এবার দুই সিটিতে মেয়র পদের জন্য লড়ছেন বিভিন্ন দলের ১৩ জন (দক্ষিণে ৭, উত্তরে ৬ জন) প্রার্থী। তবে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার প্রার্থীর প্রচারের ডামাডোলে অনেকটাই ম্রিয়মান অন্যরা।
ভোটার, গণমাধ্যম- সবখানেই চার প্রার্থীকে নিয়েই আগ্রহ। স্বাভাবিকভাবেই সবার নজর ছিল তাদের ইশতেহারে। সেসব ঘেঁটে দেখা গেছে, চার মেয়র প্রার্থী যেসব অঙ্গীকার করেছেন, তাতে সাদৃশ্যই বেশি।
ব্যতিক্রমও আছে কিছু কিছু। যেমন- তাবিথ আউয়ালের ‘মশা প্রতিরোধক গাছ’ লাগানো, আতিকুল ইসলাম ও ইশরাক হোসেনের ‘বিদ্যুৎচালিত বাস’ চালু, শেখ ফজলে নূর তাপসের ‘হাঁটার জন্য আলাদা পথ’ তৈরির অঙ্গীকার।
উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম ২৬ জানুয়ারি, বিনেপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ২৭ জানুয়ারি ইশতেহার ঘোষণা করেন। আর ২৮ জানুয়ারি দক্ষিণ সিটিতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ইশরাক হোসেন এবং ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের ইশতেহার আসে।
প্রধান চার প্রতিদ্বন্দ্বীর ইশতেহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজধানীর মূল সমস্যাগুলো সমাধানের অঙ্গীকার করেছেন সবাই। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আধুনিক সচল ঢাকা গড়ার।
এই সাদৃশ্যে খুব একটা অবাক হননি জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ- জানিপপ’র চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মূল চারজন প্রার্থীর সবাই অভিজ্ঞ, শিক্ষিত এবং সবারই একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। ফলে তাদের যে স্বপ্ন তার মধ্যেও একটা মিল আছে। এ কারণে তারা সবাই একটা লক্ষ্য সামনে রেখে কথা বলেছেন।
“আর তাদের ভোটারদের কথাও মনে রাখতে হবে। ভোটাররা রাজধানী শহরের বাসিন্দা, অজপাড়াগাঁয়ের লোক নয় যে সাতপাঁচ বুঝিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন। তারা ভোটারদের মূল দাবিগুলো তাদের ইশতেহার ঘোষণার সময় বিবেচনায় নিয়েছেন।”
এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলোই তারা চাইলে বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে মনে করেন নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, সমস্যাটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে সমাধানও অনেকটা হয়ে যায়।
“পুরোনো শহর আর নতুন শহরের পার্থক্যটাও তারা ধরতে পেরেছেন। এটাও তারা তাদের ইশতিহারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মোট কথা কারও না কারও তো শুরু করতে হবে। প্রথমবার না পারলেও দ্বিতীয়বার পারবেন। আমি আশাবাদী।”
মশার বিরুদ্ধে লড়াই
ফজলে নূর তাপস তার ইশতেহারে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, মশা নিধনে দৈনন্দিন ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে মশা নিধনে নিয়মিত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অঙ্গীকার করে ইশরাক হোসেন বলছেন, ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট’ পদ্ধতিতে সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে দেশব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম চালাবেন তিনি।
মশামুক্ত শহর নিশ্চিত করতে ‘পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও নিয়মিত, নিরবিচ্ছিন্ন’ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আছে আতিকুল ইসলামের ইশতেহারে।
এক্ষেত্রে তাবিথ আউয়াল মশা নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ‘মশা প্রতিরোধক গাছ’ রোপনের নতুন প্রতিশ্রুতি হাজির করেছেন।
গণপরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষসহ সবার জন্য আধুনিক ফুটওভারব্রিজ, আলাদা সাইকেল লেইন, বিদ্যুতচালিত বাস, ডিজিটাল ট্রাফিক পদ্ধতি চালু করবেন বলে ইশতেহারে বলেছেন আতিকুল ইসলাম।
ভূগর্ভস্থ সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পূর্ব-পশ্চিমে সড়ক বৃদ্ধি, ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করা, কার্যকর গণপরিবহন গড়ে তোলা এবং সড়কে যানবাহনের গতি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাবিথ আউয়াল। উন্নয়নে বিশদ পরিকল্পনাও দিয়েছেন তিনি।
গণপরিবহনের চলাচল ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু সড়কে দ্রুতগতির যানবাহন, কিছু সড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। কিছু সড়কে শুধু হাঁটার ব্যবস্থা থাকবে বলেও অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
যানজট নিরসন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের কথা বলেছেন ডিএসসিসিতে বিএনপিরপ্রার্থী ইশরাক হোসেন। তার অঙ্গীকার- নির্বাচিত হলে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও অলিগলির রাস্তা সংস্কার, আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ, দ্রুতগামী বৈদ্যুতিক বাস চালু, সাইকেল এবং মোটর সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন তৈরি করবেন তিনি।
জলাবদ্ধতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
নগরের সব জায়গায় সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিয়েছেন তাবিথ আউয়াল। ই-বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ডোর-টু-ডোর বর্জ্য সংগ্রহ করে রাত ১২টা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে অপসারণের অঙ্গীকার ইশতেহারে করেছেন তিনি।
তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করবেন।
নির্বাচিত হলে বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করতে চান দক্ষিণে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেনও। বায়ু ও শব্দ দূষণমুক্ত শহর গড়তে উৎসে নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার কথা ইশতেহারে বলেছেন তিনি। এছাড়া আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্যানিটারি ল্যান্ডফিল তৈরির প্রতিশ্রুতিও তার।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দৈনন্দিন ভিত্তিতে সড়কের আবর্জনা সরানোর ব্যবস্থা নেবেন ফজলে নূর তাপস।
বিনোদন
উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেছেন, সবার জন্য সুবিধাসহ এলাকাভিত্তিক পার্ক ও আধুনিক খেলার মাঠ এবং সাংস্কৃতিক ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলবেন তিনি। ওয়ার্ডভিত্তিক বিনোদনকেন্দ্র, উন্মুক্ত স্থান গড়ে তোলা এবং শিশুপার্ক ও বিনোদনকেন্দ্রের আধুনিকায়নের অঙ্গীকার আছে তাবিথের ইশতিহারে।
নির্বাচিত হলে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে সবুজায়নের মাধ্যমে শিশুপার্ক, থিয়েটার হল করবেন শেখ ফজলে নূর তাপস। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষার পাড় ঘিরে বনায়ন ও বিনোদনকেন্দ্র স্থাপনের কথা জানিয়েছেন তাপস।
নদীভিত্তিক বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি আছে ইশরাক হোসেনেরও। তিনি ইশতেহারে বলেছেন, নির্বাচিত হলে নদীর তীর রক্ষায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প নেবেন তিনি।
পুরান ঢাকা নিয়ে গঠিত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রার্থীরা দিয়েছেন ঐতিহ্য ধরে আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি।
এছাড়া সব শ্রেণির মানুষের জন্য পাবলিক টয়লেট, ভেজালমুক্ত কাঁচাবাজার স্থাপন, অপরাধ ও মাদকের বিস্তার রোধ, নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব ঢাকা, অগ্নিনির্বাপন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অনলাইনে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের অঙ্গীকার রয়েছে প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহারে।