সংগীতের গোলাম কবীর সুমন

বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামটা কী ভূমিকা রেখেছিলো তা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2021, 03:35 AM
Updated : 16 March 2021, 03:35 AM

কিংবা বাংলা গানে কবীর সুমন কোন জায়গায় বিশিষ্ট তা নিয়েও অনেক কথা বলা হয়েছে। আমি একটু অন্য একটা জায়গা নিয়ে দুটো কথা বলতে চাই। এবং সেই জায়গাটা একদমই সংগীতে অশিক্ষিত একজন শ্রোতার ভাবনা।

প্রয়াত সুধীর চক্রবর্তীর একটা প্রবন্ধে পড়েছিলাম, প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “যে কণ্ঠে বা যন্ত্রে সাত সুরের চর্চা করেনি গান নিয়ে তার লেখা উচিত নয়।”

একদম ঠিক কথা। আমি একদমই নিজের দুটো কথা লিখছি। এবং অগোছালো ভাবে। সেখানে ভুল করে যদি কোন গান সম্পর্কে কোন মন্তব্য চলে আসে, হয়তো আসবে, তাহলে প্রমথ চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

ব্যক্তিগতভাবে কবীর সুমনকে আমি ‘দ্রোণাচার্য’ বলি। সেটার একটা কারণ আছে। ছোট থেকে বাংলা আধুনিক গান শুনে বড় হওয়া এবং একইসঙ্গে সংগীতে অশিক্ষিত এই আমাকে গান শোনা শেখাচ্ছেন কবীর।

কীভাবে?

যে অ্যালবামটার কথা শুরুতেই বললাম, সেটার ‘তোমাকে চাই’ গানটার কথা দিয়ে শুরু করি।

গানটির একটি লাইন এরকম, ‘ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে…।’ শৈশব-কৈশোরে এই গানটা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু হিমাংশু দত্ত কে? জানতাম না।

অনেক পরে যখন সুরসাগর হিমাংশু দত্তের কথা জানতে পারলাম তখন কবীর সুমনকে দ্রোণাচার্য বলার সার্থকতা বুঝতে পারলাম।

হিমাংশু দত্তকে ক’জন শ্রোতা মনে রেখেছিলেন জানি না। আমার বাড়িতে কখনও হিমাংশু দত্তের গান শুনিনি। বাংলাদেশি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির শ্রোতারা (যেসব বাড়িতে সংগীত চর্চা হতো না) চিনতেন, হেমন্ত-মান্না-আশা-সন্ধ্যা-কিশোরসহ আরও কয়েকটি নাম।

আর রবীন্দ্র সংগীত ও নজরুল সংগীতের জনপ্রিয় সব শিল্পীদের নাম।

আমি গত শতকের ৮০’র শেষ এবং ৯০ দশকের কথা বলছি। একটু অনুসন্ধানীরা সুরকার-গীতিকারের নাম মনে রাখতেন। বুঝতে হবে, তখন রেডিওর যুগ প্রায় শেষ। ক্যাসেটের রমরমা। সিডি আসছে আসছে করছে। বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত বাজার দখল করছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা রকে ঝুঁকছে। আধুনিক গানে বেসিক রেকর্ড কমে আসছে। বাংলাদেশে সিনেমার গানই চলছে বেশি।

এরকম একটা সময়ে এসে কবীর সুমন হিমাংশু দত্তের নাম নিলেন। হিমাংশু দত্তের গানগুলো নিজেও গাইলেন। অ্যালবাম বের করলেন। বাংলা আধুনিক গানের যে চিরায়ত ধারায় কবীর সুমন বেড়ে উঠেছিলেন সেই ধারা কিংবা সংগীতের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে কবীর ছাইচাপা এক হীরের টুকরো তুলে আনলেন।

একটু সাহস করে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, এখনকার সময়ে যারা গান করছেন, বাংলাদেশে, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০’য়ের ভেতর তারা ক’জন হিমাংশু দত্তের গান শোনেন? বা চেনেন?

সুমন অখিল বন্ধু ঘোষকে নিয়ে আসলেন নিজের গানে। গাইলেন, ‘একলা লাগার সময় মানে নিজের সঙ্গে কথা বলা/তারই ফাঁকে কোথায় যেন অখিলবন্ধু ঘোষের গলা।’

কবীরের গানে আছেন মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম। আছেন সলিল চৌধুরী। আছেন অনুপম ঘটক, রবিন চট্টোপাধ্যায়। আছেন ভীমসেন যোশী, আমীর খান। আছেন বাংলাদেশের মাহমুদুন্নবী, আজাদ রহমান, এন্ড্রু কিশোর।

ঠিক এই জায়গায় কবীর সুমন সবার থেকে এগিয়ে।

আমার কাছে কবীর সুমনের এই অবদান মাথা নুইয়ে অভিবাদন করার মতো। কবীর সুমন তার শিক্ষাটা ছড়িয়ে দিলেন। সুমন চাইলেই ঘরে বসে হিমাংশু দত্তের গান গাইতে পারতেন। নিজে নিজে চর্চা করতে পারতেন। তিনি তা করলেন না।

সংগীতের গোলামি করেন বলেই সুমন সাধারণ শ্রোতার মধ্যে নিয়ে গেলেন। শুধু তাই না হিমাংশু দত্তকে স্মরণ কেনো করতে হবে তা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনাও করেছেন। ইউটিউবেই তা পাওয়া যায়।

