প্রতীক্ষার দীর্ঘ ১৩ বছর পর ঢাকার মাটিতে গান পরিবেশন করছেন কবীর সুমন।
Published : 15 Oct 2022, 10:48 PM
কয়েক প্রজন্মের মধ্যে মুগ্ধতা তৈরি করেছে ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমনের গান; তার প্রতি বাঙালির আবেগ অনেক দিনের।
শনিবার দুপুর গড়িয়ে বিকাল হওয়ার আগেই ঢাকার রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শ্রোতা দর্শকের ভিড়েই আরেকবার মিলেছে তার প্রমাণ। সবাই এসেছেন তার গান শুনতে, সুমনে আরও একবার মুগ্ধ হতে।
পিপহোলের আয়োজনে এ শিল্পীর জনপ্রিয় অ্যালবাম 'তোমাকে চাই' এর ৩০ বছর উদযাপন উপলক্ষে 'সুমনের গান' শিরোনামে তিন দিনের আসরের রোববার ছিল প্রথম দিন।
বিকাল সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শ্রোতা ভক্তদের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে বিকাল ৫টা বেজে যায়। সুমন মঞ্চে ওঠেন ৫টা ১০ মিনিটে। দর্শকদের মিলনায়তনে প্রবেশের জন্য গেইট খুলে দেওয়া হয় বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটে।
এদিন গান শুনতে এসেছিলেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
একসময়ে কবীর সুমনের গান বাংলাদেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল এবং এখনও তার ব্যতিক্রম নয় উল্লেখ করে এই অভিনেতা, আবৃত্তিকার বলেন, "বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের গানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, গানের কনসার্ট মানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, যেখানে ৮০ শতাংশই এই প্রজন্মের। এবারের আয়োজনেও এত এত মানুষই তার প্রমাণ। সবাই তো সুমনকেই শুনতে এসেছে।“
এ ধারাকে ইতিবাচক হিসেবেই বর্ণনা করেন তিনি।
কবীর সুমনের বাংলা খেয়াল গানের প্রসঙ্গ তুলে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, "বহুদিন যাবত মানুষের ধারণা ছিল খেয়াল গান শুধু হিন্দুস্থানি ধাঁচের হবে। সেই জায়গা থেকে কবীর সুমন একদম ভিন্নভাবে খেয়াল গান নিয়ে কাজ করেছেন। খেয়ালকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন বাংলা খেয়ালের মাধ্যমে। সেই জায়গাতে তিনি একটা পরিবর্তন এনেছেন।"
তবে সুমনের সঙ্গে একদম নতুন প্রজন্মের সংযোগে 'ব্যর্থতা' রয়েছে মন্তব্য করে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমার পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কবীর সুমনকে নিয়ে বাংলা ও বাঙালির আবেগ নব্বইয়ের দশক থেকে। আমরা যারা চল্লিশোর্ধ্ব, তাদের কাছে আবেগটা অন্যরকম৷
“আমাদের নষ্টালজিয়ার জায়গা থেকে ভালো লাগছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের একটা অংশকে কবীর সুমন সম্পর্কে জানাতে আমরা হয়ত সক্ষম হইনি। সুমনের মত একজন বিশাল মাপের শিল্পীকে আমরাই চেনাতে পারলাম না, নাকি এই যুগেরই সংকট সেটা বোঝা মুশকিল।"
বর্তমান সময়ে এ শিল্পী জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "প্রেম আর বিরহের বাইরেও যে সংগীত অনেকটাই জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে, এটা ভারতীয় উপমহাদেশ কবীর সুমনের কাছ থেকেই জেনেছি৷ এখনকার সময়ের জন্য তাই সুমন জরুরি।"
সুমনকে বাংলা গানের 'বাঁক বদলের নায়ক' হিসেবে তুলে ধরে গানের আসরে আসা ডাকসুর সাবেক সহ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, “কবীর সুমন আমাদের কয়েক প্রজন্মের প্রিয় কণ্ঠস্বর। বাংলা গানের বাঁক বদলের নায়ক তিনি।
“এক দশকেরও বেশি সময় পরে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আলাদা একটা উন্মাদনা কাজ করছে।
"জীবনের সঙ্গে প্রেম, ভালোবাসার সাথে সামাজিক লড়াইয়ের যে সংযোগ, সেটা তো তার গানেই আমরা দেখতে পাই। সে কারণেই তার এই গানের আসরের মুহূর্তটি আমাদের জন্য স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে।"
এবারের আয়োজনের তিন দিনেরই টিকিট কেটেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী দীপম সাহা।
সরাসরি গান শোনার এ সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, "কবীর সুমন তো আমাদের কাছে একটা আবেগের জায়গা। ওনার গান ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। উনি বাংলাদেশে এসেছেন, এত বছর পর এখানে কনসার্ট করছেন, বেশ ভালো লাগছে।
“ইচ্ছা ছিল, ভারতে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করব। কিন্তু উনি নিজেই এখানে চলে এসেছেন। দ্বিগুণ আনন্দ কাজ করছে।"
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নওশীন শহিদ বলেন, "আগেরবার তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছেন, তখন ছোট ছিলাম, আসা হয়নি। এবার অনেক বেশি এক্সাইটেড ছিলাম, তাই তাড়াহুড়া করে টিকিট কেটেছি।"
দুই বাংলাতেই জনপ্রিয় এ শিল্পীর গান শুনতে আসা ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর শিক্ষক মুশফিকা তরী বলেন, “অনেক অনেক দিন থেকেই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, কবে কবীর সুমন বাংলাদেশে আসবেন, গান গাইবেন। আমরা সোশাল মিডিয়াতে দেখেছি, তিনি নিয়মিত গান গাইছেন, এবার এদেশে এসেছেন, অন্যরকম আনন্দ লাগছে।"
তরুণ প্রজন্ম তার প্রতি কতটা আগ্রহী এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "আমার তো মনে হয়, কবীর সুমনের প্রতি আবেগ চল্লিশোর্ধ্ব থেকে শুরু করে বর্তমানে স্কুলগামীদেরও আছে। আমার ভাতিজি ক্লাস টেনে পড়ছে, সে নিজেও তার ভক্ত।"
সবশেষ ২০০৯ সালে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতীয় বাংলা গানের জনপ্রিয় এ শিল্পী। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ঢাকায় আবার গান পরিবেশন করছেন তিনি। তবে ভেন্যু নিয়ে জটিলতায় শুরুটা সুখকর হয়নি। তবুও পরিবর্তিত ভেন্যুতে অনুষ্ঠানটি হওয়ায় ভক্ত, শ্রোতা-দর্শকারা বেশ আনন্দিত।
১৯৯২ সালে কবীর সুমনের প্রথম আধুনিক গানের অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’ প্রকাশিত হলে বাংলা গানের গতিপথ বদলে যায় বলে মনে করেন সঙ্গীতপ্রেমীরা। অ্যালবামটি প্রকাশের ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে।
এ উপলক্ষে সুমনের ভক্তরা তাকে ঢাকায় গান পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানান।
রোববার আধুনিক বাংলা গান পরিবেশনের পর ১৮ অক্টোবর আধুনিক বাংলা খেয়াল এবং ২১ অক্টোবর আধুনিক বাংলা গান দিয়ে এ আয়োজনের ইতি সমাপ্তি ঘটবে।