আগামী বছর এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
Published : 30 Nov 2024, 01:16 AM
বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ নেই; এ নিয়ে আতঙ্কের মধ্যেই এবার রাজধানীবাসীর ভোগান্তিতে যোগ হয়েছে মশাবাহিত আরেক রোগ চিকুনগুনিয়া।
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ-উপসর্গ অনেকটা ডেঙ্গুর মত হওয়ায় আক্রান্ত হলেও রোগীরা বুঝতে পারছেন না। সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই। ফলে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যাও জানা যাচ্ছে না।
তবে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক মাসে তিনশর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। আইসিডিডিআর,বি এবং আইইডিসিআরের পরীক্ষায় চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের কাছেও লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে অনেকে আসছেন, যাদের কেউ কেউ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে তাদের সন্দেহ।
এ বছর অসময়ে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় আগামী বছর রোগটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এইডিস ইজিপ্টি এবং এইডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি টোগা ভাইরাস গোত্রের। মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে।
১৯৫২ সালে আফ্রিকায় প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসের হদিস মেলে। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এ রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়।
২০১৭ সালে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তখন রিপোর্টিং সিস্টেম না থাকায় কত লোক আক্রান্ত হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সে সময় অন্তত এক লাখ মানুষের চিকুনগুনিয়া হয়েছিল।
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ কী
প্রতিকার কী
এসব উপসর্গ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি (Serology Ges এবং RT-PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। আইইডিসিআর-এ চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের সকল পরীক্ষা করা হয়। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা মূলত উপসর্গ ভিত্তিক। এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে এবং প্রয়োজনে জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ওষুধ খেতে হবে।
সাধারণত রোগটি এমনিতেই সেরে যায়, তবে কখনও কখনও গিঁটের ব্যথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর থাকতে পারে।
গিটের ব্যথার জন্য গিঁটের উপরে ঠাণ্ডা পানির স্যাঁক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে। তবে প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পর যদি গিঁটের ব্যথা ভালো না হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে। কোনো কারণে রোগীর অবস্থা অবনতি হলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
ঢাকায় এবার রোগী কেমন
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কামরুন্নাহার সুলতানা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জ্বরে আক্রান্ত হন। দুইদিন জ্বর থাকার সময় মাংসপেশিতে মৃদু ব্যথা ছিল তার। চিকুনগুনিয়া সন্দেহ করে নমুনা পরীক্ষা করালে পজিটিভ আসে।
জ্বর সেরে যাওয়ার পর আট দিন বাসায় বিশ্রাম নিয়ে কাজে যোগ দেন তিনি। এর এক সপ্তাহ পর থেকে তার শরীরের ব্যথা বাড়তে থাকে।
“গত কয়েকদিন ধরেই শরীরের প্রতিটি জয়েন্টে ব্যথা। কাল থেকে সেটা আরও বেড়ে গেছে। এখন আমি কার্যত ডিজঅ্যাবল। একটুও হাঁটতে পারছি না, রিকশায় উঠতে পারছি না, এমনকি স্ট্রিপ থেকে একটা ট্যাবলেট খুলে খেতে পারছি না। ২৯ অক্টোবরের থেকে পেইন কিলারের ওপরে আছি, না খেলে ব্যথায় টিকতে পারি না।”
কলাবাগানের বাসিন্দা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অচিন্ত্য কুমার নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে জ্বরে আক্রান্ত হন। রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকায় চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করাতে বলেন চিকিৎসক। তাতে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে।
অচিন্ত্য কুমারের ভাষায়, তিনি ‘শক্তসামর্থ’ মানুষ। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
“কোথাও বসলে উঠতে পারি না, বিছানা থেকে আরেকজনের হেল্প ছাড়া ওঠা যায় না। মনে হয় দুপায়ের দুটি রগে কেউ ইনজেকশন দিয়েছে, প্রতিটি জয়েন্ট, শোল্ডারের জয়েন্ট। বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় ব্যথা করে। আমি এনার্জিটিক মানুষ, একেবারে বসিয়ে দিয়েছে।”
ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে চিকুনগুনিয়া নিয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ফলে এই রোগে আক্রান্তের সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
একটি গবেষণার আওতায় আইসিডিডিআর,বি অক্টোবর মাসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ১৫১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে। যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের সবাই ডেঙ্গুর এনএসওয়ান পরীক্ষা নেগেটিভ এসেছিল। ওই ১৫১টি নমুনার আরটিপিসিআর করে ২৭ জনের চিকুনগুনিয়া পজিটিভ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ শনাক্তের হার প্রায় ১৮ শতাংশ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর জানিয়েছে, নভেম্বর মাসে ৪৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত করেছে তারা।
স্কয়ার হাসপাতাল জানিয়েছে, চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়ে গত ১ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৩১৪ জন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর হওয়ায় ৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।
স্কয়ার হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসুফ সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এবার চিকুনগুনিয়ার প্রচুর রোগী পেয়েছি। তাদের বেশিরভাগই আউটডোর সার্ভিস নিয়েছেন।”
এ বছর চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহও। তার ব্যক্তিগত চেম্বারেও কিছু রোগী আসছে, যাদের লক্ষণ-উপসর্গ চিকুনগুনিয়ার মত।
তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ-উপসর্গ ডেঙ্গুর মতই। তবে রোগীরা বেশি কষ্ট পায় শরীর ব্যথার কারণে।
“এমনিতে চিকুনগুনিয়া তেমন সিরিয়াস রোগ না। কিন্তু বাড়তি বিষয় হল প্রচণ্ড ব্যথা। এই ব্যথা আবার কারও কারও দীর্ঘ সময় থাকে, রোগীকে ভোগায়।”
ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীদের একটা বড় অংশের চিকিৎসা হয় মুগদা হাসপাতালে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এস এম হাসিবুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সে কারণে তারা জানতে পারেন না রোগী চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত কি না।
“আমাদের এখানে ডেঙ্গু নিয়ে অনেকে আসেন। তাদের অনেকের মধ্যেই চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ-উপসর্গ থাকে।”
>> এইডিস ইজিপ্টি এবং এইডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা সাধারণত পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে জন্মায়। যাদের আশপাশে এ রকম মশা বৃদ্ধির জায়গা আছে, তারা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
>> এ ধরনের মশা সাধারণত দিনের বেলা (ভোর বেলা অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়। এছাড়াও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরীতে নমুনা পরীক্ষার সময়ে অসাবধানতায় এ রোগ ছড়াতে পারে।
>> এ রোগ প্রতিরোধের কোনো টিকা নাই। ব্যক্তিগত সচেতনতাই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
>> শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢাকা রাখা (ফুল হাতা শার্ট এবং ফুল প্যান্ট পরা), জানালায় নেট লাগানো, প্রয়োজন ছাড়া দরজা জানালা খোলা না রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করার মাধ্যমে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায়।
ব্যাপকতা বাড়ার আশঙ্কা
এ বছর চিকুনগুনিয়া পাওয়া গেছে বর্ষা মৌসুম শেষে। এ কারণে ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়া নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা এ বছর ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়া নিয়ে বেশি চিন্তিত। এ বছর লেট সিজনে এসে চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারও চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হচ্ছে।”
আগামী বছর এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ড. শফিউল বলেন, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর একটা বড় প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, মারা গিয়েছিল অনেক মানুষ। এর একটা বড় কারণ ছিল ভাইরাসের ধরণ পরিবর্তন হওয়া।
“সেরোটাইপ চেঞ্জ হলে মৃত্যু এবং আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। একটা সেরোটাইপ অন্তত ৩ বছর প্রাধান্য বিস্তার করে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেন-৩ ছিল। ২০২৩ সালে ডেন-২ এসেছে এবং এখন পর্যন্ত এটার প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এরপর ডেন-২ এর প্রাধান্য কমে যাবে, এই সুযোগে চিকুনগুনিয়া বেড়ে যেতে পারে। আমার ধারণা আগামী বছর বা তার পরের বছর এই আউটব্রেকটা হতে পারে।”
তবে চিকুনগুনিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।
“চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে এর আগেও ছিল। মানুষকে সচেতন হতে হবে, যেন মশা কামড়াতে না পারে।”
পুরনো খবর