'জিনিসপত্রের যেই দাম বেড়েছে বাজারে গেলে সব কিছুর দামই আগুন৷ এই কয়টা দিন একটু কষ্ট করেই চলেছে।'
Published : 28 Jul 2024, 09:17 AM
বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা বা সিরিজ নির্মাণের শুটিং সেটে একটু পর পর শোনা যায়, 'প্রোডাকশন, প্রোডাকশন'। কারো পানি লাগবে, কারো বা চা-খাবার। কেউ হয় বসার জন্য চেয়ার খুঁজছেন বা প্রয়োজন হয়েছে ফ্যান। অথবা শুটিংয়ের জন্য কোনো একটি জিনিস দ্রুত কিনে আনতে হবে, সেখানেও ভরসা প্রোডাকশন টিম।
অর্থাৎ শুটিং সেটের ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠের’ দায়িত্ব থাকে প্রোডাকশন ম্যানেজারদের ওপরে। তিনি তার কর্মীদের দিয়ে এসব কাজ সামলান, যারা ‘প্রোডাকশন বয়’ নামে পরিচিত।
শিল্পী ও নির্মাতারা ছাড়াও, শুটিং ইউনিটের লাইটম্যান, ক্যামেরা ক্রু, এডি, আর্ট, সাউন্ডসহ প্রায় সব বিভাগের ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষের সব ধরনের প্রয়োজন সামলানোর দায়িত্ব তাদের কাঁধেই থাকে। কিন্তু এই সব মানুষদের তুমুল ব্যস্ততায় ভাটা পড়েছিল দিন কয়েক আগে।
কোটা সংস্কার ঘিরে নজিরবিহীন সহিংসতা, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ এবং কারফিউয়ের কারণে শুটিংয়ের কাজে স্থবিরতা নামে। ফলে কাজ বন্ধ সপ্তাহখানেক বেকার সময় গেছে প্রোডাকশন বয়দের, তাই রোজগারও হয়নি।
এই মানুষগুলোর সংগঠন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন মিডিয়া প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন’র সভাপতি মো. আবু জাফর অপু গ্লিটজকে জানিয়েছেন, বিনোদন অঙ্গনে প্রোডাকশন বয় হিসেবে কাজ করে ৭০০ জন এবং প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন ২০০ জন। যাদের প্রত্যেকের কাজ বন্ধ হয়েছে আন্দোলন-সহিংসতা ঘিরে।
অপু বলেন, “এখনো অনেকের কাজ শুরু হয়নি। সপ্তাহখানেক গৃহবন্দী থাকার কারণে সঞ্চয় ভাঙছে। শুটিং বন্ধ, আয় বন্ধ, সবাই চলে কীভাবে? আমাদের কোনো খোঁজখবর নেওয়ারও কেউ নেই। নিজেদের কষ্টের কথা নিজেদের কাছেই রাখতে হয়, কাউকে বলেও লাভ নেই।”
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার জানিয়েছেন, প্রোডাকশন বয় অর্থাৎ যারা সহকারী প্রোডাকশন হিসেবে কাজ করেন, তাদের দিনে আয় করেন ১২০০ টাকার মতো। আর প্রোডাকশন ম্যানেজারদের আয় আড়াই হাজার থেকে ৩০০০ টাকা।
আনোয়ার নিজেও প্রোডাকশন ম্যানেজার।
গ্লিটজকে তিনি বলেন, “দিনের বিল দিনে দিয়ে দেয়, আবার মাঝে মধ্যে তিন দিন শুটিং হলে দুই দিনের বিল দেয়৷ একদিন আটকে রাখে, পরে দেয়৷”
মন্দাদশার কথা তুলে ধরে আনোয়ার বলেন, “শুটিং বন্ধ প্রায় নয়দিন। প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে প্রধান সহকারী প্রোডাকশন হিসেবেও যারা কাজ করে তাদের অবস্থা করুণ। এই পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন ফোন দিয়ে জানতে চাইল- ভাই কী করব, সংসার তো চালাতে হবে। খুবই খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। যারা গ্রামে চলে গেছে তাদের অবস্থা মোটামুটি, কিন্তু যারা ঢাকায় আছে তাদের অবস্থাই বেশি খারাপ।”
এই পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগের পাশাপাশি নিজেদের দিনযাপনের কথা জানানেল প্রোডাকশন বয় রবিউল ইসলাম।
“আমরা অনেকটা দিন আনা দিন খাওয়া লোক। ছয়-সাতদিন পরিবার নিয়া খুব কষ্ট করছি। বলতে গেলে একটা নির্মাণের প্রাণ আমরা। বাসা-বাড়িতে যেমন আমাদের মায়েরা কাজ করে তেমনি শুটিং সেটে সেই কাজগুলা আমরা করি। সবাইকে দেখে শুনে রাখি। এই কয়দিনে আমাদের ফোন দিয়েও কেউ খোঁজ নেয়নি। আমরা ফোন দিয়ে ম্যানেজারদের কাছে জানিয়েছি, আমাদের চলতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা সারাদিন পরিশ্রম করে যেই টাকা পাই সেই টাকা দিয়ে বাজার করার পরে সঞ্চয় করার আর থাকে না। যে কারণেই হোক শুটিং বন্ধ থাকলেই আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। সবকিছু ঠিক করে শুটিং চালু হোক তাই চাই।”
একই কথা এই পেশায় থাকা মামুনুর রশিদের মুখেও।
