তিন সারের অতিমূল্যে বিপাকে কৃষক

পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও ‘সরবরাহ সঙ্কটের’ কথা বলে রবি মওসুমে তিনটি সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা; কিছু জেলায় চড়া দামেও চাহিদামত সার না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2021, 06:44 PM
Updated : 17 Dec 2021, 08:02 PM

ঝিনাইদহ, নওগাঁ, রংপুর ও কুড়িগ্রামের কৃষক ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের বাজারে এমন অস্থিরতার চিত্র পাওয়া গেছে।

সরকার টিএসপি সারের দাম প্রতিবস্তা এক হাজার ১০০ টাকা বেঁধে দিলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়।

প্রতিবস্তা এমওপি বা পটাশ সার ৭৫০ টাকার জায়গায় ৯৫০ টাকায় এবং ডিএপি ৮০০ টাকার জায়গায় ৯৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক।

দেশে বছরজুড়ে যত রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয়, তার অর্ধেকই ইউরিয়া সার। টিএসপি, ডিএপি ও এমওপির মত নন-ইউরিয়া সারগুলো শুকনো মওসুমে ফসলের মাঠ প্রস্তুতের সময় ব্যবহৃত হয়। আর ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয় ফসলের বাড়ন্ত সময়ে।

কৃষকরা বলছেন, বর্তমানে আলু, ডাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য রবিশস্যের মাঠ প্রস্তুতির জন্য ইউরিয়া ছাড়া অন্য সারগুলোর চাহিদা বেড়েছে। এ সুযোগে এসব সারের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যদিও ইউরিয়া সার সরকার নির্ধারিত দরে প্রতিবস্তা ৮০০ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে।

কৃষকদের অভিযোগ যে সত্যি কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের কথাতেও তা স্পষ্ট। গত মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে সমন্বয় সভা শেষে তিনি বলেছিলেন, দেশে সারের কোনো সঙ্কট না থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গুজব ছড়িয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ‘অসাধু এ সিন্ডিকেটের’ বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেছেন।

দাম বেশি, চাহিদামত মিলছেও না

রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিনমণ এলাকার কৃষক মহিকুল ইসলাম বলেন, সরকার এক হাজার ১০০ টাকায় দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে সার তিনি পাননি; কিনতে হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকায়।

“অনেক দোকানে পর্যাপ্ত সারও পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে ১৫ বস্তা চাইলে ১০ বস্তা পাচ্ছি।“

জসিম উদ্দিন নামে এক ডিলার দাবি করেন, বর্তমানে আলুর জমি তৈরিতে যে পরিমাণ নন-ইউরিয়া সারের চাহিদা তৈরি হয়েছে, বাজারে সেই পরিমাণ সার ‘নেই’। তাই দাম কিছুটা বেড়ে গেছে। পটাশ ৮০০ টাকা সরকারি মূল্য, সেটা এখন এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তবে সার সঙ্কটের কথা উড়িয়ে দিয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ পরিচালক তৌহিদুল ইকবাল বলেছেন, “পটাশের একটা সঙ্কট ছিল- সেটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। চলতি মাসে পাঁচ হাজার বস্তা অতিরিক্ত সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”

নওগাঁ জেলার একাধিক কৃষকের অভিযোগ, গত দুই সপ্তাহ ধরে এমওপি বা পটাশ প্রতি বস্তা ৭৫০ টাকার জায়গায় ৯৫০ টাকায় এবং ডিএপি ৮০০ টাকার বদলে ৯৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে তাদের।

জেলার রায়নগর উপজেলার সার ডিলার আব্দুস সাত্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারি বরাদ্দ ‘কম হওয়ার’ কারণে তারা বাইরে থেকে সংগ্রহ করছেন, সে কারণে দাম বেশি পড়ে যাচ্ছে।

নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ সার সঙ্কটের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।

তার দাবি, সারের কোনো সঙ্কট নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ‘কারসাজি করে’ এ অবস্থা তৈরি করেছে। কৃষক লিখিত অভিযোগ দিলে তারা ব্যবস্থা নেবেন।

মূলত জমি চাষ করে ফসল লাগানোর জন্য উপযোগী করতেই পটাশ ও ডিএপি সার ব্যবহার করা হয়। আলু চাষের ভরা মৌসুমে কুড়িগ্রামে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি এমওপিতে (পটাশ) চার টাকা ও টিএসপিতে ছয় টাকা বাড়তি গুণতে হচ্ছে বলে কৃষকের অভিযোগ। 

ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পর্যাপ্ত না থাকায় বাড়তি দামেও সার সংগ্রহ করতে পারছেন না কৃষক। এ সঙ্কটে হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষীরা।

কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী শিবরাম গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে অভিযোগ করেন, তারা দুই ভাই মিলে ৯ একর জমিতে আলুর চাষ করেছেন। কিন্তু মৌসুমের শুরু থেকেই সময়মত সার পাচ্ছেন না। কয়েকদিন আগে আগমনী বাজারে এক সার ব্যসসায়ীর কাছে প্রতি বস্তা এমওপি (পটাশ) ৯৫০ টাকা ও টিএসপি ১৫০০ টাকায় কিনলেও রসিদ দেয়নি ব্যবসায়ী।

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, এবছর বিএডিসির সার সরবরাহে ‘কিছু জটিলতার কারণে কিছু সমস্যা’ হয়েছিল। তবে এখন কোনো সঙ্কট নেই। বেশি দাম নেওয়ার অভিযোগও সত্য নয়।

যেসব ইউনিয়নে আলুর আবাদ বেশি, সেখানে সাময়িক সঙ্কট হলে পাশের এলাকা থেকে সার সংগ্রহের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, সারের দাম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কোথাও দাম বেশি নিলেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাবে কৃড়িগ্রাম জেলায় গত নভেম্বর মাসে দুই হাজার ২৯৫ মে. টন এমওপি, এক হাজার ৪৮৩ মে. টন টিএসপি ও তিন হাজার ৪৩৬ মে. টন ডিএপি সার বরাদ্দ করা হয়।

ডিসেম্বরে দুই হাজার ৯৪৯ মে. টন এমওপি, দুই হাজার ১৩৮ মে. টন টিএসপি ও পাঁচ হাজার ৪৮ মে. টন ডিএপি সার বরাদ্দ করা হয়েছে। এর বাইরেও অতিরিক্ত ৫০০ মে. টন নন ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ডিএপি সার

মজুদ কত?

আগামী বোরো মৌসুমের জন্য দেশে সব ধরনের সারের ‘পর্যাপ্ত মজুদ’ রয়েছে জানিয়ে গত মঙ্গলবার কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সঙ্কটের গুজব ছড়িয়ে’ কেউ কেউ দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে; ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

সচিবালয়ে সার মজুদের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। ওই বৈঠকে সারের পর্যাপ্ত মজুদের কথা জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনও।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ডিসেম্বরে ইউরিয়া সারের তিন লাখ এক হাজার ৯০২ টন চাহিদার বিপরীতে মজুদ রয়েছে ৮ লাখ ৩২ হাজার টন। এ মসে টিএসপির চাহিদা এক লাখ ১৪ হাজার টন, মজুদ এক লাখ ৯২ হাজার টন। ডিএপির চাহিদা দুই লাখ ৮৮ হাজার ৬১২ টন, এর বিপরীতে মজুদ ৫ লাখ ৯৬ হাজার টন। এমওপির চাহিদা এক লাখ ২৯১৮৫ টন, মজুদ রয়েছে তিন লাখ ১২ হাজার টন।

আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ‘অস্বাভাবিক’ বৃদ্ধি পেয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যে সারের দাম প্রতি টন ৩০০ ডলার ছিল, তা বেড়ে এখন হয়েছে ৯৬৪ ডলার।

“আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়ে আমাদের মত দেশগুলোকে শোষণ করছে। আর এদিকে দেশে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা গুজব ছড়িয়ে কোথাও কোথাও এলাকাভেদে বিচ্ছিন্নভাবে সারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমরা কঠোরভাবে এটি মনিটর করছি, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছেন।”

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান বলেন, “গত কয়েকদিন সার পরিবহনে কিছু সমস্যা ছিল, তা কেটে গেছে। কোনো ডিলার সারের দাম বেশি নিলে তার সদস্যপদ বাতিল করা হবে।”

[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের রংপুর প্রতিনিধি আফতাবুজ্জামান হিরু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আহসান হাবিব নীলু ও নওগাঁ প্রতিনিধি সাদেকুল ইসলাম]