যুদ্ধদিনের ছবি

গ্রামের এক সাধারণ মেয়ের চোখের সামনেই তার বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করা হলো, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো হানাদার সৈন্যদের ক্যাম্পে, চললো বীভৎস নির্যাতন। কেমন হতে পারে তার অভিব্যক্তি? ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমায় সেই মেয়েটিই হয়েছিলেন ববিতা।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2015, 05:47 AM
Updated : 26 March 2015, 05:50 AM

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু ১৯৭১ সাল থেকেই। ১৯৭৫ সালের পর সেই ধারা বেশ স্তিমিত হয়ে যায়। আবার নব্বইয়ের দশক থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র তৈরি হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রথমেই বলতে শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান পরিচালিত ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর কথা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় তিনি এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। বাঙ্গালি বেসামরিক জনতার ওপর চালানো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, সীমান্তে উদ্বাস্তু জনতার ঢল, আশ্রয় শিবিরে মানবেতর জীবন - সব কিছুই ধারণ করা হয়েছিল তথ্যচিত্রটিতে। `‌স্টপ জেনোসাইড’ এর অব্যবহিত পরেই জহির রায়হান নির্মাণ করেন আরেকটি তথ্যচিত্র ‌‌‌‌`এ স্টেট ইজ বর্ন’।

'ধীরে বহে মেঘনা' সিনেমার একটি দৃশ্য।

১৯৭২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম কাহিনিচিত্র ‌`ওরা ১১ জন'’। ১৯৭৩ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘সংগ্রাম’। দুটি ছবিতেই বাস্তব জীবনের মুক্তিযোদ্ধা খসরুসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা অভিনয় করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘মেঘের পর মেঘ’(২০০৪) ছবিটিও চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি।

১৯৭২ সালে আরও নির্মিত হয় আনন্দ পরিচালিত ‘বাঘা বাঙালি’, ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয় বাংলা’, ভারত-বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীদের অংশগ্রহণে রমজান আলি পরিচালিত ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’।

‘জয় বাংলা' ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭১ সালেই। পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড ছবিটির মুক্তি আটকে রেখেছিল।

আনোয়ার হোসেন, ববিতা ও উজ্জ্বল অভিনীত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ কাহিনি ও শিল্পগুণ বিচারে কালোত্তীর্ণ । ১৯৭৩ সালে নির্মিত ছবির মধ্যে আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ উল্লেখযোগ্য।

১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হলেও মূলত তা যুদ্ধ পরবর্তী দেশের সামাজিক অবস্থা তুলে ধরে।  একইভাবে মূলত যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরেছে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল'(১৯৭৪), আনন্দ পরিচালিত ‘কার হাসি কে হাসে’(১৯৭৪), হারুণ-উর-রশিদ পরিচালিত ‘মেঘের অনেক রঙ’(১৯৭৬)। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বাংলার ২৪ বছর’ ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। সে সময়ই কবীর আনোয়ারের ‘শ্লোগান’ মুক্তি পায়।

‘মেঘের অনেক রঙ’ ছবিতে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিতা এক গৃহবধূ, তার মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ও শিশু সন্তানের মমর্ান্তিক যন্ত্রণা দেখানো হয়।

১৯৭৭ সালে আবদুস সামাদের ‘সূর্য গ্রহণ’ ছবিতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া এজে মিন্টুর ‘বাঁধন হারা’, শহীদুল হক খানের ‘কলমীলতা’, এবং মতিন রহমানের ‘চিৎকার’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি।

আশির দশকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি খুব একটা নির্মিত হয়নি।

নব্বইয়ের দশকে আবার সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ ঠাঁই পেতে শুরু করে। তবে এসব ছবির অধিকাংশই ছিল বিকল্পধারার চলচ্চিত্র। এসময় মুক্তি পায় নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘একাত্তরের যীশু’(১৯৯৩), তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘নদীর নাম মধুমতি’(১৯৯৪)।