“আমাদের সেরকম সঞ্চয় নেই। জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে বাজারে গেলে সবকিছুর দামই আগুন৷ এই কয়টা দিন একটু কষ্ট করেই চলেছে। এই পেশায় কাজ করে পাশাপাশি আর কিছু করাও হয় না।”
পরিচালক বা প্রযোজকদের তরফ থেকে কেউ খোঁজ নিয়েছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের খোঁজ নেওয়ার কে থাকবে! কাজের জায়গায় কাজ। না খেয়ে থাকতে হলে আমাদেরই থাকতে হচ্ছে।”
বাংলাদেশ টেলিভিশন মিডিয়া প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশনর সভাপতি অপুও আক্ষেপও প্রোডাকশন বয়দের মতই। তারও ভাষ্য, এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ বন্ধ থাকলে কেউ কারও না।
তিনি বলেন, “দৈনন্দিন মানুষ যেমন সকালে কাজের খোঁজে বের হয়, কাজকর্ম শেষে কিছু টাকা নিয়ে বাসায় ফিরে, বাজার করে তরকারি নিয়ে বাসায় ফিরে। আমাদের প্রোডাকশন সিস্টেমটাও এমনই। আমার ৯০০ জন ছেলেপুলের কাজ বন্ধ, আয় বন্ধ। কাজ থাকলে তাদের পরিবারে অন্ন জোটে, না থাকলে জোটে না, তাদের খোঁজও কেউ করে না।”
এই সময়ে প্রযোজক, পরিচালকদের নীরব ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমরা তো তাদেরই (প্রযোজক, পরিচালক) কাজ করি। আমরা দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছি, কিন্তু কেউ বলে না তোমরা কেউ বিপদে আছ কি না, নিরাপদে আছ কি না সেটা জানতেও কেউ কল দেয়নি।"
কয়েকদিনে শুটিং বন্ধ রেখেছিলেন অনেক পরিচালকও। নির্মাতা রাফাত মজুমদার রিংকুর দুটি নাটকের শিডিউল ছিল।
রিংকু বলেন, "আমার শুটিং ছিল ২১ থেকে ২৩ জুলাই। আন্দোলনকে ঘিরে এই সংঘাতের মধ্যে শুটিং করব কীভাবে তাই পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে যাচ্ছিল পরপর দুইটা নাটকের শুটিং বাতিল করেছি। ১৬-১৭ তারিখের দিকেই সবার সঙ্গে আলোচনা করে শুটিং বন্ধ রাখি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শুটিংয়ে যাওয়া হবে না। স্বাভাবিক হলেই নতুন তারিখ চূড়ান্ত করে কাজে ফিরব।”
এছাড়া নাটক পরিচালক মোহন আহমেদ, মহিদুল মহিম, তারেক রেজা, শামস করিমসহ অনেকে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। আবার সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতেও শুটিং চালিয়েছেন কিছু পরিচালক, তবে সেই সংখ্যা নগণ্য। যেমন ঢাকার অদূরে পুবাইলে গ্রামের দিকে অনেক নাটকের শুটিং হয়। আন্দোলন সহিংসতায় গড়ালে পূবাইলের কিছু শুটিং ইউনিট ঢাকা ফিরতে পারেনি বলে শুটিং চালিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ ইনডোর শুটিংও করেও কাজ এগিয়ে রেখেছেন বলে পরিচালক রাফাত মজুমদার রিংকু জানান।
কারফিউ পাশ নিয়ে শুটিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রযোজক আলি বাসীর।
দুদিন শুটিং চলছে জানিয়ে এই প্রযোজক বলেন, “প্রোডাকশন বয় বা ম্যানেজার যারা আছে তাদের অবস্থা সত্যি সত্যিই ভালো না। তাদের অবস্থার কথা চিন্তা করেই আমরা শুটিং শুরু করি, সঙ্গে কারফিউ পাস রেখেছিলাম।"
ক্রান্তিকালে প্রোডাকশন ম্যানেজার ও কর্মীদের খোঁজ খবর না রাখার অভিযোগ নিয়ে প্রযোজক আলী বাসীর বলেন, “খোঁজ খবর আমরা কম বেশি সবারই নেওয়ার চেষ্টা করেছি। শুটিংয়ে তো প্রোডাকশন বয় ছাড়া, লাইটের মানুষ ছাড়া কাজ সম্পূর্ণ হবে না। তারা আমার পরিবার। কিন্তু তাদের পরিবার চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্বতো আমি নিতে পারব না। কিন্তু শুটিং চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। যেন অন্যভাবে পাশে থাকার সুযোগটা থাকে।"
শুটিং বন্ধ থাকায় কতটা লোকসান হয়েছে প্রশ্নে তিনি বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত তো সবাই হচ্ছে। শুটিং হাউস, টেকনিক্যাল হাউস, এডিটিং প্যানেল সব জায়গা থেকেই তো শিডিউল নিয়ে রাখতে হয়।
“আবার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় অনেক নাটকের ভিউ কমে যাওয়া থেকে শুরু করে বিরাট অংকের ক্ষতি হয়েছে। তবে দেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে সেই আশা করছি।”