ইভিএমের ভোটে ভাবনায় ভোটার উপস্থিতি

একাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদে ইভিএমের কেন্দ্রে ভোট পড়েছে গড়ে ৫১%,  চট্টগ্রাম-৮ উপ নির্বাচনে ২৩% ভোট পড়েছে। পাঁচ বছর আগে ঢাকা উত্তরে ৩৭% ও দক্ষিণে ৪৮% ভোট পড়েছে। এবার ইভিএমে উপস্থিতি কেমন থাকবে?

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2020, 11:39 AM
Updated : 2 Feb 2020, 12:03 PM

ঢাকা  উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানের মধ্যে ভোটার উপস্থিতির বিষয়টিও এখন আলোচনায়।

শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত দুই সিটিতে ভোট চলবে ইভিএমে। এর আগে ব্যাপক জনসচেনতায় প্রচার, প্রদর্শনী ও মক ভোটিংয়ের আয়োজন করেছিল নির্বাচন কমিশন।

গত মঙ্গলবার ইভিএম প্রদর্শনীতে ভোটারদের সাড়া দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, “জনগণ যারা জানতে চায় বুঝতে চায়, তাদের জন্য এ প্রদর্শনী। ভোটাররা যাতে বুঝতে পারে। প্রদর্শনী ভালোই তো হচ্ছে।…সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, নিজের ভোট দিয়ে দেওয়ার জন্যই ইভিএমে ভোট।”

তার ঠিক এক দিন বাদে শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের অনুশীলন দেখতে গিয়ে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, “আমি একজন নতুন ভোটার। আমি কখনও ইভিএমে ভোট দিইনি। আমি কর্মকর্তাদের সাথে নতুন ভোটারের মতো কথা বলেছি। একটা ইউনিটে তারা ১২টায় এসেছেন। ৩ ঘণ্টায় মাত্র ১ জনকে তারা শেখাতে পেরেছেন, ১ জনের মাত্র ভোট নিয়েছেন। এটার উপরে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”

এর আগে গত ২২ জানুয়ারি ইসির আইন-শৃঙ্খলা সভায় ইভিএমের এ ভোটে উপস্থিতির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার কমিশনের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধিও একান্ত অপরিহার্য। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।”

পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল তিন সিটিকে একদিনেই ভোট হয়েছিল। গড়ে ভোট পড়েছিল ৪৩%, ভোট হয়েছিল ব্যালট পেপারে।

সেবার ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৭%; দক্ষিণ সিটিতে ৪৮% এবং চট্টগ্রামে ভোট পড়েছিল ৪৭%। আর ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৩১%।

বিজয়নগরের ঢাকা সরকারি বধির হাই স্কুলে মঙ্গলবার ভোটারদের জানার জন্য ইভিএম ব্যালট যন্ত্র প্রদর্শন করা হয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সর্বশেষ ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়, তাতে ভোট পড়ে মাত্র ২২.৯৪%।

সেই প্রসঙ্গ টেনে মাহবুব তালুকদার গত ২২ জানুয়ারি ইসির আইন-শৃঙ্খলা সভায় বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে যে ২৯৪টি আসনে ব্যালট পেপারে ভোট হয়েছে, সেখানে ভোটের হার হয়েছে ৮০%। কিন্তু ইভিএমের কেন্দ্রগুলোতে ভোট পড়েছে গড়ে ৫১ শতাংশ।

“এর কারণ ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মনে আছে ইভিএম ভীতি। অন্যদিকে ইভিএম-এ জাল ভোট প্রদান প্রতিহত করা এক বিরাট সমস্যা।... আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে গোপন কক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।”

ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সমর্থকদের বিভ্রান্ত না করারও আহ্বান জানান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

কোনো দলের নামোল্লেখ না করে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “যারা ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছেন, তাদের বক্তব্য অনেক সময় তাদের সমর্থক ভোটারদের মনেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায়, তাদের সমর্থক ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ইভিএম-এ ভোট দিতে আগ্রহী হন, এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক।”

শুরু থেকেই ইভিএমের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি বলে আসছে, কারচুপির সুযোগ তৈরি করতেই ‘সরকারের ইচ্ছায়’ নির্বাচন কমিশন এ যন্ত্র ভোটারদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতেই তারা ইভিএম চায়, কারণ তাদের ভাষায় ‘জবর দখল ও জাল ভোটের সুযোগ ইভিএমএ নেই’।

আত্মবিশ্বাসী ইসি

ইভিএম এর কারিগরি বিষয়ে দেখভালে দায়িত্বে থাকা ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম বর্তমান ইভিএমে সফলতা তুলে ধরে বলছেন, ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়েও কারা আত্মবিশ্বাসী।

“ইভিএমে আমরা সফল হবো। ভোটার উপস্থিতিও ভালো হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কমিশন বদ্ধপরিকর। ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি।”

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণেই ভোটারদের উপস্থিতি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

সাইদুল বলেন, “আমরা নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করছি। যার ভোট সে দেবে। এটাই আমরা নিশ্চিত করছি।”

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সিটি নির্বাচনে ইভিবমে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধরণ মানুষও বেশ ভালোভাবে নিয়েছে এই ইভিএম।

“রাজশাহী, বরিশাল ও বিভিন্ন সিটিতে ব্যবহার করে সবাই একবাক্যে বলেছে এটি অতুলনীয়, এটা সহজ। এ মেশিনে অনৈতিক কাজ করা সম্ভব না। যার ভোট সেই দিতে পারবে।”

সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি দুপচাঁচিয়া পৌরসভা নির্বাচনে ইভিএমে ৮১% ভোট পড়ার তথ্য তুলে ধরে এনআইডি উইং মহাপরিচালক বলেন, “দুপচাঁচিয়ায় আমরা প্রমাণ করেছি…  সফলতার সঙ্গে আমরা ব্যবহার করেছি। হাইমচর উপজেলাতেও শতভাগ সফলতার সঙ্গে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে।”

তিনি বলেন, ২০১১ সালে যে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে একজন ব্যক্তির পরিচয় যাচাই করার ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এখন যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তিকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব।

বর্তমান ইভিএমে ভোটার চিহ্নিত করার জন্য যে কয়েকটি পর্যায় রয়েছে তার মধ্যে একজন ব্যক্তিকে চারভাবে চিহ্নিত করা যায় বলে জানান তিনি।

বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার

নির্বাচনসমূহ

মোট ভোটার

প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা

শতকরা হার (%)

২৮৬, চট্টগ্রাম-৯ আসন

(৩০ ডিসেম্বর ২০১৮)

৩৯০৪৩১

২৪৫৪৪৯

৬২.৬৭%

লালমোহন পৌরসভা নির্বাচন

(১৪ অক্টোবর ২০১৯)

১৯১০০

১৩৬২৬

৭১.৩৪%

কাঞ্চন পৌরসভা নারায়ণগঞ্জ

(১৪ অক্টোবর ২০১৯)

৩৫৮৬০

২৬৬১২

৭৪.২১%

রূপগঞ্জ পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ

(১৪ অক্টোবর ২০১৯)

৩৩১৩৭

২৫৪২৯

৭৬.৭১%

আমতলী পৌরসভা, বরগুনা

(২২ জানুয়ারি ২০১৯)

১৯১০০

১৩৬২৬

৭১.৩৪%

রূপগঞ্জ ইউনিয়ন, নারায়ণগঞ্জ

(১০ অক্টোবর ২০১৯)

৩৩১৩৭

১৩৬৯১

৭৬.৭১%

দুপচাচিঁয়া পৌরসভা, বগুড়া

(১৩ জানুয়ারি ২০২০)

১৬৭৬৩

১৩৬৯১

৮১.৪০%

মালিগাছা ইউনিয়ন, পাবনা

(১৩ জানুয়ারি ২০২০)

৩৬৪৯

২৭১২

৭৪.৩২%

এক মিনিটেরও কম সময়ে ইভিএমে ভোট

ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. কামাল উদ্দিন জানান, প্রায় আড়াই হাজার কেন্দ্রের জন্য ভোট কক্ষভিত্তিক ইভিএম প্রস্তুত করে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৫ হাজারের মত ইভিএম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রতিটি ভোট কক্ষে মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের জন্য ইভিএমের ব্যালট ইউনিট থাকবে। কোনো ধরনের ঝামেলা বা ত্রুটি দেখা দিলে স্বল্প সময়ে অন্য ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি থাকছে। সে জন্যে অতিরিক্ত ইভিএম থাকবে কেন্দ্রে।

ইভিএমে ভোটদান পদ্ধতি ‘খুবই সহজ’ মন্তব্য করে এ কর্মকর্তা জানান, “ডিজিটাল অডিট ট্রায়ালের মাধ্যমে ভোটারদের দ্রুত শণাক্ত করে ব্যালট ইস্যু করা হবে। প্রতি ভোটকক্ষে গড়ে ৪০০ ভোটার থাকবেন।  এক মিনিটেরও কম সময়ে ভোট দিতে পারবেন তারা।

শুক্রবার সকাল থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের কাছে ইভিএমসহ ভোটের ৪৩ ধরনের সরঞ্জাম বিতরণ করছেন।

খিলগাঁও মডেল কলেজে ভোটের সরঞ্জাম বিতরণ কার্যক্রম দেখতে এসে দক্ষিণের রিটার্নিং অফিসার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, ভোটের সরঞ্জাম পাওয়ার পর প্রতিটি কেন্দ্রে শুক্রবার রাতে তা পরীক্ষা করা হবে। শনিবার সকালে ইভিএম মেশিন ‘সেট’ করা হবে।

ভোট শুরুর আগে পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতিতে ইভিএম মেশিনে যে ‘শূন্য’ ভোট রয়েছে তা দেখানো হবে। কোনো ইভিএম মেশিনে সমস্যা দেখা দিলে রিজার্ভ মেশিন ব্যবহার করা হবে। ভোট শেষে প্রিজাইডিং অফিসাররা ট্যাবের মাধ্যমে অনলাইনে রিটার্নিং অফিসারের কাছে ফলাফল পাঠিয়ে দেবেন। পরে কেন্দ্রীয়ভাবে তা ঘোষণা করা হবে।

ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ভোটের সরঞ্জাম বিতরণ কার্যক্রম দেখতে এসে সিইসি কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে ভোটারদের আহ্বান জানাব- আগামীকাল (শনিবার) তারা যেন প্রত্যেকেই ভোটকেন্দ্র যান।

“ইভিএমে ভোটদানের ব্যাপারে আমাদের প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসারদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা তারা করবে। ইভিএমে ভোট দিয়ে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, এই আহ্বান আমি ভোটারদের প্রতি জানাই।”