বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ বছর ডেঙ্গুর দাপট ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে।
Published : 05 Oct 2024, 01:38 AM
বছরের শেষ ভাগে এসে সারাদেশে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যু বেড়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ বছর ডেঙ্গুর এই দাপট ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালে দৈনিক নতুন এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত কয়েকদিন রোগী বেড়েছে কয়েকগুণ।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সারাদেশের হাসপাতালে ২৩৬৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। ওই সাতদিন দৈনিক গড়ে ৩৩৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। সেপ্টেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে রোগী ভর্তি হয়েছে ৫৪৫৭ জন, দৈনিক গড়ে ৭৭৯ জনের বেশি।
আর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে রোগী ভর্তি হয়েছে ৫৫৫৬ জন, দৈনিক ভর্তি রোগীর গড় ১১১১ জনের বেশি।
সে হিসাবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের চেয়ে চলতি সপ্তাহে দৈনিক ৭৭৩ জনের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১৪১৭ জন ডেঙ্গু রোগী। এক মাস পর অক্টোবরের ১ তারিখে হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৩৪৯৫ জন।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৮৪২ জন, দৈনিক গড়ে ১৪০৬ জন। সেখানে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি আছে ১৭ হাজার ২৫৫ জন, দৈনিক গড়ে হাসপাতালে ছিলেন ৩৪৫১ জন।
বৃহস্পতিবার ঢাকার জাতীয় শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ডেঙ্গু কর্নারে ৩৭টি শিশু ভর্তি ছিল।
এছাড়া ওই হাসপাতালের বহির্বিভাগে অনেক শিশু চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। রোগীর চাপ বাড়ায় শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ওই কর্নারে ভর্তি ঢাকার সিদ্দিকবাজারের দেড় বছর বয়সী শিশু সাদমান ইসলামের মা তানিয়া ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছে তার ছেলে। সঙ্গে ডেঙ্গু ধরা পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
“১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর হয়েছিল ছেলের, সঙ্গে সর্দিকাশি। ডাক্তার দেখানোর পর দেখা যায়, তার নিউমোনিয়া হয়েছে। জ্বর না কমায় ডেঙ্গু টেস্ট করা হলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ডাক্তারের পরামর্শে এই হাসপাতালে এনে ভর্তি করি। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হত, ডেঙ্গুর চেয়ে নিউমোনিয়া তাকে বেশি ভুগিয়েছে।”
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত কয়েকদিন ডেঙ্গু নিয়ে আসা শিশুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। হাসপাতালের ডেঙ্গু কর্নার শুরুতে ১৬ শয্যার করা হলেও পরে শয্যা বাড়িয়ে ২৪টি, বৃহস্পতিবার ৩৪টি করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি আছে তিনটি শিশু।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা জ্বরের পাশাপাশি অন্যান্য জটিলতা নিয়েও আসছে।
“ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের অনেকের ফুসফুসে পানি, হার্টে পানি জমছে। কারও প্রস্রাব কমে যাওয়া, পেটব্যথা হচ্ছে। বাচ্চারা হঠাৎ শকে চলে যাচ্ছে, এটাই আমাদের জন্য উদ্বেগের। আজও তিনটা বাচ্চা শকে চলে গেছে। তাদের আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
ঢাকার মহাখালীতে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে বৃহস্পতিবার ১৫৩ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন। ঠিক এক মাস আগে ৩ সেপ্টেম্বর ভর্তি ছিলেন ৩৭ জন রোগী।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী তানিশা আফরিন মনিকা।
পশ্চিম রাজাবাজারের বাসিন্দা তানিশা আফরিন মনিকা বলেন, “গত শনিবার থেকে তীব্র জ্বর। সঙ্গে বমি, পেট ব্যথা। কোনোভাবেই জ্বর কমছিল না। ডাক্তারের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মঙ্গলবার এখানে এসে ভর্তি হয়েছি।”
সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে।
ঢাকার মিরপুরে বেসরকারি এম আর খান শিশু হাসপাতালে বৃহস্পতিবার ২৫টি শিশু ভর্তি ছিল।
সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকার মিরপুরের ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে পল্লবীর আড়াই বছর বয়সী শিশু নাবিল আহমেদ।
শিশুটির মা জাকিয়া সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জ্বর কমছেই না। ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর হয়েছে। জ্বর না কমায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে। আমাদের এলাকায় তো তেমন মশা নেই। কোন ফাঁকে এইডিস মশা কামড় দিয়েছে বুঝতে পারছি না।”
সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. শেখ দাউদ আদনান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের চিকিৎসকদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গুর লক্ষণ, উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী ভর্তির প্রয়োজন হলে ভর্তি করে নিবে। কোনো রোগী ফেরত যাবে না।"
ঢাকায় মশার উপস্থিতিও কম না
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা কার্যক্রমে নেওয়ার কথা বলছে। তারপরও প্রতিদিনই বিভিন্ন অভিযানে পাওয়া যাচ্ছে এইডিস মশার লার্ভা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রতিদিন ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালায়।
ডিএনসিসির তথ্যে দেখা গেছে, প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন স্থাপনায় এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।
ডিএনসিসি বলছে, ১ অক্টোবর ৬২৭৮টি স্পট পরিদর্শন করে ৪১টিতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ২ অক্টোবর ৬৩৮২টি স্পট পরিদর্শন করে ৫১টি এবং ৩ অক্টোবর ৪১৮৯টি স্পট পরিদর্শন করে ২৩টি জায়গায় মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিধন কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে এ সময় ঢাকায় এইডিস মশার বিস্তার বাড়ার আশঙ্কা আগে থেকেই করা হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত মশার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। চুক্তির বাধ্যবাধকতা থাকায় ওই জরিপের ফলাফল জানাননি ড. কবিরুল বাশার।
তবে তিনি বলেছেন, ঢাকার সব এলাকায় মশার ঘনত্ব ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রার একক ব্রুটো ইনডেক্স অনেক বেশি।
“আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। তাতে দেখা গেছে, ঢাকায় একটা এলাকাও পাওয়া যাবে না যেখানে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর কম আছে।”
ড. কবিরুল বাশার, গত কয়েকদিন ধরে ঢাকাসহ সারাদেশে কখনো ভারি, কখনও মাঝারি মাত্রায় বৃষ্টি হচ্ছে। এইডিস মশা বেড়ে যাওয়ায় এই থেমে থেমে বৃষ্টির প্রভাব আছে।
“এ কারণে যেমন মশা বাড়ছে তেমনি ভালোভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও মশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণ। এ কারণে ডেঙ্গুও বাড়ছে। আমরা যে ফোরকাস্টিং মডেল করি তাতে অক্টোবরে ডেঙ্গু থামার কোনো লক্ষণ দেখছি না। এমনকি এ বছর নভেম্বর ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ খুব ভালোভাবে থাকবে।”
শুক্রবার পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৪ হাজার ৪৩৮ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা চতুর্থ সর্বোচ্চ।
২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৭৭ জনের। বাংলাদেশে এর আগে ২০২৩ সালে ১৭০৫ জন, ২০২২ সালে ২৮১ জন এবং ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের
মৃত্যু হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। সে হিসাবে এ বছর শেষ হওয়ার আগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ।
এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ৮৩ জনের মৃত্যু হয়। অক্টোবরের প্রথম চারদিনেই মারা গেছে ১৪ জন।
এর আগে জানুয়ারি মাসে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ জন, মার্চ মাসে ৫ জন, এপ্রিল মাসে ২ জন, মে মাসে ১২ জন, জুন মাসে ৮ জন, জুলাই মাসে ১২ জন এবং অগাস্ট মাসে ২৭ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে।