“শিল্পকলার অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেই ২০ লাখ টাকা তুলে রেখেছিলাম। সরকারের পতনের কারণে অফিসে না আসায় টাকাগুলো কক্ষেই রয়ে যায়।”
Published : 05 Oct 2024, 12:57 AM
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীসহ চার কর্মকর্তার কক্ষে নগদ ৪৩ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, একাডেমির অনুষ্ঠান, প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচির প্রয়োজনেই এই টাকা তাদের কক্ষে রাখা হয়েছে।
যাদের কক্ষে টাকা পাওয়া গেছে তারা হলেন- সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, তার দপ্তরের সহকারী পরিচালক (পিএস) আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ, ওই দপ্তরে কর্মরত কালচারাল অফিসার সাদিয়া বিনতে আফজল এবং লাকীর মেয়াদের অর্থবিভাগের উপপরিচালক একেএম মোস্তাক আহমেদ। লাকী ছাড়া বাকি তিনজন যে যার পদে এখনো বহাল আছেন।
মোস্তাক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিল্পকলার অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেই ২০ লাখ টাকা তুলে রেখেছিলাম। সরকারের পতনের কারণে অফিসে না আসায় টাকাগুলো কক্ষেই রয়ে যায়।”
এ বিষয়ে জানতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদকে ও সচিব সালাহউদ্দিন আহমদের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি জনসংযোগ ও অর্থবিভাগের কর্তব্যক্তিদের।
এদিকে শিল্পকলায় নগদ টাকা টাকা পাওয়ার ঘটনায় কেউ কেউ বলছেন, ‘শিল্পকলার কর্মকর্তাদের কক্ষ যেন টাকার খনি’।
থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’র নির্বাহী সম্পাদক ও কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একাডেমির কর্মকর্তাদের কক্ষে যে টাকা পাওয়া গেছে, এটা তো সত্য। এই নগদ টাকা নিয়ে যেহেতু নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমির উচিত, এর একটা ব্যাখ্যা জানানো। তাদের নীরবতার কারণেই অতিরঞ্জিত অনেক গল্প তৈরি হচ্ছে। শিল্পকলাকে তো জানাতে হবে, এই টাকার উৎস কি? কার টাকা, কিভাবে কর্মকর্তাদের কক্ষে আছে।”
কার কাছে কত ছিল
এই টাকার বিষয়ে জানতে একাডেমির অন্তত দশ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
নাম প্রকাশ না করে তারা জানিয়েছেন, লাকীর দপ্তরের পিএস আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ এবং সাদিয়া বিনতে আফজলের কক্ষে পৃথক আলমারিতে নগদ ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
বুধবার একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদের নেতৃত্বে একটি দল ওই টাকা উদ্ধার করে শিল্পকলা একাডেমির ব্যাংক হিসাবে জমা করেন।
এর আগে লাকীর মেয়াদে অর্থবিভাগের উপপরিচালক একেএম মোস্তাক আহমেদের কক্ষ থেকেও ২০ লাখ টাকা এবং সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর কক্ষ থেকেও দুই লাখ টাকা পাওয়া যায় বলেও একাডেমির কর্মীরা জানিয়েছেন।
সচিবকে আগেই জানানো হয়েছে, দাবি দুই কর্মকর্তার
মহাপরিচালকের দপ্তরের সহকারী পরিচালক (পিএস) আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কাছে দুজন কর্মকর্তার নামে গৃহীত হাওর উৎসব আয়োজনের জন্য অগ্রিম ১০ লাখ টাকা এবং আরো দুটো অনুষ্ঠানের কিছু বকেয়া বিল, ভ্যাট এবং আয়করের টাকা ছিল। এটা আমি আগে সভায় কর্তৃপক্ষের কাছে বলেছি। পরে সচিব স্যারকেও একাধিকবার বিষয়টি জানিয়েছি।”
মোস্তাক আহমেদের ভাষ্য, গত জুন মাসে ‘শিল্পকলা প্রতিযোগিতা’ নামে একটি কর্মসূচি হাতে নেয় একাডেমি। এই কর্মসূচির চূড়ান্ত আয়োজন জুলাই মাসে হওয়ার কথা ছিল।
“সেজন্য একাডেমির মহাপরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে জুলাই মাসে ২০ লাখ টাকা তুলে আমার কক্ষে রাখি। পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে শিল্পকলা প্রতিযোগিতা আর হয়নি। আমিও শিল্পকলায় না যাওয়ায় টাকাগুলো অফিস কক্ষেই থাকে।”
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে আর অফিসে আসেননি শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। পরে ১২ অগাস্ট তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে পদত্যাগপত্র পাঠান।
শিল্পকলায় অফিস করতে এলে একাডেমির কর্মীদের একটি অংশের বাধার মুখে পড়েন লাকীর অনুসারী কর্মকর্তারা। তাদের উপর হামলার ঘটনাও ঘটে।
লাকীর দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল একাডেমির একটি অংশ। সরকার পতনের পরদিন ৬ অগাস্ট একাডেমির ১৫ জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দেন বিক্ষুব্ধরা। যাদের কক্ষ তালা দেওয়া হয়, তারা ‘লাকীর লোক’ হিসেবে একাডেমিতে পরিচিত। কোনো কোনো কর্মকর্তার কক্ষ ভাঙচুরেরও অভিযোগ উঠে।
মোস্তাক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কক্ষ তালা দেওয়ায় আমি সচিব স্যারকে বলেছি যে আমার কক্ষে টাকা আছে। আমার পাসপোর্টও আছে। পরে স্যারকে নিয়ে আমার কক্ষ থেকে পাসপোর্ট নিতে যায় এবং ২০ লাখ টাকা স্যারের কাছে দিয়েছি। স্যার শিল্পকলার ব্যাংকে হিসাবে জমা করে দেন। পরে এটাকেও টাকা উদ্ধার বলে অপপ্রচার করেছে কেউ কেউ।”
পিএস আবু ছালেহ মো. আবদুল্লাহ বলেন, “আমার রুম তো দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। ২ অক্টোবর খোলার পর আমার কক্ষে থাকা টাকা অর্থবিভাগে জমা রশিদের মাধ্যমে হস্তান্তর করেছি৷ আমি এবং সাদিয়া আফজল একই কক্ষে অফিস করি। কিন্তু আমাদের পৃথক আলমারি রয়েছে।
“আমার আলমারিতে মোট ১৩ লাখ ২৫ হাজার আটশ টাকা ছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকা ছিল ‘হাওর উৎসবের’ জন্য। আর বাকি টাকা ছিল অন্য দুটি অনুষ্ঠানের কিছু বকেয়া বিল এবং ভ্যাট ও আয়করের টাকা। পুরো অর্থ জমার রশিদের মাধ্যমে অর্থবিভাগে দেওয়া হয়েছে।”
একটি ‘স্পষ্ট বিষয়কে নেতিবাচক করে তুলে ধরা হচ্ছে’ এবং বিষয়টি অত্যন্ত আপত্তিকর ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন আবু ছালেহ।
মহাপরিচালকের দপ্তরের কালচারাল অফিসার সাদিয়া বিনতে আফজলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
লাকীর পদত্যাগের পর গত ৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষক ও নাট্যনির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদকে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর একাডেমির ছয়টি বিভাগে নতুন পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
পূর্বের খবর
শিল্পকলায় লাকীর অনুসারী কর্মকর্তাদের কক্ষে তালা, হামলা
শিল্পকলাকে সচল করতে সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর দরকার: সৈয়দ জামিল
সহকর্মীদের ক্ষোভের মুখে শিল্পকলা ছাড়লেন জ্যোতি