি বলেন, এর পাশাপাশি রসের মেলা নামটিও রাখা হচ্ছে না।

“নিপা ভাইরাস নিয়ে একটি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও একটা সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।  এজন্য এবার আমরা খেজুরের রস রাখছি না। আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু রস খাওয়ানো না। আমরা একটা লোক দলকে ঢাকায় উপস্থাপন করি, পাশাপাশি একটি লোকপণ্য উপস্থাপন করা হয়। এটার উদ্দেশ্য হলো লোকজ বিষয়গুলো ঢাকার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।”

ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে বিক্রির সুবিধা থাকায় খেজুর রস এখন দেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় চলে যাচ্ছে। এতে নিপা ভাইরাসও চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, “নিপা ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষে ছড়ায়, আবার আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেও অন্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। আগে শুধু খেজুর গাছ আছে এমন জেলায় নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেত। কিন্তু এখন খেজুর গাছ নেই এমন জেলায়ও রোগী পাওয়া যাচ্ছে।

“এটা হয়েছে খেজুর রস নিয়ে প্রচারের জন্য। মানুষ এক জায়গা থেকে রস খেতে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। আবার অনলাইনের অর্ডার করলে খেজুর রস বাসায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে রোগটিও নতুন নতুন এলাকায় চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।”

ডা. তাহমিনা বলেন, “নিপা ভাইরাসের কোনো টিকা নেই। এই রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এজন্য প্রতিরোধই নিপা ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। এজন্য কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া যাবে না।”

বাংলাদেশে মেহেরপুর জেলায় ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সে বছর মোট আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে ৯ জনই প্রাণ হারায়। এ যাবৎকালে সবচেয়ে বেশি ৬৭ জন রোগী পাওয়া যায় ২০০৪ সালে, তাদের মধ্যে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আইইডিসিআরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৩৩৯ জনের নিপা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ২২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত হলে ৭০ দশমিক ৭৯ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খেজুর রসের প্রচার নিয়ে সংবাদমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। বাংলাদেশে নিপা ভাইরাস এখনও বড় আকারে না আসলেও আশঙ্কা কম নয়।

“এখনও বিভিন্ন পত্রিকায় এমনভাবে খবর প্রকাশ করা হয়, যাতে মানুষকে খেজুরের কাঁচা রস পানে উৎসাহিত করে- এটা করা যাবে না। বাংলাদেশে এ বছর নিপা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যে হবে না, এটা কিন্তু বলা যায় না। বাংলাদেশে খেজুর রস আছে, বাদুরও আছে। ফলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে বিপদ হবে। কারণ মৃত্যুহার খুব বেশি।”

২০০১ সালের পর ২০০২, ২০০৬ এবং ২০১৬ সাল ছাড়া প্রতি বছরই নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০২১ সাল ছাড়া প্রতি বছরই নিপা ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে দুজন আক্রান্ত হলেও কারও মৃত্যু হয়নি।

বাংলাদেশের এ পর্যন্ত ৩৪টি জেলায় নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। সিরাজগঞ্জ বাদে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সবগুলো জেলায় পাওয়া গেছে এ ভাইরাস। আইইডিসিআরের হিসাবে, নিপা ভাইরাসে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা রাজশাহী ও রাজবাড়ী।

২০১৫ সালের পর প্রতি বছরই নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ জনের কম ছিল। তবে গত বছর শীত মৌসুমে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ১৪ জন রোগী পাওয়া যায়। রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী ও নরসিংদীতে পাওয়া যায় নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী।

Also Read: নিপা ভাইরাস: যা জানতে হবে