২০২৩ সাল শেষে বিশেষায়িত এ ব্যাংকের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকায়।
Published : 02 Jan 2024, 08:14 AM
এক বছরের ব্যবধানে আরো প্রায় ১৮৮ কোটি টাকা যোগ হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের লোকসানের খাতায়; ২০২৩ সাল শেষে বিশেষায়িত এ ব্যাংকের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকায়।
ব্যাংকটি ২০২৩ সালের আয়-ব্যায়ের যে হিসাব তৈরি করেছে, সেখানেই উঠে এসেছে লোকসানের এই চিত্র।
কৃষিভিত্তিক ঋণের জন্য এ ব্যাংক গঠিত হলেও ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ শুরু করেছে। সেখানে মুনাফা করতে পারলেও সাবির্কভাবে লোকসানের পরিমাণ বছর বছর বাড়ছে।
৫৬১ কোটি টাকার লোকসান নিয়ে ২০২৩ সাল শুরু করেছিল কৃষি ব্যাংক। জুন শেষে তা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছিল এক হাজার ৭৪৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ঋণ থেকে আয় এবং পুরনো ঋণ আদায় করতে পারায় বছর শেষে লোকসানের পরিমাণ কমে হয়েছে ৭৪৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
তাতে সার্বিকভাবে এক বছরে ব্যাংকটির নিট লোকসান দাঁড়াচ্ছে ১৮৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। ২০২২ সাল শেষে কৃষি ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ ছিল ৫৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের লোকসান ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের জুন মাসে বেড়েছিল অনেক। ঋণ আদায় করতে পারায় ২০২৩ সাল শেষে তা নামিয়ে আনতে পেরেছি। ঋণ আদায়ে বেশি হওয়ায় লোকসানি শাখার সংখ্যা এক বছরে কমেছে ৯৮টি।’’
২০২৪ সালে কৃষি ঋণ বিতরণের পাশাপাশি এসএমই খাতের ঋণ বিতরণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “নতুন বছরেও আমরা ঋণ আদায়ে জোর দেব। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায় ও মানসম্পন্ন ঋণ বিতরণে সচেষ্ট থাকব।’’
মনোযোগ বৈদেশিক বাণিজ্যে
বৈদেশিক বাণিজ্যে কৃষি ব্যাংকের পদচারণা বাড়ছে দিন দিন। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির আমদানি ব্যবসার পরিমাণ আগের বছরের ২০৫৫ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণ হয়ে চার হাজার ২৯৮ কোটি টাকা হয়েছে। সেইসঙ্গে রপ্তানি ব্যবসাও ৪৮৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের আরেক উৎস রেমিটেন্সও বেড়েছে ব্যাংকটির মাধ্যমে। ২০২২ সালে যেখানে প্রবাসী আয় এসেছে এক হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে সেই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬৯৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকায়। অর্থাৎ, কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ ৯৯ শতাংশ বেড়েছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে শুধু ২০২৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ৩৭৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে বা ৪৫ শতাংশ কম।
যে কারণে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা
কৃষি প্রধান দেশে প্রকৃতির উপর প্রায় পুরোটা নির্ভরশীল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এ খাতে অর্থায়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালের ৩১ মার্চ শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় এটাই ছিল দেশের বৃহত্তম বিশেষায়িত ব্যাংক।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ বাদে সারা দেশের কৃষিভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংকটির। ঢাকার মতিঝিলে প্রধান কার্যালয়ের বাইরে ৫০ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক হাজার ৩৮টি শাখা রয়েছে এ ব্যাংকের।
পরে কৃষি ব্যাংককে তফসিলি ব্যাংকে রূপান্তরিত করা হলেও কৃষি ঋণে অগ্রাধিকার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয় গঠনতন্ত্রে।
লোকসান কেন
কৃষি ব্যাংকের সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে কৃষি খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ১৯ হাজার ৪১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা ওই সময়ে মোট ঋণের ৮১ দশমিক ১৪ শতাংশ।
২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংকটিতে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২৩ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা।
প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকে এক বছরে বিতরণ করা ঋণের মাত্র আড়াই শতাংশ হচ্ছে কৃষি ঋণ।
কৃষি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানীয়া মনে করেন, বছর শেষে এ ব্যাংকের লোকসান ও মূলধন ঘাটতি বাড়ার অন্যতম কারণ পরিচালন খরচ ও তহবিল ব্যবস্থাপনার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া।
দীর্ঘদিন ব্যাংকটির নেতৃত্ব দেওয়া এ ব্যাংকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাজার থেকে প্রতিযোগিতার সুদহারে আমানত সংগ্রহ করে বাণিজ্যিক ঋণের চেয়ে কম সুদে ঋণ দিতে হয় কৃষি ব্যাংককে।
“এতে অনেক সময় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ঋণাত্মক হয়ে লোকসান বাড়ে। অর্থাৎ, আমানতের বিপরীতে দেওয়া সুদ ও পরিচালন ব্যয় মিলিয়ে মোট খরচ কৃষক পর্যায় থেকে পাওয়া সুদের চেয়ে বেশি হয়। খরচ বেশি হওয়ায় ব্যাংক লোকসানেই থাকে বছর শেষে।”
আছে মূলধন ঘাটতি
ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসান দেওয়ার পাশাপাশি মূলধন সংকটেও ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি আগের চেয়ে বেড়ে ১৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা হয়েছে।
আয় বাড়াতে স্থানীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ানো শুরু করলেও তা ব্যাংকটির মূল কাজ নয়। মূলধন ঘাটতি কমাতে সরকারের কাছে দুটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন জানিয়ে আলী হোসেন প্রধানীয়া বলেন, “আমানতের সুদ হার ও কৃষি ঋণের সুদহারের পার্থেক্যে যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে; তা সরকারের পক্ষ থেকে সুদ-ভর্তুকি হিসেবে দিলে ব্যাংকের লোকসান হবে না।’’
তিনি বলেন, কৃষক পর্যায়ে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে বাণিজ্যিক ঋণের চেয়ে কৃষি ঋণের সুদহার এক শতাংশ কম ধরে বিতরণ করার নিয়ম করেছে সরকার। আমদানি বিকল্প কৃষি পণ্যের বিপরীতে চার শতাংশ সুদেও ঋণ বিতরণের তহবিল পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হাজারের বেশি শাখা পরিচালনা করারও একটি খরচ আছে।
“মূলধন ঘাটতি মেটাতে শূন্য কূপন বন্ড ছাড়ার প্রস্তাব করেছিলাম মন্ত্রণালয়ে। প্রতি বছর বন্ডের আকারের দশ শতাংশ ম্যাচিউরড হবে। এটি করতে পারলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক লোকসান কাটিয়ে মুনাফায় ফিরতে পারবে।”
বাড়ছে আমানত, ঋণ ও খেলাপি
লোকসান গুনলেও ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে আমানত বাড়াতে পেরেছে কৃষি ব্যাংক। ২০২২ সালের ৩৭ হাজার ৮২৭ কোটি ৯১ লাখ টাকার আমানত ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে ৪২ হাজার ৭৫৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা হয়েছে। এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ শতাংশ।
গত ২০২৩ সালে ব্যাংকটি ২২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে, আগের ২০২২ সালে আদায় করেছিল প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা।
তবে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৯৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। খেলাপির হার ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
আলী হোসেন প্রধানীয়া বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেখানে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের উপরে, সেখানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে খেলাপির হার সাড়ে ৯ শতাংশ।