গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে চিরবিদায়: ‘মাটির মানুষ’ ফিরে গেলেন মাটির কোলে

বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের স্রষ্টা।

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2022, 05:07 PM
Updated : 5 Sept 2022, 05:07 PM

বর্ষণমুখর এক বিকালে চিরবিদায় জানান হল বাংলা সংগীত জগতের এক দিকপাল গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সোমবার সন্ধ্যায় পরিবার ও সহকর্মীদের উপস্থিতিতে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি।

এ সময় স্বজন আর ভক্ত-অনুরাগীদের কান্না এবং তাকে নিয়ে সবার স্মৃতিমালায় ভারী হয়ে ওঠে বনানীর পরিবেশ।

এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় চিত্রনায়িকা ও নির্মাতা অরুণা বিশ্বাস বলেন, “একজন মানুষ এত এত প্রতিভার অধিকারী, তারপরও কী মোলায়েমভাবে মিশতেন সবার সঙ্গে। এমন মাটির মানুষ সোনার বাংলায় অনেক অনেক দরকার ছিল।”

বনানীতে নেওয়ার আগে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন, “দেশের শিল্পাঙ্গনে তার অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

“আমি প্রার্থনা করি, তার পরিবার যত দ্রুত সম্ভব এই শোক কাটিয়ে উঠবেন। দেশের সংস্কৃতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আল্লাহর কাছে চাই, আমাদের আরেকজন গাজী মাজহারুল আনোয়ার দিন।”

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ এর মতো কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের পাশাপাশি ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ এর মতো জনপ্রিয় অসংখ্য গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

৭৯ বছর বয়সে রোববার ভোরে মারা যান এই গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, যিনি একইসঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে।

Also Read: গাজী মাজহারুল আনোয়ারের চিরবিদায়

Also Read: গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জনপ্রিয় যত গান

Also Read: গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জন্য ফেইসবুকে শোকগাথা

সোমবার সকালে তাকে নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। রাষ্ট্রীয় সম্মান, গান স্যালুট, আর সহযোদ্ধা, সহকর্মীদের অশ্রুভরা ভালোবাসায় বিদায় জানানো হয় তাকে।

দুপুর ১টায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কফিন নেওয়া হয় বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন- বিএফডিসিতে। সেখানে তাকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পী, নির্মাতা, লেখক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সহকর্মীরা।

সেখানে চিত্রনায়িকা অঞ্জনা কান্নাভরা কণ্ঠে বলেন, “তিনি আমাকে অঞ্জনা বানিয়েছেন। এত ভালো মনের মানুষ আমি চলচ্চিত্রাঙ্গনে পাইনি। তিনি কখনও উঁচু গলায় কথা বলতেন না। তার নরম স্বর এখনও আমার কানে বাজছে। এই শোক কাটিয়ে উঠতে আমার কতদিন লাগবে বুঝতে পারছি না।”

চিত্রনায়ক ওমর সানী বলেন, “তার গান মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি জুগিয়েছে। দেশকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। চলচ্চিত্রকে সোনালী সময়ে নিয়ে যেতে তার ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।

“একাধারে গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, নির্মাতা ও প্রযোজক ছিলেন তিনি। এমন গুণী মানুষের চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি।”

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, “তিনি কুমিল্লা থেকে ঢাকা এসেছিলেন মেডিকেলে পড়ার জন্য। মেডিকেল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়া অবস্থায় সিনেমার গান লেখেন। আয়না এবং অবশিষ্ট সিনেমায় লেখেন ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’। সেই গান আজও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এমন প্রতিভা বাংলার ইতিহাসে বিরল।”

সংগীতশিল্পী মনির খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “তিনি ছিলেন আমার বাবার মতো। আমাকে সন্তান বলে পরিচয় দিতেন। তার মৃত্যুতে শুধু সংগীত কিংবা চলচ্চিত্রাঙ্গন না; দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এই ক্ষতি কিছুতেই পুষবে না।”

Also Read: ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের গীতিকারকে শেষ বিদায়

অভিনেতা ও উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয় বলেন, “আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ তিনি।”

তরুণ গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবন বলেন, “একজন মানুষ ২০ হাজারের বেশি গান লিখেছেন। তার যত গান কালজয়ী হয়েছে, তিনি যত মানুষের কাছে গেছেন, আমার মনে হয় আর কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।”

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মেয়ে সংগীতশিল্পী দিঠি আনোয়ার বলেন, “আমার আব্বু সব সময় দেশের কথা ভাবতেন। দেশের শিল্পচর্চার কথা ভাবতেন।”

ছেলে সফররাজ আনোয়ার বলেন, “বাবা তুমুল জনপ্রিয় ও সফল মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার জীবনাচরণ ছিল একেবারে সাধারণ। সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন।”

বিকালে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ গুলশান কেন্দ্রী মসজিদে (আজাদ মসজিদ) নেওয়া হয়। আসরের নামাজের পর জানাজা হয় সেখানে, তাতে যোগ দেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় পরিবার ও সহকর্মীদের উপস্থিতিতে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে শায়িত হন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।