শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে দিনে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী আসলেও এখন সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২০০ থেকে ১৩০০ জনে। এর মধ্যে নিউমোনিয়া আক্রান্ত অনেক শিশুকে ভর্তি করানো হচ্ছে জানাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
Published : 03 Mar 2024, 08:41 AM
ঠান্ডা-সর্দি, কাশি আর জ্বর থেকে সেরে উঠতেই পারছে না ঢাকার বনশ্রীর সাফওয়ান; আট মাস বয়সী এই শিশু গত দুই মাসে তিনবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।
শিশুটির মা মিশকাত জাহান বলছেন, ধুলাবালি এড়িয়ে বাচ্চাকে সাবধানে রাখলেও ডিসেম্বরের শেষ থেকে কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে সে।
ঘুমের ব্যাঘাত, খাবারে অনীহাসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে এখন বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মিশকাত বলেন, “কয়েকদিন আগে বাসার প্রায় সবারই জ্বর-ঠান্ডা হয়েছে। বাবুকে সিরাপের পাশাপাশি নেবুলাইজিং করাতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় রাতে। নাক বন্ধ থাকে, ঠিকমত শ্বাস নিতে পারে না। তখন খুব কান্নাকাটি করে। ঘুমাতে চায় না। নাকে ড্রপ দিলে একটু ভাল লাগে, তখন ঘুমায়।”
সাফওয়ানের মত অনেক শিশুই শীত শেষে বসন্তের শুরুর দিক থেকে সর্দি-কাশি কিংবা জ্বরে ভুগছে। আক্রান্ত হচ্ছে বড়রাও।
চিকিৎসকরা বলছেন, এসবের পেছনে বায়ুদূষণ একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। দূষণের কারণে মানুষের ভোগান্তি বেশি। সুস্থ থাকতে তাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে বাড়তি নজর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার গোলাম নবী জানান, জ্বর, ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্টের রোগী এখন বেশি পাচ্ছেন তারা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই চিকিৎসক বলেন, “প্রতিদিন ১৫০-২০০ রোগী আসছে এসব লক্ষণ নিয়ে। শ্বাসকষ্টও হচ্ছে অনেকের।”
গোলাম নবীর ভাষ্য, “এই সময়ে অ্যাজমা বা হাঁপানির রোগীদের বেশি ভুগতে হচ্ছে।”
ঢাকা শিশু হাসপাতালে এখন যেসব রোগী আসছে, তার মধ্যে সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাই বেশি বলে জানাচ্ছেন এই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঠান্ডা, জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি, যা হাসপাতালে রোগী বাড়াচ্ছে।
শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে অন্য সময়ে দিনে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ জন রোগী আসলেও এখন সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ জনে। এর মধ্যে অনেক শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তাদের ভর্তি করানো হচ্ছে বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক।
তিন সপ্তাহ ধরে সর্দি-কাশিতে ভুগছেন রাজধানীর মিরপুরের হোসনে আরা বেগম। এখন ইনহেলার আর নেবুলাইজিং ছাড়া চলতে পারছেন না তিনি।
পঞ্চাশোর্ধ এই নারী বলেন, “শীতের শেষ দিকে এই যে সর্দি-কাশি হঠাৎ বেড়ে গেল, আর কমছে না। একদিন নেবুলাইজিং না করালে ঘুমাতে পারি না। ইনহেলার নিচ্ছি দুইটা। এমনিতে অ্যাজমার সমস্যা ছিল, সেটা এখন বেড়ে গেছে।”
তিনি জানান, বাইরে বের হলেই কষ্ট হয় বেশি, ধুলাবালিতে সমস্যা বেড়ে যায়।
মোহাম্মদপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক আরিফ হোসেন মাসখানেক আগে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলেও কাশি তার পিছু ছাড়ছে না।
আরিফের ভাষ্য, চিকিৎসকের কাছে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নিয়েও তার কাশি সারেনি।
“যখন ঠান্ডা-জ্বর ছিল, ডাক্তারের কাছে গেলাম। কাশির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দিল। একটু কমল। এখন আরো বেড়ে গেছে। আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। পরে এক্সরে করে ডাক্তার বলল, ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে।”
কারণ কী
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলছেন, বায়ুদুষণ এবার সর্দি-কাশিতে মানুষকে বেশি ভোগাচ্ছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের অর্ধেক সময়ই বায়ু দূষণে ঢাকা শীর্ষে ছিল। এই দূষণের কারণে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাও বেড়েছে বলে জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ দিন ঢাকার বাতাসের মান ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। গেল মাসজুড়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল উপরের দিকে।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “এমন সময়ে যখন সর্দি-কাশির ভাইরাস কারো শরীরে প্রবেশ করে, তখন সেটি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের’ মত একটি অবস্থা তৈরি করে।”
