পিপলস লিজিং পুনরুজ্জীবন: নতুন পর্ষদ গঠন, একগুচ্ছ নির্দেশনা

ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে বসা পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পরিবর্তে পুনরুজ্জীবিত করতে ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে হাই কোর্ট, যেটির চেয়ারম্যান হবেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল-উল আলম।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2021, 01:33 PM
Updated : 13 July 2021, 03:14 PM

দুর্দশাগ্রস্ত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চালু করতে পর্ষদে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে থাকছেন আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন।

বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার এক আদেশে এই পর্ষদ গঠন করে দেয়।

মঙ্গলবার প্রকাশিত এই আদেশে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় আদালত একই সঙ্গে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাসহ পর্ষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি ও দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক এর চেয়ারম্যানদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছে।

এর আগে গত ২৮ জুন অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংক বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড- পিএলএফএসএলকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল হাই কোর্টের এই একক বেঞ্চ।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল-উল আলমের নেতৃত্বে নবগঠিত পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন- সাবেক সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সিকদার, সাবেক জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ হাসান শাহীদ ফেরদৌস, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা (বিগ্রেডিয়ার জেনারেল) কাজী তৌফিকুল ইসলাম, ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট নুর-ই-খোদা আব্দুল মবিন, মওলা মোহাম্মদ, আমানকারীদের প্রতিনিধি ড. নাশিদ কামাল ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান নুরুল কবির।

আদেশে নবগঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যানকে সব সদস্য ও সাময়িক অবসায়কের (অকার্যকর) সঙ্গে কথা বলে সুবিধাজনক সময়ে পর্ষদের প্রথম সভা আহ্বান করতে নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। এছাড়া আরও তিনটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আমানতকারীদের বিষয়ে বলা হয়েছে, “আমানত ফেরত পেতে আগামী ৬ মাস তারা পিএলএফএসএল এর পর্ষদের কাছে দাবি জানাতে পারবে না। তবে মানবিক কারণে পর্ষদ কোনো আমানতকারীর আমানত ফেরত দিতে পারবে।”

অন্যদিকে আদালত নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় জনশক্তি নিয়োগ করতে বলেছে।

এক্ষেত্রে আদেশে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, “পিকে হালদার বা তার সহযোগী নয় এবং অন্যান্য খেলাপি পরিচালকদের সাথে যুক্ত ছিলেন না এমন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পুনঃনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করবেন।”

পিপলস লিজিংয়ের পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আইনজীবী কামাল-উল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত আমার সম্মতি নিয়েই চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

“আদালত আদেশে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, এসব নির্দেশনার বাইরে আসলে যাওয়ার সুযোগ নেই। পর্যায়ক্রমে সেগুলো অনুসরন করে গুছিয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে। দেখা যাক কতটা কী করতে পারি।”       

পর্ষদ গঠন করে হাই কোর্ট যে আদেশ দিয়েছে তাতে সাময়িক অবসায়কের আর প্রয়োজনীয়তা থাকছে না বলে মনে করেন পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবসায়কের আইনজীবী মেজবাহুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ আদেশের ফলে পিএলএফএসএল এর সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুইডেটর) আর থাকছে না। সাময়িক অবসায়ককে এখন সমস্ত দায়-দায়িত্ব, নথি, টাকাপয়সা, সম্পত্তি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।”

আমানতকারীদের পক্ষের আইনজীবী আহসানুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুবই ভালো আদেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। আমি মনে করি এ আদেশে যে দিক নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়েছে তা আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে।” 

আদেশে নবগঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকসহ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সম্মানীও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, প্রতি পর্ষদ সভার জন্য সম্মানী হিসেবে চেয়ারম্যান পাবেন ৫০ হাজার টাকা। প্রতি বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) জন্য পাবেন ৩ লাখ টাকা।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক কত পারিশ্রমিক পাবেন তা পরিচালনা পর্ষদকে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে আদেশে।

এছাড়া প্রতি পর্ষদ সভার জন্য সদস্যদের সম্মানী ধরা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা এবং এজিএমে পাবেন ১ লাখ টাকা।

পর্ষদের চেয়ারম্যানের প্রতি ৪ নির্দেশনা

>> সব সদস্য ও সাময়িক অবসায়কের (অকার্যকর) সঙ্গে কথা বলে সুবিধাজনক সময়ে পর্ষদের প্রথম সভা আহ্বান করবেন এবং সভা পরিচালনা করবেন।

>> চেয়ারম্যান সাময়িক অবসায়কের সহযোগিতা নিয়ে বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অস্থায়ীভাবে একজনকে সচিব (সেক্রেটারি) হিসেবে নিয়োগ করবেন; যিনি পর্ষদের প্রথম সভার আগেই চার্টার্ড ফার্ম অ্যাকনাবিন এর নিরীক্ষা প্রতিবেদন (অডিট রিপোর্ট) প্রত্যেক পর্ষদ সদস্যদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। 

>> প্রথম সভায় পর্ষদের চেয়ারম্যান আদালতের আদেশ-নির্দেশগুলো পর্ষদ সদস্যদের কাছে তুলে ধরে তা ব্যাখ্যা করবেন।