সংগীতের হাতে খড়ি যাদের আছে শুধু তাদের জন্য নয়, আমার মতো মূর্খের জন্যও সহজবোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা করে গেলেন। এখনও করছেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা আধুনিক গানে যে উচ্চারণ ভঙ্গি নিয়ে আসলেন, সেটা কোন জায়গায় কেনো আধুনিক সেটা নিয়ে কবীর কথা বলেছেন, এখনও মাঝে মাঝে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

শুধু গান না, তার সঙ্গে বাজনা, গানের ইন্টারলিড-প্রিলিউড, কোনটা কেমন, কেনো বিশেষ সেসব নিয়েও কথা বলছেন।  এই জায়গায় কবীর সুমন অনন্য।

বর্তমানে সবকিছু সহজে পাওয়া য়ায়। সবকিছু ‘ইন্টারনেটে’ খোঁজা হয়। হবেই-তো। এখন-তো আর সেই ৫০ বছর আগের সময় নয়। সেজন্যই আধুনিক মানুষ কবীর সুমন আধুনিক সব মাধ্যম ব্যবহার করে গানকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। নিজের শিক্ষাটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

যারা সংগীতের শিক্ষার্থী তাদের বাইরে কবীর যে শ্রোতা তৈরি করেছেন এবং এখনও করছেন সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাকে শিক্ষিত করছেন। এইখানটায় তিনি নিঃসঙ্গ এক বাতিঘরের মতো দাঁড়িয়ে পথ দেখাচ্ছেন।

কবীর সুমন বর্তমানে বাংলা খেয়ালে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বন্দিশ তৈরি করছেন। গাইছেন। নতুন নতুন রাগ তৈরি করছেন। অল্প বয়স থেকেই কবীর খেয়াল শিল্পী হিসেবে প্রশিক্ষিত। কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীতের চেনাপথে তিনি গেলেন না।

ব্রজবুলি, উর্দু, দারি বা ফারসি ভাষায় তৈরি হয়ে থাকা বন্দিশ গাইলেন না। বাংলায় খেয়াল গান তৈরি করছেন। এক সময় আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় যে লড়াইটা করেছেন, সেই পথেই হাঁটছেন সুমন। এবং সেটা একা।

অনেক রকমের প্রতিবন্ধকতা তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তবে একটা জায়গায় কবীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলা খেয়ালকে তিনি সাধারণের মধ্যে নিয়ে যাবেন। বাংলা-ভাষীদের মধ্যে নিয়ে যাবেন। কবীর বাংলা খেয়ালই শুধু সৃষ্টি করছেন না। নিজের মতো করে তা শ্রোতাদের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন।

নতুন রাগ তৈরি করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন রাগটা কীভাবে তৈরি হলো। কোন রাগের কোন স্বর পরিবর্তন করে তিনি নতুন রাগ তৈরি করছেন।

শাস্ত্রীয় সংগীতকে সাধারণের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা সংগীত শিখছেন তাদের কাছে ব্যাপারগুলো হয়ত বোঝা সহজ। কিন্তু সাধারণ শ্রোতা, মানে যারা রাগ, স্বর ইত্যাদি বোঝেন না, তাদের কী হবে?

তাদেরকেও তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রাগের নাম, তাল, রাগের চলন। শ্রোতা তৈরি হচ্ছে। বাংলা খেয়ালের শ্রোতা তৈরি করছেন কবীর। যারা বলেন বাংলায় খেয়াল হয় না। তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।

কবীরের রক্তে ‘পিতৃ পুরুষ উপস্থিত’। বাংলা খেয়াল যে দস্তুরমতো গাওয়া হতো, সেটার একের পর এক উদাহরণ তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের খেয়ালের পথিকৃৎ প্রয়াত আজাদ রহমানের কথা ফিরে ফিরে আসছে কবীর সুমনের কথায়। হয়তো এই বাংলাদেশেই কোনোদিন কবীর সুমন তার খেয়াল নিয়ে আসবেন। সেদিন আজাদ রহমান কোনো একটা জায়গা থেকে হয়তো শুনবেন।

দ্রোণাচার্য বলার এখানেও একটা কারণ আছে। সংগীতের নামে একটা কদর্য, অশ্লীল সময়ে কবীর সুমন বাংলা খেয়াল নিয়ে মেতেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তার ভাষায়, আধুনিক ভাষায় খেয়াল গান নিয়ে যাচ্ছেন। শেখাচ্ছেন। তার ছাত্র-ছাত্রীরা শিখছেন।

মনে আছে, একজন কবীর সুমনের একটি ফেইসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “বাংলা খেয়াল গান আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে।”

ঠিক এখানেই কবীর সুমনের সার্থকতা। এখানেই তিনি আর সবাইকে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে আছেন।

সুমন বলেন, “আমি সংগীতের গোলাম।”

সংগীতের গোলামি করে কবীর আরও গোলাম তৈরি করছেন। দূর থেকে আমার মতো অনেকেই শ্রোতা হিসেবে গোলামি করছেন। একলব্যের মতো গান-বাজনা শোনা শিখছে।

কবীর সুমনের জন্মদিন আজ। শ্রদ্ধা জানাই তাকে।