নির্মাতার অভিযোগ, নয় বছর ধরে অন্যায়ভাবে তার 'রানা প্লাজা' সিনেমাটি আটকে রাখা হয়েছে।
Published : 18 Aug 2024, 10:08 PM
নয় বছর ধরে আটকে থাকা ‘রানা প্লাজা’ সিনেমার মুক্তির জন্য নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছেন নির্মাতা নজরুল ইসলাম খান।
সাভারের রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে পোশাককর্মী রেশমা আক্তারকে উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে এর আগে বহুভাবে চেষ্টা করেও ফল পাননি নজরুল। গণ আন্দোলনে সরকার পতনের পর এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন তিনি।
গ্লিটজকে এ পরিচালক বলেন, “প্রায় দশ বছর ধরে আমরা ঝুলে আছি। নতুন সরকার আসায় মনে হচ্ছে সিনেমাটি অন্ধকার জগত থেকে এবার বের করতে পারব।”
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আট তলা রানা প্লাজা ভেঙে পড়লে শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই ঘটনায় নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন, আহত হন আরও হাজারখানেক শ্রমিক যারা ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।
ধসের ১৭ দিনের মাথায় ১০ মে বিকালে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে রেশমা আক্তারকে জীবিত উদ্ধার করা হলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
ওই বছরই রানা প্লাজা ধস ও রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন পরিচালক নজরুল ইসলাম খান।
তাতে পোশাকশ্রমিক ‘রেশমা' চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেত্রী পরীমনি। তার বিপরীতে ‘টিটু’ চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা সায়মন সাদিক।
কিন্তু এর কাহিনী ও বেশ কিছু দৃশ্য পোশাক শিল্প খাতকে ‘অশান্ত করে তুলতে পারে’ বলে অভিযোগ উঠলে সেন্সর বোর্ড ২০১৪ সালে সিনেমাটি আটকে দেয়।
দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে ‘রানা প্লাজা’ সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেলেও মুক্তির প্রস্তুতির মধ্যেই হাই কোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেয়।
সেদিনের কথা স্মরণ করে নির্মাতা বলেন, “‘রানা প্লাজা’ সিনেমাটি ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি দিতে আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। আগের দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানতে পারি, হাই কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।”
এরপর শুরু হয় আইনি লড়াই। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে সিনেমাটি মুক্তির পক্ষেই সায় দেয়। কিন্তু ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তখনকার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের এক আদেশে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।
পুরা ঘটনাপ্রবাহে ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্মাতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, “অন্যায়ভাবে আমার সিনেমাটি এত বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে। সিনেমাটি ব্যান করার কোনো কারণ আদালতে কেউ দেখাতে পারেনি। এই সিনেমায় কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না, দেশের গার্মেন্টস শিল্প বা শ্রমিকদের নিয়ে কোনো বিরোধিতা ছিল না।
“আমার সিনেমার বিষয়বস্তু হচ্ছে– একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি কোথায় হতে পারে, একজন নারী শ্রমিক কতটা সচেতন থেকে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ সচেতনমূলক একটি সিনেমা ' রানা প্লাজা'।"
নজরুল বলেন, “'রানা প্লাজা' সিনেমার বিষয়টা কিন্তু কল্পনাপ্রসূ কোনো গল্প থেকে তুলে আনা হয়নি। এটা বাংলাদেশের মানুষ জানে এবং এটা ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তাজরীন গার্মেন্ট বা রানা প্লাজার মত আর কোনো দুর্ঘটনা যেন না হয়, সেই চিন্তা থেকে সেসময় সচেতনমূলক সিনেমা নির্মাণ করেছিলাম।”
সেজন্য অনেক শ্রম ও টাকা খরচ হওয়ার কথা তুলে ধরে এই পরিচালক বলেন, “আমার চিন্তা ছিল এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমি সারা জীবন মানুষের কাছে বেঁচে থাকব। সবসময় তো সিনেমা হিট হলে নায়কের নামে সিনেমা চলে। এই চলচ্চিত্রটি যেন নির্মাতার নামে চলে এই ভাবনা আমার ছিল।"
কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে নজরুল বলেন, "আমি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে গেছি সিনেমাটি কেন ব্যান করা হল সেই যুক্তি খুঁজতে। এই সিনেমাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি পুরো ধ্বংস হয়ে গেছি। আমি আর কোনো সিনেমা পরিচালনায় মনোনিবেশ করতে পারিনি। সিনেমা করিনি।"
এখন সিনেমাটি মুক্তির জন্য কোন প্রক্রিয়ায় এগোতে চান জানতে চাইলে নজরুল বলেন, “আদালত থেকে সব প্রক্রিয়া মীমাংসা করার পরেও রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপন দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এখন রাষ্ট্রপতির কাছেই যেতে হবে। নতুন সরকার যেহেতু আছে, এখন সেখানে গিয়েই দেখি এই যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ মেলে কিনা।"
২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ৫০টির বেশি হলে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ‘রানা প্লাজা’ সিনেমাটির। কিন্তু বাংলাদেশ প্রিন্ট সেন্সরশিপ রুলস ১৯৭৭ অনুসারে ‘ভীতিকর দৃশ্য প্রদর্শন করায়’ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দিয়েছিল হাই কোর্ট। 'ভীতিকর দৃশ্য' সংযোজনের অভিযোগে রিট আবেদনটি করেছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স এমপ্লয়িজ লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম।
অথচ তার আগে সেন্সর সনদও পেয়েছিল সিনেমাটিয়। এ বিষয়ে সেন্সর বোর্ডের সচিব মুন্সী জালাল উদ্দিন এবং বোর্ড সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজারের সঙ্গে কথা বলেছে গ্লিটজ। তারা বলছেন, সেন্সর বোর্ডের রিভিউ ও আপিল- দুটি কমিটিই ‘রানা প্লাজা’ সিনেমাটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। তারপর সিনেমার প্রযোজক সংস্থা উচ্চ আদালত থেকে সিনেমাটির ছাড়পত্রের ব্যাপারে নির্দেশনা নিয়ে আসেন। তখন সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয়।
মুন্সী জালাল উদ্দিন বলেন, “আমরা তো সিনেমাটিকে ছাড়পত্রই দিতে চাইনি। তারপর আদালতের নির্দেশনা অনুসারে আমরা ১৮ বার নিরীক্ষার পর সিনেমাটিকে ছাড়পত্র দিয়েছি। সিনেমাটির নাম নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকলেও আদালত বলে, ‘ভয়ঙ্কর ও হিংসাত্মক’ দৃশ্য নিরীক্ষা করে সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র দিয়ে দিতে।
“তখন আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালক বেশকিছু দৃশ্য পুনঃসম্পাদনা করে সেন্সরে জমা দেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সেই সিনেমাকে শেষে ছাড়পত্র দিতে বাধ্য ছিলাম।”
সেন্সর বোর্ডের তৎকালীন সচিব নিজামুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, সিনেমাটি নিয়ে ‘খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে’ আপত্তি এসেছিল।
এখন রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলে সেসব মুশকিল আসন হবে বলে আশা করছেন নির্মাতা নজরুল ইসলাম খান।
পরীমনি, সাইমন সাদিক ছাড়াও আবুল হায়াত, সাদেক বাচ্চু, কাবিলা, রেহানা জলি, শিরিন আলম, হাবিব খান অভিনয় করেছেন ‘রানা প্লাজা’ সিনেমায়। নজরুল ইসলাম খানের কাহিনী ও চিত্রনাট্যে নির্মিত এ সিনেমার সংলাপ লিখেছেন মুজতবা সউদ।