>> পিএলএফএসএল এর বিলুপ্ত বা নিস্ক্রিয় সাময়িক অবসায়ক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা নিয়ে সমস্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন, তফসিল, সমিতির গঠনতন্ত্র, সমঝোতা জোগাড় করে তা পর্যালোচনার মাধ্যমে পিএলএফএসএএল এর বর্তমান অবস্থা বা পরিস্থিতি বোঝার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আদেশে পরিচালনা পর্ষদ ও পরিচালকদের প্রতি ছয়টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আদালত বলেছে, “এই আদালতে থাকা ঋণ খেলাপিদের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা-নিয়ন্ত্রণমূলক আদেশ বাতিল বা সংশোধন করার জন্য পরিচালনা পর্ষদ নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখবে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাবেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা, নিরীক্ষক এবং পিএলএফএসএলের অন্যান্য কর্মকর্তাদের কার কী ভূমিকা।”

এতে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পর্ষদের তদারকি ও পর্যবেক্ষণে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার চেষ্টা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদেশে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের বিষয়ে কারণ পর্যালোচনা করে পর্ষদ আইন অনুযায়ী ঋণ খেলাপিদের পুনঃতফসিলের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।

আদালত সাময়িক অবসায়ক (অকার্যকর) মো. আসাদুজ্জামানকে নির্দেশ দিয়ে আদেশে বলেছে, “পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ পাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা অথবা অন্যান্য কর্মকর্তার কাছে পিএলএফএসএল এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ অর্থ, শেয়ার, ডিবেঞ্চার, এফডিআর, চাবি, গাড়ি, নথিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি হস্তান্তর করতে।”   

একই সঙ্গে তাকে পিএলএফএসএল এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে নির্দেশনা দিয়ে আদালত পর্ষদের সব সভা, এজিএম ও ইজিএমগুলোতে উপস্থিত থেকে পর্ষদের কাছে প্রয়োজনীয় নথি এবং তথ্য সরবরাহ করতে বলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রতি নির্দেশনা

পিএলএফএসএল এর পর্ষদকে কার্যকর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এবং নবগঠিত পর্ষদের সঙ্গে বৈঠকের নির্দেশ দিয়ে আদালত আদেশে বলেছে, “চূড়ান্ত অব্যাহতি দিয়ে আদালতের আদেশ না হওয়া পর্যন্ত পিএলএফএসএল এর পরিচালনা পর্ষদের সাথে সাময়িক অবসায়ককে (অকার্যকর) সংযুক্ত রাখবেন।”

এছাড়া পিএলএফএসএলকে উদ্বুদ্ধ করতে বিকল্প হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ‘অর্থ উদ্দীপনা প্যাকেজ’ চালু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গভর্নরকে।

আদেশে বলা হয়েছে, “যদি তিনি এ ব্যপারে সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পান তবে কোম্পানির কার্যক্রম, সক্ষমতা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ অনুযায়ী পিএলএফএসএল পুনর্গঠন বা অন্য কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।”

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানকে পিএলএফএসএল এর পুনরুজ্জীবিত করার খবর বিএসইসি এর অফিসিয়াল ওয়েব পেইজে এবং সংবাদপত্রে প্রচার-প্রকাশের জন্য নির্দেশনাসহ প্রতিষ্ঠানটিকে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনায় পর্ষদকে নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিতে বলেছে।

নতুন পর্ষদকে সহযোগিতার পাশাপাশি দুদকের চেয়ারম্যানের প্রতি নির্দেশনায় আদালত বলেছে, “পিএলএফএসএলের লেনদেন বা ব্যবসার সাথে জড়িত বা সংযোগ আছে এমন বিষয়ে ফৌজদারি মামলা করার ক্ষেত্রে বা মামলা থাকলে আইন অনুযায়ী তা করতে।”

পিএলএফএসএল এর ঋণ গ্রহীতাদের প্রতি নির্দেশনায় আদালত বলেছে, “ঋণ পুনঃতফসিল করতে আইন অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতাকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ডাউন পেমেন্ট (এককালীন টাকা পরিশোধ) দিয়ে পিএলএফএসএল এর প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল। যদি তারা তা করতে ব্যর্থ হয় তবে আদালতে হাজির হয়ে তাদের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে।”

এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২২ আগস্ট তারিখ রেখেছে হাই কোর্ট।

পি কে হালদারের অর্থ কেলেঙ্কারিতে পড়া পিপলস লিজিং পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশনা চেয়ে গত মাসে ২০১ জন আমানতকারী আইনজীবী শামীম আহমেদ মেহেদীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করেন।

আমানতকারীদের আবেদনে সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত অবসায়ন না করে পিএলএফএসএলকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত দেয়।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। ওই চার কোম্পানির মধ্যে পিপলস লিজিংও একটি।

পরে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান বলে ২০২০ সালের শুরুতে খবর আসে। তাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি করা হয় রেড নোটিস।

১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

তবে ২০১৫ সালের পর থেকে অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ধারাবাহিকভাবে খারাপ হতে থাকলে এবং খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পের আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারেনি।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিনই মামলার শুনানি শেষে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।

আরও পড়ুন