এবার বই প্রকাশ হয়েছে ৩৭৩০টি, বিক্রি ৪৭ কোটি টাকা।
Published : 28 Feb 2023, 09:52 PM
মহামারীর খাঁড়া কাটিয়ে আগের রূপে ফেরা এবার অমর একুশে বইমেলায় গত বছরের চেয়ে বেশি বই প্রকাশ হলেও বিক্রি কমে গেছে।
এবার নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৩০টি, যা আগের বছর ছিল ৩ হাজার ৪১৬টি। অর্থাৎ ৩১৪টি বই বেশি প্রকাশ হয়েছে এবার।
তবে বিক্রির ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র। এবার মোট ৪৭ কোটি টাকার বই কিনেছেন ক্রেতারা, আগের বছর এই অঙ্ক ছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বিক্রি কমেছে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিরও। আগের বছরের চেয়ে ১০ লাখ টাকা কম বিক্রি হয়েছে সংস্থাটির। গত বছর তাদের বিক্রি ছিল ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, এবার তা ১ কোটি ২৪ লাখ।
এক মাসের মেলা শেষে মঙ্গলবার বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
শেষ দিন বিকাল ৩টায় শুরু হয়ে বইমেলার পর্দা নামে রাত ৯টায়।
এর আগে সমাপনী অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬৩ জন মেলায় আসেন।
অবশ্য বই বিক্রির তথ্য সঠিক কি না, তা নিয়ে যে সংশয় আছে, সেটি ফুটে উঠেছে মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে পাঠ করা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলামেরই প্রতিবেদনে।
তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, “এবার ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং পরবর্তী সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করলে বলা যায় যে, এবার কমপক্ষে ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।”
এই সিদ্ধান্তে কীভাবে এলেন- জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলা একাডেমির প্রতিনিধিরা স্টলে স্টলে বই বিক্রির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ফরম বিতরণ করেছেন। অনেক স্টল/প্যাভিলিয়নের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
“আবার ঐতিহ্য/আকার/প্রচারণায় এগিয়ে থাকা বেশ কিছু স্টল/প্যাভিলিয়নের তথ্য উপাত্ত বাস্তবসম্মত নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে এটি যে মেলার পূর্ণাঙ্গ বিক্রির হিসাব তা পরিচালনা কমিটি মনে করে না।”
“অনেক প্রকাশক তাদের নতুন সকল বইয়ের তথ্য না দেওয়ায় মেলায় প্রকৃতপক্ষে কত নতুন বই এসেছে এই তথ্য পাওয়া যায় না,” বলেন তিনি।
গতবারের মতো এবারও বাংলা একাডেমির একটি কমিটি বইয়ের মান যাচাইয়ের চেষ্টা করেছে। তবে সবগুলো বই পর্যালোচনা করা যায়নি।
মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, “আসলে এত স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে মানসম্মত বই বাছাই বা নিরূপণ করা বাস্তবসম্মত নয়।”
‘মেলা সফল’
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, “বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয়। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় মেলা সফল হয়েছে।”
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “বিন্যাস ও আঙ্গিকগত দিক দিয়ে এবারের বইমেলা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।”
সভাপতির বক্তব্য একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, “বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে বড় একটি দিগন্ত। বই পাঠের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে মানবিক দর্শন জাগ্রত হবে।”
অনুষ্ঠানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এবং বইমেলা উপলক্ষে গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়।
এছাড়া ক্যারোলিন রাইট এবং জসিম মল্লিককে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ এবং কবি মোহাম্মদ রফিককে কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ দেওয়া হয়।
এদিন ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন বাদল সৈয়দ, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সৌম্য সালেক ও পলি শাহিনা।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩
২০২২ সালে ‘বিষয় ও গুণমানসম্মত’ সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনীকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩’ দেওয়া হয় মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে।
এর মধ্যে ‘শৈল্পিক ও গুণমান’ বিচারে সেরা বই নির্বাচিত হয়েছে আহমদ রফিকের ‘বিচ্ছিন্ন ভাবনা’। বইটি প্রকাশ করে পুরস্কৃত হয়েছে প্রকাশনা সংস্থা ‘জার্নিম্যান বুকস’।
মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদের ‘বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি’ বইয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছে প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’। হাবিবুর রহমানের ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ প্রকাশ করায় মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স।
গুণমান বিচারে সবচেয়ে বেশি শিশুতোষ বই প্রকাশ করে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩’ পেয়েছে প্রকাশনা সংস্থা ময়ূরপঙ্খি।
মেলায় নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুঁথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনী (২-৪ ইউনিট), উড়কি (১ ইউনিট)কে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩’ দেওয়া হয়।
আতশবাজির আয়োজনে নামল পর্দা
রাত ৮টায় বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে আয়োজন করা হয় আতশবাজি ও লেজার শো। হাজারো দর্শনার্থী এই প্রদর্শনী উপভোগ করে।
বিকাল থেকেই লেখক-পাঠকের মিলনমেলা দেখা যায়। অনেককেই শেষ মুহূর্তে তালিকা ধরে বই কিনতেও দেখা যায়। আবার কেউ ব্যস্ত ছিলেন আড্ডায়।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘হাওয়া’ সিনেমার মাধ্যমে আলোচিত হওয়া হাশিম মাহমুদ এসেছিলেন লিটলম্যাগ চত্বরে। তাকে মধ্যমণি করে উপস্থিত সবাই গেয়ে উঠেন ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি। শিল্পী সন্দীপনসহ অনেকে কণ্ঠ মেলান এই গান-আড্ডায়।
আরও পরিসংখ্যান
বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলিয়ে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমিসহ ৩৪টি প্রতিষ্ঠান দুই প্রান্তেই প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়।
এবার এক ইউনিটের ৩২৮টি, দুই ইউনিটের ৩২২টি, তিন ইউনিটের ১৫৯টি এবং চার ইউনিটের ৯২টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিশুদের জন্য ৭১টি প্রতিষ্ঠান ১১১টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ পায়।
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ‘শেখ রাসেল শিশু চত্বর’, ‘বঙ্গমাতা চত্বর’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু চত্বরে’ ভাগ করা হয়। বাংলা একাডেমি অংশকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা চত্বর’ নাম দেওয়া হয়।
এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের সামনে নেওয়া হয়। মোট ১৬০টি লিটল ম্যাগাজিনকে স্টল দেওয়া হয়।
মেলা শুরুর প্রথম পর্যায়ে নীতিমালা ভঙ্গের কারণে দুটি প্রতিষ্ঠানের দুটি বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আরও একটি বইয়ের প্রচার না চালাতে চিঠি দেওয়া হয়।
নীতিমালা অমান্য করে স্টলের কাঠামো বানানোয় তিনটি প্যাভিলিয়ন এবং ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়। পরে অঙ্গীকার নামা দেওয়ায় তাদের স্টল চালু রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।