শীত শেষে বসন্তের আগমনের সময় বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকে ও দূষণও বেড়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে কিছু ভাইরাস জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব এসময় বেড়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম একটি ভাইরাস হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। যার কারণে সর্দি-কাশি হয়।
“যখন বায়ু দূষণ বেড়ে গিয়ে আমাদের শ্বাসতন্ত্রকে সংবেদনশীল ও অসুস্থ করে তোলে, তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সর্দি-কাশির ভাইরাস তীব্র করে তোলে। ফলে অন্য সময়ে যে প্রভাব বিস্তার করে, তার চেয়ে এ বছর বায়ুদূষণ বাড়ার কারণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে।”
শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, ঋতু পরিবর্তনের কারণেই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি বা জ্বরের রোগী বেড়ে গেছে।
শীত শেষে ফেব্রুয়ারিতে বসন্তের আগমনে দেশের আবহাওয়ায় পরিবর্তন আসে। দিন-রাতের তাপমাত্রায় ব্যবধান থাকায় একসঙ্গে শীত ও গরমের অনুভূতি সামলাতে হয়।
ঠান্ডা-কাশির রোগীর বাড়ার জন্য বায়ুদূষণকেই সামনে আনছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবিএম আবদুল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন শিশুসহ সবাই ঠান্ডা, সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। দিনে গরম, রাতে ঠান্ডা; এমন আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় লাগে। অনেকের দিনে গরম লাগে, তখন ঠান্ডা পানি, শরবত খায়। এতে ঠান্ডা লেগে যায়।
“বায়ু দূষণের কারণেও ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশিতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকায় ধুলা আর ধোঁয়া অত্যন্ত বেশি। বায়ুমন্ডল শুষ্ক, আর্দ্রতা কম। এ কারণেও এমনটা হতে পারে। এজন্য সতর্ক থাকতে হবে।”
করণীয় কী
আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে সুস্থ থাকতে জীবনযাত্রার দিকে বাড়তি নজর দেওয়ার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
এজন্য স্বাস্থ্য সতর্কতাগুলো মেনে চলার পাশাপাশি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতেও উৎসাহ দিচ্ছেন চিকিৎসক এবিএম আবদুল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দূষণ থেকে বাঁচতে বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে হবে। বিশেষ করে যারা শিশু ও বয়স্ক, তাদের ভোগান্তি বেশি হচ্ছে। এটি ভাইরাসের সংক্রমণে হয়। ফ্রিজের পানি ও ঠান্ডাজাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। বাইরের খাবার খাওয়া যাবে না। ধূমপান করা যাবে না।”
এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, ঠান্ডা-কাশি হলে কুসুম গরম পানি খেতে হবে এবং গরম পানি দিয়ে গার্গেল বা কুলিকুচি করতে হবে।
শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সর্দি-কাশি, জ্বর থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন।
খাবারে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “প্রচুর পরিমাণে ফল খেতে হবে। পানি পান করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
“বদ্ধ জায়গায় থাকা যাবে না। ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেউ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা রাখতে হবে।”
নিউমোনিয়া হয়ে গেলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বর অনেক বেশি থাকলে, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলে, বুকের ভেতর দেবে গেলে, খাবার খেতে না চাইলে- সেগুলো নিউমোনিয়ার লক্ষণ হিসেবে ধরে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।”
এবারের সর্দি-কাশির ধরণ পাল্টে গেছে জানিয়ে ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক লেলিন চৌধুরী বলছেন, জ্বরও হচ্ছে এবং কাশি একবার হলে সেটি সহজে সারছে না।
“কাশতে কাশতে রোগীর বুক ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। এটি দূর করতে হলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইটের ভাঁটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, বর্জ্য, বাড়ি নির্মাণের ধুলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
বাংলাদেশে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বনাঞ্চল তৈরি, গাছপালা লাগাতে পারলে জলবায়ু রক্ষা করা যাবে। তাহলেও এই ভাইরাসের প্রবণতা কমবে।”
যারা দীর্ঘদিন ধরে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত, তাদের দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ দিয়েছেন লেলিন চৌধুরী ।
তার পরামর্শ, “ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে কাশি হলে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে। ভাইরাসজনিত সংক্রমণের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পানি-তরল খাবার গ্রহণ, শাকসবজি, ফলমূল খেতে হবে, প্রয়োজনে ছোট-খাট ওষুধ খেতে হবে। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”