কণ্ঠরোধের কানুন ভাঙার প্রত্যয়ে শুরু সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব

“দেশে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি বিরাজ করছে,” বলেন উদীচী সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2024, 03:54 PM
Updated : 8 March 2024, 03:54 PM

কণ্ঠ ছেড়ে গান গেয়ে- কণ্ঠরোধের সব কালাকানুন ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হলো দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা। 

শুক্রবার বিকালে বাংলা একাডেমিতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত দুইদিনের এ উৎসব উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়।  

অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রথীন্দ্রনাথ। সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান।  

এসময় জাতীয় সঙ্গীত ও সংগঠন সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এরপর রথীন্দ্রনাথ রায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা-ঢোলের বাদনে নৃত্যের তালে তালে উল্লাসে মাতেন সারাদেশ থেকে আসা উদীচীর শিল্পীকর্মীসহ দর্শকরা। 

এরপর আলোচনা পর্বে উৎসবের প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক মাহমুদ সেলিম বলেন, "গণসঙ্গীতের প্রচার, প্রসার এবং সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে গণসংগীতকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিন ২৮ মার্চকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে উদীচী। 

"সব জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গণসংগীত প্রতিযোগিতার বিজয়ীরা জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনটি একক এবং একটি দলীয়- মোট চারটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।"

উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, “ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম এবং গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনসহ সাধারণ জনগণের যেকোনো অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অন্যতম অনুপ্রেরণা রেখেছে গণসঙ্গীত।" 

দেশে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি বিরাজ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটবাজি ও অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের দাদাগিরির সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি খাতে অচলাবস্থা, মুক্ত ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ দিনদিন রুদ্ধ হওয়াসহ অসংখ্য বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ দেশবাসী। 

“এ অচলাবস্থা নিরসন এবং দেশকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হতে গণসংগীতের সুরে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে চায় উদীচী। আর সেজন্যই এবারের উৎসবের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে 'কণ্ঠরোধের কানুন ভেঙে, কণ্ঠ ছেড়ে গান ধরেছি'।"  

শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সায়েম রানা বলেন, গণসঙ্গীত সবসময়ই বর্তমান কালকে সঠিকভাবে উন্মোচন করে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাসহ এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে গণসঙ্গীত। 

“তাই বর্তমান কালকে ধারণ করে জনগণের মুক্তির সার্বিক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাই গণসঙ্গীতের কাজ। উদীচীর গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু নতুন গান পরিবেশিত হয়েছে, যা বর্তমান সময়কে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে।” 

আলোচনা পর্ব শেষে উদীচীর গণসঙ্গীতের স্বরলিপির বই 'দ্রোহের গান'র মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। বইটিতে স্থান পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন সেন, মাহমুদ সেলিম, প্রবীর সরদারসহ বিভিন্ন জনের লেখা ও সুর করা ২২টি উল্লেখযোগ্য গণসঙ্গীত। এসব গানের স্বরলিপি তৈরি করেছেন মাহমুদ সেলিম ও পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল।

'সিন্ডিকেটের রোজনামচা' মঞ্চায়ন

সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় উৎসবের উদ্বোধনী পরিবেশনা। এ পরিবেশনায় বর্তমান সময়ে দেশের নানা অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনা ও নৈরাজ্যের চিত্র তুলে ধরেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা। 

'সিন্ডিকেটের রোজনামচা' শিরোনামের এ পরিবেশনায় বর্তমান সময়ে দেশের নানা অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনা ও নৈরাজ্যের চিত্র তুলে ধরেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা। এটি গ্রন্থনা করেছেন উদীচীর সহ-সভাপতি জামসেদ আনোয়ার তপন, সঙ্গীত পরিচালনায় সুরাইয়া পারভীন এবং নাট্যাংশ পরিচালনা করেছেন বিজন রায়।  

প্রতিযোগিতায় বিজয়ী যারা

উৎসবের প্রথম দিন শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ের গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা। জেলা পর্যায় শেষে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হয়ে সারাদেশ থেকে আসা প্রায় ৩০০ শিল্পী দিনভর প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। 

প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে প্রথম হয়েছে শ্রেয়া রায়, দ্বিতীয় হয়েছে তীর্থ বিশ্বাস এবং যৌথভাবে তৃতীয় হয়েছে রাহুল দেবনাথ ও সায়রা খান শুকরিয়া।  

‘খ’ বিভাগে দেশসেরা হয়েছে তনুশ্রী পাল, দ্বিতীয় হয়েছে অনুশ্রী শর্মা এবং তৃতীয় হয়েছে রাহমিম ইয়াসরীব সামিন। ‘গ’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইমন দাস, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন জ্যোতিষ চন্দ্র বর্মণ এবং তৃতীয় হয়েছেন অলি উল্লাহ।  

এছাড়া, দলীয় অর্থাৎ ‘ঘ’ বিভাগে দেশসেরা হয়েছে উদীচী নোয়াখালী জেলা সংসদ, দ্বিতীয় উদীচী বগুড়া জেলা সংসদ এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছে খুলনার সৃজনী সংগীত একাডেমি। প্রতিযোগিতায় বিচারকের ভূমিকা পালন করেন গীতিকার ও সুরকার সেলিম রেজা, গণসঙ্গীত শিল্পী সোহানা আহমেদ এবং গীতিকার ও সুরকার তানভীর আলম সজীব।  

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

প্রথম দিনের আয়োজনে সবশেষে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন হাবিবুল আলম। এছাড়া আমন্ত্রিত দল হিসেবে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। 

এছাড়া সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ, বিশ্ববীণা- গোপালগঞ্জ, উদীচী যশোর জেলা সংসদ, উদীচী ময়মনসিংহ জেলা সংসদ, রংপুরের লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদীচী মৌলভীবাজার জেলা সংসদ পরিচালিত ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক একাডেমি, উদীচী চৌমুহনী পৌর সংসদ, উদীচী নোয়াখালী জেলা সংসদ, বরিশালের উত্তরণ সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং উদীচী বগুড়া জেলা সংসদ।  

প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী দলগুলোর সমবেত সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের অনুষ্ঠানমালা।