'কলমীলতা' সিনেমার একটি দৃশ্য।

১৯৭১ সালে মার্কিন সাংবাদিক লিয়ার লেভিন মুক্তিযুদ্ধের ওপর তথ্যচিত্র তৈরির জন্য রণাঙ্গনের, আশ্রয় শিবিরের এবং মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিকদের প্রচুর ফুটেজ ধারণ করেছিলেন। সেই ফুটেজ নিয়ে তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন দুটি চলচ্চিত্র ১৯৯৫ সালে ‘মুক্তির গান’ এবং ১৯৯৯ সালে ‘মুক্তির কথা’। দুটি চলচ্চিত্রেরই মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক বিবরণ হিসেবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর নির্মিত একটি অনন্য চলচ্চিত্র। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘আগুনের পরশমণি’ নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যতম শিল্পসার্থক চলচ্চিত্র। বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর অভিনীত চলচ্চিত্রটি যুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ শহরের অধিবাসী একটি পরিবারে একজন মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয় গ্রহণের কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠে। কাহিনি, সংলাপ, দৃশ্যায়ন, সংগীত ও অভিনয় মিলিয়ে চলচ্চিত্রটি ছিল অনবদ্য।

মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’, আবু সাইয়িদের ‘ধূসর যাত্রা’, বিকল্পধারার উল্লেখযোগ্য ছবি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মধ্যে দেবাশীষ সরকারের ‘শোভনের একাত্তর’, রফিকুল বারী চৌধুরীর ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’, জাঁ-নেসার ওসমানের ‘দুর্জয়’, হারুনুর রশিদের ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, বাদল রহমানের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, ছটকু আহমেদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের রঙপেন্সিল’ উল্লেখযোগ্য।

তারেক মাসুদ পরিচালিত ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মাটির ময়না’ একটি আলোচিত ছবি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ ছবিটি ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরে। তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘জয়যাত্রা' এবং হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্যামল ছায়া’ একাত্তরে উদ্বাস্তু মানুষের বেদনা, আতঙ্ক, গেরিলা যুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মমতাকে তুলে ধরে।

মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘খেলাঘর’(২০০৬) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য বিকল্পধারার ছবি।

২০০৯ সালে মুক্তি পায় তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘রাবেয়া’। ২০১০ সালে মুক্তি পায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাহিনি অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। কিশোরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চমৎকার ছবি এটি। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত ‘গেরিলা’ মুক্তি পায় ২০১০ সালে। দশটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় এটি।কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবেও পুরস্কার পায়।এছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়। পরিচালকের মুন্সীয়ানা, কাহিনি, সংলাপ, দৃশ্যগ্রহণ এবং জয়া আহসানের অনবদ্য অভিনয় ছবিটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

'ওরা এগারো জন' সিনেমার একটি দৃশ্য।

আলমগীর কবিরের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, 'লিবারেশন ফাইটার্স', মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, ‘আত্মদান’, 'সূচনা', আবু সাইয়িদের ‘আবর্তন’, খান আতাউর রহমানের ‘এখনও অনেক রাত’, ইলজার ইসলামের ‘দীপ নিভে যায়’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘ধ্রুবতারা’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘স্মৃতি ৭১’, ‘জীবন ঢুলি’(২০১২), সোহেল আরমানের ‘এই তো প্রেম’, আনিসুল হকের জননী সাহসিনী অবলম্বনে শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘একাত্তরের মা জননী’(২০১৪) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’(২০১৪) একটি আলোচিত ছবি। এ ছবিতে নির্মলেন্দু গুণসহ বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ অনেক কবি অভিনয় করেছেন। যুদ্ধাহত এক মুক্তিযোদ্ধার বঞ্চনার করুণ উপাখ্যান ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিদেশি চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে গিতা মেহতার প্রযোজনায় ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’, নাগিসা ওশিমা পরিচালিত ‘জয়বাংলা', 'রহমান: দ্য ফাদার অব দ্য নেশন’, ভানিয়া কেউল পরিচালিত ‘মেজর খালেদ’স ওয়ার, রবার্ট রজার্স পরিচালিত ‘দ্য কান্ট্রি মেড ফর বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে লিয়ার লেভিন ‘জয় বাংলা’ নামে একটি তথ্যচিত্রের কাজ শুরু করলেও তা অসমাপ্ত থাকে।

২০১৪ সালে ভারতীয় পরিচালক মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত নির্মাণ করেন ‘চিল্ড্রেন ওফ ওয়ার’ যা 'যুদ্ধশিশু' নামে বাংলাদেশে মুক্তি পায়। রাইমা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রটি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার বাঙ্গালি নারীদের ভয়াবহ যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছে।