“কিন্তু যে বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছি, এখন তো পাখি নিয়েও সিনেমা বানানো যাবে না। এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে- এই স্লোগান নিয়েই আমাদের আগাতে হবে।”
Published : 25 Aug 2022, 07:03 PM
মামলার খড়গে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে ভীতির মুখে পড়ার কথা জানালেন ‘হাওয়া’র নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন।
তিনি বলেছেন, “সিনেমায় একটা অবাস্তব দৃশ্যকে বাস্তব করে দেখানোর চেষ্টা করেছি। সাময়িক সময়ের জন্য সেই পাখিটিকে খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে, আবার সেটাকে অবমুক্ত করেছি। কিন্তু পাখিটিকে অবমুক্ত করার পর এখন দেখছি, আমি নিজেই বন্দি হয়ে গেছি।”
‘হাওয়া’ নির্মাতা সুমনের বিরুদ্ধে বন বিভাগের মামলা, ‘শনিবার বিকেল’র সেন্সর ছাড়পত্র না দেওয়ার প্রতিবাদসহ নানা দাবিতে বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীদের এক মতবিনিময় সভায় একথা বলেন তিনি।
গত ২৯ জুলাই ‘হাওয়া’ মুক্তির পর দর্শক মহলে বেশ সাড়া ফেলে। খরার মধ্যে চলচ্চিত্র অঙ্গনে সুবাতাস হিসেবেই দেখা হচ্ছিল সুমনের সিনেমাটিকে।
তবে সিনেমায় শালিক পাখিকে খাঁচায় বন্দি রাখা, মেরে খাওয়া কিংবা শাপলা পাতামাছ ধরার দৃশ্যগুলো আইন লঙ্ঘনের নজির বলে প্রাণী অধিকারকর্মীরা অভিযোগ তোলেন।
এর পরিপ্রিক্ষিতে সিনেমাটি দেখার পর মামলার আবেদন নিয়ে আদালতে যায় বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এই আইনে অপরাধ প্রমাণিত হলে ‘হাওয়া’র নির্মাতার দুই বছরের জেলসহ জরিমানা হতে পারে।
‘হাওয়া’র পাশাপাশি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র না দেওয়া নিয়ে সরব নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীরা সরব হয়ে উঠেছেন। তার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারের এই সভা হয়।
সভায় সুমন বলেন, “নতুন সিনেমা নিয়ে যখন ভাবতে যাই, প্রথম মাথায় আসে এটা করা যাবে না, ওটা বলা যাবে না। আমরা মজা করে বলে থাকি, এখন ফুল-পাখি-লতা-পাতা নিয়ে সিনেমা বানাতে হবে।
“কিন্তু যে বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছি, এখন তো পাখি নিয়েও সিনেমা বানানো যাবে না। এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে- এই স্লোগান নিয়েই আমাদের আগাতে হবে।”
‘গল্প বলার স্বাধীনতা’ চেয়ে নির্মাতা-শিল্পীদের সভা
কাঁটাতারের বেড়ার আদলে সেট তৈরি করে সেই মঞ্চে বসে এদিন মতবিনিময় সভায় আসেন নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীরা।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “কোথাও পাহাড় কাটছে না, নদী দখল করছে না, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না- এমন কোনো কাজ কি করতে পারছে পরিবেশ অধিদপ্তর? তারা সেদিকে নজর না দিয়ে সিনেমার পেছনে লেগেছে। এর পেছনে উদ্দেশ্যটা কী?”
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, “মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া সিনেমাটি মানুষ গ্রহণ করেছে। সিনেমাটি সফল হওয়ায় অনেকের হয়ত গাত্রদাহ হচ্ছে। এই মেধাবী তরুণদের থামাতে কেউ পেছনে লেগেছে। আমি বিশ্বাস করি এই তরুণদের সুন্দর পরিবেশ দিলে ওরা বিশ্ব জয় করবে।”
অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা তারিক আনাম খান বলেন, “পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ নিয়ে তো পরিবেশ অধিদপ্তরের মাথাব্যথা নেই, কিন্তু সিনেমার দৃশ্যে খাঁচায় বন্দি পাখি দেখানো নিয়ে তাদের অনেক মাথা ব্যথা! লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেঘে দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা। কিন্তু সিনেমায় খাঁচায় বন্দি পাখি দেখানোর জন্য মামলা হয় ২০ কোটি টাকার। আমি একই সাথে ক্ষুব্ধ এবং শঙ্কিত।”
দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য আড়াল থেকে কেউ ষড়যন্ত্র করছে বলেও সন্দেহ করছেন তারিক আনাম।
“নইলে হঠাৎ এভাবে সিনেমার পেছনে কেন লেগেছে? হাওয়া সিনেমাটা দর্শকের ভালো লেগেছে। অনেক দিন পর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তখন এসব মামলা, আমাদের ভয়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।”
ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামির উদাহরণ দিয়ে তারিক আনাম বলেন, “সিনেমার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কিয়ারোস্তামি বলেছেন, ‘সিনেমা তো পুরোটাই অবাস্তব। সেই অবাস্তব দৃশ্যের মধ্য দিয়েই জীবনের সত্যটা তুলে ধরা হয়। জীবনের সত্যটা বোঝার জন্য’।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের সমালোচনা করে অভিনেত্রী জয়া আহসান বলেন, “বন উজার হচ্ছে, কাঁটাবনে আমরা পশুপাখি আটকে রাখছি। সেখানে বন অধিদপ্তর কোথায়? সিনেমায় এটা দেখানো যাবে না, ওটা করা যাবে না- এত শর্ত নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা কি সম্ভব? এভাবে তো হয় না। এভাবে সিনেমা নির্মাণ করা যায় না। গল্প বলা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে এত কালা কানুন কেন?”