“উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত করা যাচ্ছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকার দেয়, মানুষের উচিত এই সুযোগটা নেওয়া।”
Published : 17 Oct 2023, 07:11 PM
যক্ষ্মার সমস্যা নিয়ে চার বছর ধরে হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরছেন গাজীপুরের শ্রীপুরের মোহাম্মদ হোসেন, যিনি এখন ভর্তি আছেন ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।
শুরুটা সাধারণ যক্ষ্মা দিয়ে হলেও লম্বা চিকিৎসায় উন্নতি না বোঝা এবং ওষুধ সেবনে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়েছিলেন তিনি। এখন ফুসফুসে কফ জমেছে, রক্তও যায় মাঝে মধ্যে। যে কারণে ফের হাসপতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ বছরের এই তরুণ।
২০১৯ সালে যক্ষ্মা শনাক্ত হয় জানিয়ে হোসেন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়ে সাড়ে তিন মাস ওষুধ খেয়েছিলেন। ‘ভালো না হওয়ায়’ ২০২০ সালে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে যান। সেখানে ৯ মাসের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে এবারও নিয়মিত ওষুধ সেবন করেননি।
“আমি বুঝতে পারি নাই এজন্য গ্যাপ দিছিলাম। সাত মাসের মাথায় অবস্থা খুব খারাপ হলে ২০২১ সালে আবার এখানে ভর্তি হই। তখন ২০ মাসের ওষুধ দিলে সেটা ঠিকমতই খাই। কিন্তু এরপরও শরীর খারাপ লাগলে আবার এসে ডাক্তার দেখাই। তারা বলেন, ফুসফুসের একটা অংশ ড্যামেজ হয়ে গেছে, অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করে দুই মাস আগে বাড়িতে যাই। ঠাণ্ডা লেগে আবার ফুসফুসে কফ জমেছে, রক্তও যায় মাঝে মাঝে, এজন্য আবার ভর্তি হইছি।”
সাধারণ যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছয় মাস নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত এবং পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ না খেলে যক্ষ্মার জীবাণু ওই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের অবহেলা ও অসচেতনতায় এই ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি বাড়ছে, যাদের একটা বড় অংশই মারা যান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্তরা যে জীবাণু ছড়ায়, তাও ওষুধ প্রতিরোধী। তবে শনাক্তের পর নিয়মিত, পরিমিত ও পূর্ণ মেয়াদের চিকিৎসা নিলে এ রোগ ভালো হয়। এজন্য সবার আগে সবার আগে প্রয়োজন সচেতন হওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন মানদণ্ড বিবেচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর একটি হিসাব দেয়। ওই হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগী ছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ৫৬১ জন এবং শনাক্তের বাইরে রয়ে যায় ৬৭ হাজার ৪৩৯ জন। এসব রোগীর মধ্যে আবার অন্তত সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিলেন। ওই বছর যক্ষ্মা আক্রান্ত মারা যায় যায় ৪২ হাজার মানুষ।
ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১৯-২০ এবং ২০-২১ নম্বর ওয়ার্ডে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি রাখা হয়। গাজীপুরের হোসেন ছাড়াও সেখানে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা লিয়ন।
তিনি জানান, প্রচণ্ড কাশি আর শ্বাসকষ্ট হলে নারায়ণগঞ্জের সরকারি ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের এক চিকিৎসককে দেখান। সেখানে যক্ষ্মা শনাক্ত হলে তাকে ওষুধ দেওয়া হয়। তবে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ঢাকায় যান। এরপর পরীক্ষায় দেখা যায়, তিনি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত।
“আমার বাবার যক্ষ্মা হইছিল, এখন সুস্থ। মনে হয় বাবার কাছ থেকেই জীবাণু এসেছে। এখানে ভর্তি হয়েছি গত ২০ দিন আগে। দুই সপ্তাহ থাকার কথা, কিন্তু রিপোর্ট এখনও নেগেটিভ আসেনি, তাই ডাক্তার এখনও রিলিজ দেয় নাই।”
সাধারণ যক্ষ্মা যে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, এর পেছনে মানুষকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে অবহেলা এবং অসচেতনতার কারণেই যক্ষ্মা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। সচেতনতার মাধ্যমেই ওষুধ প্রতিরোধী টিবি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সিনিয়র পালমোনোলজিস্ট ডা. কাজী সাইফুদ্দীন বেননূর জানান, প্রাথমিকভাবে টিবি ধরা পড়লে তার চিকিৎসায় রোগীকে চারটি ওষুধ দেওয়া হয়। তার মধ্যে রিফামপিসিন এবং আইসোনিয়াজিড কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে গেছে।
“ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সময় চিকিৎসা নিতে হয়। এজন্য অনেকে পূর্ণ মেয়াদে চিকিৎসা নেয় না, ফলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা হলে যে ওষুধ দেওয়া হয় সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি, রোগীরা অনেক ভোগে। এজন্য অনেক রোগী ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
“সাধারণ যক্ষ্মা হওয়ার পর অবহেলা, অসচেতনতা, নিয়মিত ওষুধ না খাওয়া, ওষুধের মাত্রা সঠিকভাবে নির্ধারণের অভাব এবং নিয়মিত ওষুধ না পেলে যক্ষ্মা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এটা যেহেতু ম্যানমেইড তাই চাইলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। সঠিক মাত্রায়, নিয়মিত এবং সম্পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ খেতে হবে। যে কোনো দিক থেকে হোক, গাফিলতি করা যাবে না।”
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত করা এখন সহজ জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, “দেশের সবগুলো উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ৫৮৮টি জিন এক্সপার্ট মেশিন রয়েছে, যা দিয়ে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত করা যাচ্ছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকার দেয়। মানুষের উচিত এই সুযোগটা নেওয়া।
“সাধারণ যক্ষ্মায় যারা আক্রান্ত তাদের জন্য এক ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা, আর ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্তদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। গাইডলাইন অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা করা হয় এবং তারাও ভালো হয়। আগে এমডিআর টিবি আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা নিতে হত, এখন তারা বাড়িতে থেকেও চিকিৎসা নিতে পারেন।”
(প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে: ফেইসবুক লিংক)