১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর জীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘জঠরলীনা’। ২০১৩ সাল থেকে এর নির্মাণ কাজ শুরু করে টানা পাঁচবছর ধাপে ধাপে চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনার পর ২০১৮ সালে প্রদর্শনের জন্য তৈরি হয় চলচ্চিত্রটি। আটত্রিশ মিনিট তিরিশ সেকেন্ডের এ চলচ্চিত্রটি যখন গ্যাটে ইনস্টিটিউটের প্রদর্শনী কক্ষে চলছিলো রুমভর্তি দর্শক পিনপতন নীরবতার ভিতর দিয়ে দেখছিলেন একজন রমা চৌধুরী’র শোক-শক্তি ও সংগ্রামের জীবনচিত্র।
একাত্তরের যুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ঘর বাড়ি পুড়ে গিয়েছে, সংগ্রামময় জীবনে বারবার সন্তানদের মৃত্যুর শোক বয়ে বেড়াতে হয়েছে। একাত্তরের এ জননী’র দুঃখভরা জীবনের গল্পই যেন চিত্রশিল্পের মতোই তুলে এনেছেন দিলারা বেগম জলি। পুত্রের সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে রমা চৌধুরীরর কান্নার দৃশ্যে তিনি রাখেননি কোন শব্দ।
রমা চৌধুরীর কাছে গিয়েই তিনি উপলব্ধি করেন তার জীবন-সংগ্রামকে সেলুলয়েডে বন্দী করতে চান। দিনের পর দিন রমা চৌধুরীর দিকে ক্যামেরা তাক করে ছিলেন। নিজের মোবাইল ফোন, মিনিপ্যাডেও ধারণ করেছেন এ মহিয়সী নারীর জীবন। তার রচনাপাঠ, চিঠি, কবিতাও তুলে এনেছেন সংলাপবিহীন এ তথ্যচিত্রে।
গ্যোটে ইনস্টিটিউটে ‘জঠরলীনা’ প্রদর্শনীর পর উপস্থিত দর্শকদের প্রশ্নের জবাবে জলি উত্তর দিলেন এর নামকরণের পেছনের যুক্তি বর্ণনা করে।
তিনি বলেন, “দেখুন, আমার মনে হয়, প্রতিটি যুদ্ধেই নারীর জঠর অর্থাৎ জরায়ুকে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধে নারীর জরায়ু একটা পলেটিক্যাল অস্ত্র হয়ে ওঠে। আমি তাই রমা চৌধুরীর কাছে এসে এই জঠরের দিকেই ফোকাস করতে চেয়েছি। তাই এ ছবির নাম ‘জঠরলীনা’।”
হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি তিনি। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেওয়া। এরপর ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই চলেছেন রমা চৌধুরী। ২০১৮ সালে ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
এ তথ্যচিত্রের প্রয়োজনে নির্মাতা জলি যেন হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়েছেন তার। নিজের লেখা পাঠ শেষে ভৎর্সনাও সয়েছেন রমা চৌধুরীর। রমা বলেছিলেন, “তুই কেন আসিস? কেন আমাকে দিয়ে এসব পড়াচ্ছিস, জানিস না এসব পড়লে আমার কষ্ট হয়?”
রমা চৌধুরীর দু:খ ভরাক্রান্ত জীবনের ভেতর যেন একাত্তরের দগদগে ঘা ফুটে ওঠে ‘জঠরলীনা’য়।